২০২৪-এর ৪ ডিসেম্বর, নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটনে, ‘ইউনাইটেড হেলথ কেয়ার’-এর সিইও ব্রায়ান থম্পসনকে গুলি করে হত্যা করে ২৬ বছরের লুইজি ম্যাঞ্জিয়নি। তিনি আমেরিকার অন্যতম সেরা হাইস্কুলে প্রথম হওয়া ভেলিডেক্টোরিয়ান, ‘ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া’র মতো ‘আই.ভি.লিগ.’ কলেজে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকুরিরত যুবক, বাল্টিমোরের এক ধনী রাজকীয় পরিবারে তাঁর জন্ম। লুইজির ঠাকুরদা নিক ম্যাঞ্জিয়নে সিনিয়র– সাফল্যের ফলস্বরূপ, আমেরিকার সমস্ত স্বাস্থ্যপরিসেবায় তাঁদের পরিবারের বহু মিলিয়ন ডলার দান করা রয়েছে। কিন্তু লুইজি ম্যাঞ্জিয়নির কোপ এই স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিরুদ্ধেই! কিন্তু কেন?
শেষ জীবনে সত্যজিৎ রায়কে চিকিৎসা-বিষয়ক বহুলব্যয়ের দুর্মূল্যতা এবং সেই হেতু মানুষের আর্থিক ও মানসিক হেনস্তা এবং চাপের কথা ভাবিয়েছিল। তিনি চাইলেও, এই বিষয়ে চলচ্চিত্রে কাজের মধ্য দিয়ে তিনি কিছু বলার আগেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়।
এই সমস্যা সার্বিক। ২০২৪-এর ৪ ডিসেম্বর, নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটনে, ‘ইউনাইটেড হেলথ কেয়ার’-এর সিইও ব্রায়ান থম্পসনকে গুলি করে হত্যা করে ২৬ বছরের লুইজি ম্যাঞ্জিয়নি। তিনি আমেরিকার অন্যতম সেরা হাইস্কুলে প্রথম হওয়া ভেলিডেক্টোরিয়ান, ‘ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া’র মতো ‘আই.ভি.লিগ.’ কলেজে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকুরিরত যুবক, বাল্টিমোরের এক ধনী রাজকীয় পরিবারে তাঁর জন্ম। লুইজির ঠাকুরদা নিক ম্যাঞ্জিয়নে সিনিয়র– সাফল্যের ফলস্বরূপ, আমেরিকার সমস্ত স্বাস্থ্যপরিসেবায় তাঁদের পরিবারের বহু মিলিয়ন ডলার দান করা রয়েছে। কিন্তু লুইজি ম্যাঞ্জিয়নির কোপ এই স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিরুদ্ধেই! কিন্তু কেন? নিক গর্ব করে বলতেন, মাত্র ১১ বছরে পিতৃহারা হওয়ার দুঃসময়ে, দুটো পাঁচ পয়সাও তাঁর হাতে ছিল না। সেই সফল ঠাকুরদার নাতি উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে হেলায় ছুড়ে ফেলে হাই প্রোফাইল অপরাধে জড়িয়ে পড়ল!
লুইজি ম্যাঞ্জিয়নি নিজের এই কর্মকাণ্ডকে কর্পোরেট লোভের বিরুদ্ধে এক ‘যুদ্ধ’ হিসেবে ‘সাফাই’ গাইলেও যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশের সভ্যসমাজে ‘হিংসা’ এবং ‘হত্যা’– সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু খুব আশ্চর্যজনকভাবে এ-ও চোখে পড়ল যে, ছ’দিন তাঁকে চিহ্নিত করতে এগিয়ে এল না কেউ। আবার ছ’দিন পলাতক থাকার পর ধরা পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে কেন্দ্র করে ‘জাতীয় হিরো’ ও ‘লুইজি ম্যাঞ্জিয়নি প্রজেক্ট’ নামে একটি ‘ফেসবুক পেজ’ গড়ে উঠেল। শুধু তাই নয়, খ্রিস্টান বাক্-স্বাধীনতার সপক্ষে থাকা সংস্থা ‘গিভ-সেন্ড-গো’ থেকে তাঁর পাশে থাকার আইনি-সাহায্যের জন্য ২,০০,০০০ ডলার জনদানের তহবিল তৈরি করেছে, যেখানে ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে ৩১,০০০ ডলারেরও বেশি অর্থ!
ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশাল ‘প্রিমিয়াম’ এবং তুলনামূলক কম ‘কভারেজ’-এর কারণে আমেরিকায় স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানিগুলোর ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ জমা হচ্ছে প্রতিদিন। সম্প্রতি একটি বিখ্যাত চিকিৎসাবিমা সংস্থা ‘এনাস্থেশিয়া’ ও চিকিৎসা ‘প্রসিডিওর’-এর সময়সীমার বাধ্যবাধকতা কারণে রোগীকে উদ্বৃত্ত সময়ের ভরতুকি বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে পলিসি পাল্টানোর কথা ঘোষণা করতেই, মানুষ আরও চিন্তায় পড়ে। সম্প্রতি এই খুনের প্রসঙ্গে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক বাড়লে, তাঁরা পলিসি বদলের প্রকল্প বানচাল করে দেয় এবং আগের স্থিতাবস্থাতেই থাকার ব্যাপারে মনস্থির করে। যেহেতু আমেরিকার কৃষ্টি অনুযায়ী প্রকাশ্যে এই ব্যাপারগুলো আলোচনায় উঠে আসে না, তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে সম্যকজ্ঞানও লোকের কম। শুধুমাত্র ‘ক্রনিক’ কোনও অসুখ বয়ে বেড়ান যাঁরা, তাঁরা ‘মাথার ওপর খাঁড়ার ঘা’ নিয়ে জীবন কাটান।
এমনও অভিজ্ঞতা অনেকের হয়েছে যে, চাকরি সূত্রে পাওয়া বিমা চাকরি হারানোর পর অকার্যকর হয়ে গেলে ‘কোবরা’ (contribution of health coverage)-কালীন নতুন বিমা কোম্পানি পুরনো ‘ক্রনিক রোগ’-কে ‘প্রি-এগজিস্টিং’ তকমা নিয়ে কোনও ‘কাভারেজ’ দেবে না জানায়, কিংবা নতুন বিমা কোম্পানির ক্ষেত্রে সেই বিমার প্রিমিয়াম হবে আকাশছোঁয়া। রোগী তখন ‘ছাড়িলে না ছাড়ে’ সেই পুরাতন ভৃত্য রোগটিকে নিয়ে যাবেন কোথায়? হাসপাতাল, ডাক্তার, ‘এমআরআই’-সহ অন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জেরবার হয়ে পড়ে তাঁর জীবন। একটি এমআরআই-এর খরচ বিমাহীনভাবে ৪০০-১০,০০০ ডলার। বিমা থাকলেও রোগীর ভাগের অংশটুকুতে হাজার খানেক ডলার পড়েই যায়। তবে মোটামুটি ভাবে স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে আর চলনসই স্বাস্থ্যবিমা থাকলে, ন্যূনতম ‘বাৎসরিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা’ বা ‘রুটিন চেক আপ’, টীকা, সর্দি-জ্বর ইত্যাদিতে কাজ চলে যায়। যদিও রোগীর তরফে বরাদ্দ থাকে কখনও ‘কো পে’ (copay), কখনও ‘হাই ডিডাক্টেবল’, কখনও বা শতকরা ২০ বা ৩০ ভাগ ‘খরচ-দায়’ বা ‘পেশেন্ট রেসপন্সিবিলিটি’।
‘কো-পে’-তে অত গায়ে লাগে না, কিন্তু ‘হাই ডিডাক্টেবল’ রোগীর রক্ত ও স্নায়ুচাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তো বটেই। বেশিরভাগ স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানিগুলোর ৬,০০০-৮,০০০ ডলার ‘হাই ডিডাক্টেবল পলিসি’ আজকাল সবাই নিতে বাধ্য হচ্ছে। এর মানে এই ৬,০০০-৮,০০০ টাকা পর্যন্ত রোগীর যা খরচ, তা তাঁকেই ‘আউট অফ পকেট’ চার্জ হিসেবে দিতে হবে। এরপরের বাকি অংশ ৮০:২০ বা ৭০:৩০ হবে কি না, তা পলিসি অনুযায়ী রোগী এবং স্বাস্থ্যবিমার সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত হবে।
২০২২-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকার নাগরিকদের বার্ষিক আয় গড়ে ৩৭,৫৮৫ ডলার অর্থাৎ, মাসিক আয় ৩,৫০০ ডলার এবং ২০২৪-এর পরিসংখ্যানে সেই বার্ষিক আয় গড়ে ৫৯,২২৪ ডলার অর্থাৎ, মাসিক আয় ৫,০০০ ডলার। আয়কর এবং সঞ্চয় কেটে নেয় আরও হাজার ডলার। এই অসমানুপাতিক আয় ও বিমার দোলাচলে ‘যুদ্ধ’ করে চলে নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষ। ক্রনিক রোগের ‘বিশেষ দাওয়াই’-এর ক্ষেত্রে প্রতি দু’সপ্তাহে ‘আউট অফ পকেট’ থেকে ওষুধের দাম কখনও-সখনও ১৬০০ থেকে ২১০০ ডলারও দেখা গিয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রেই তা আয়ত্তের বাইরে। কেউ কেউ হার্টের অপারেশন ঝুঁকি নিয়ে স্থগিত রাখছেন, পরের বছর করাবেন বলে। এ বছরের কনট্রাক্টে কম প্রিমিয়াম দরুন হাসপাতাল ফেসিলিটির কভারেজ শতকরা ৫০ ভাগ নিয়েছেন, শুধু সেই কারণে।
৬৫ বছরের পর এদেশে সরকারি পরিষেবা মেডিকেয়ারের আওতায় চলে গেলেও সোয়াস্তি নেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। ৬৫ থেকে জীবনের শেষদিনের জন্য মাত্র একেকবার ‘তিন সপ্তাহ’ শতকরা ১০০ ভাগ কাভার করে হাসপাতাল পরিষেবা। রয়েছে এমন ৬০টি সর্বমোট বরাদ্দ “লাইফ টাইম রিসার্ভ ডে’জ”। ২১তম দিন থেকে ১০০ দিন কিছু অংশের দায়ভার নিতে হবে এবং ১০০তম দিন থেকে সম্পূর্ণ দায়ভার রোগীর নিজস্ব। এইজন্যই অনেক ক্ষেত্রে না বুঝে সিনিয়র দাদা-দিদিদের দিনগুলো ‘হিসেব করে বাঁচাতে’ অসুস্থতা নিয়েও হাসপাতাল থেকে চলে আসার ব্যস্ততা দেখে বিরক্ত হয়েছি। রোগীযত্নের জন্য বাড়ির পরিষেবা কোনও সংস্থা থেকে নিলে তার দাম ঘণ্টায় ৩০-৪০ ডলার, মানে দিনে ৯৬০ ডলার এবং মাসে ২৮,৮০০ ডলার। একটি অবসরপ্রাপ্ত মানুষের বার্ষিক আয় গড়ে মোটামুটি ৩০,০০০-৫০,০০০ ডলার। তবে খুব কম সংখ্যক উচ্চবিত্ত সেই জন্য হাই প্রিমিয়ামের ‘লং টার্ম ইন্সিইরেন্স’ করে রাখেন। প্রতি বছরই প্রিমিয়াম বাড়িয়ে রাখেন তাঁরা।
…………………………………
এরকম কয়েকবার হাসপাতাল-বাড়ি করার পর, ব্যয়বহুলতার কারণে বাড়ির পরিষেবার যখন সম্ভাবনা শূন্য, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠারও সম্ভাবনা দূর অস্ত, হাসপাতালে ‘বিমা কাভারেজ’ মেয়াদের দিনও তলানিতে তখন হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার পর রোগীটি সজ্ঞানে বেছে নেন একটি পথ– যার নাম ‘হসপিস’, যার প্রতিশব্দ ‘ইচ্ছামৃত্যু’।
…………………………………
এমনও দেখা গেছে, সেবা-শুশ্রূষায় নিয়োজিত লোক থাকা সত্ত্বেও বাড়িতে লম্বা-চওড়া লোকটি হয়তো আচমকা পড়ে গেলেন! লোকবল নেই, একজনের পক্ষে তোলা সম্ভব নয়। তবুও বিপত্তারণ ৯১১ নম্বর ডায়েল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হচ্ছে খাটে তুলে দেওয়ার জন্য! মানুষ চেষ্টা করে বিপুল খরচ বাঁচাতে অ্যাম্বুলেন্স এড়িয়ে গাড়িতে চেপে হাসপাতালে যেতে। তার ওপর যদি অন্য এলাকা থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্স হয়, আরও ব্যয়বহুল।
এরকম কয়েকবার হাসপাতাল-বাড়ি করার পর, ব্যয়বহুলতার কারণে বাড়ির পরিষেবার যখন সম্ভাবনা শূন্য, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠারও সম্ভাবনা দূর অস্ত, হাসপাতালে ‘বিমা কাভারেজ’ মেয়াদের দিনও তলানিতে তখন হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার পর রোগীটি সজ্ঞানে বেছে নেন একটি পথ– যার নাম ‘হসপিস’, যার প্রতিশব্দ ‘ইচ্ছামৃত্যু’।
পরিহাস এটাই যে, এই পথে সপ্তাহ থেকে মাসের মধ্যে রোগী জীবন থেকে বিদায় নেবে নিশ্চিত জেনে, বিমা সংস্থাগুলো নার্স-সহ বিনা পয়সায় হয় বাড়িতেই বা ‘হসপিস সেন্টার’-এ শতকরা ১০০ ভাগ কভারেজ দেওয়ার শিষ্টতা ও সৌজন্য দেখায়! ‘হসপিস’ মানে ধীরে ধীরে খাবার, জল খাওয়ানো বন্ধ। স্যালাইন, অক্সিজেন, ওষুধ, রোগনিরাময়ক সব কিছুর সচেতনভাবে ইতি টেনে দেওয়া। শুধু ব্যথা উপশমের জন্য কড়া মরফিন দিয়ে নিস্তেজ-নীল হতে হতে মৃত্যুর দিকে এগোনোর সচেতন সিদ্ধান্তকে সম্মান করা।
এই সবের প্রেক্ষাপটে এমন নৃশংস ঘটনায় আমেরিকার মানবিক বিবেক এই বিমা কোম্পানির সিইও হত্যার ঘটনায় সর্বতোভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে অবশ্যই। বিমা পরিষেবা ও রোগীর মধ্যে যোগাযোগের সেতু ‘আর্টিফিশিয়েল ইন্টেলিজেন্স’ আসার পর দ্বিপাক্ষিক ভুল বোঝাবুঝি, দূরত্ব আরও বেড়েছে। লুইজি ম্যাঞ্জিয়নি, তাঁর মেনিফেস্টোতে মায়ের অসহনীয় ব্যথা-কান্না এবং দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছে। সমাজমাধ্যমে ছবিসমেত ফলাও করে বলেছেন তাঁর নিজের জটিল মেরুদণ্ড অস্ত্রোপচার নিয়ে সর্বতোভাবে ভোগান্তির কথা। ঘটনার অকুস্থলে গুলির খাপের গায়ে লেখা ছিল– ‘ডিনাই-ডিফেন্ড-ডিপোজ’।
২০১০-এ রাটগার্ডের আইন অধ্যাপক জে. এম. ফেইনমেন ক্রেতার পক্ষে লিখেছিলেন– ‘ডিলে, ডিনাই, ডিফেন্ড: হোয়াই ইন্সুরেন্স কোম্পানিস ডোন্ট পে ক্লেইমস অ্যান্ড হোয়াট ইউ কেন ডু অ্যাবাউট ইট’।
সেই সমাজকল্যাণকর পথটি বের করার নিশ্চয়ই সময় এসেছে।