বীর দাস একজন ভারতীয় স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান যিনি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এমি পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর নেটফ্লিক স্পেশাল বীর দাস লান্ডিং-এর জন্য। তাই বর্তমানে আমরা তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। বাঙালিরাও। উচ্ছ্বাসের কারণও কম নেই যেহেতু একজন ‘প্রকৃত শিল্পী’ বলতে আমাদের মগজে যে ওএমআর শিটটি আছে তার সবকটিতে টিক পড়ে গেছে। স্ট্রাগল? টিক! কেরিয়ারের একদম শুরুতে হোটেলে বাসন মাজার কাজ করতেন বীর দাস। নিজের এমি পুরস্কারটি হাতে নিয়ে তেমনই এক হোটলের বাসন মাজার জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি দিয়েছেন।
এ দেশ সততই ইনক্রেডিবল কারণ ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’। ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। যেমন ধরা যাক, ওরা ‘আড্ডা মারে’, অমুকেরা ‘চিল করে’, তমুকেরা ‘ছোলে কুলচে পেলতে’ যায়, ইহারা ‘স্টাডি সার্কেল করে’, উহারা মুলো দিয়ে তৈরি ভেগান মিট বিক্রি করে ইত্যাদি। বৈচিত্র। অথচ নাম, ভাষা, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি, DM, সবেতে এত তারতাম্য থাকা সত্ত্বেও এই প্রতিটা জায়গার অন্তরখানা আসলেই পদ্মপাতায় জলের বিন্দু অথবা ধোঁয়া ওঠা ফর্সা ডিমসিদ্ধসম টলটলে, অমায়িক। কিছু সমমনস্ক মানুষ তাদের ফাঁকা সময়ে একত্রিত হয়ে বোর্হেস অথবা ক্যালভিনোকে টেক্কা দেওয়ার মতো বাস্তবের ঠাকুদ্দাদাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া আলোচনায় মেতে ওঠেন। ঐক্য। আমরা। আপনি যদি নিজ গুণে ও কর্মকাণ্ডে আমাদের এই আলোচনার মধ্যমণি হয়ে উঠতে পারেন তাহলে জানবেন– এই হল আপনার সফলতার শীর্ষ। তা সে আপনি ক্রিকেট খেলুন, বা অভিনয় করুন বা প্রচুর ঋণ নিয়ে বিলেত পালিয়ে গিয়ে সিগার ফুঁকুন। বর্তমানে সেই ‘আপনার’ নাম বীর দাস। কিন্তু কে এই বীর দাস? আসুন চিনে নি’।
বীর দাস একজন ‘টেরেরিস্ট’। হ্যাঁ, মানে কিছুকাল আগে তাঁকে ওই নামেই ডাকা হচ্ছিল। শুধু ডাকাই হচ্ছিল না, সঙ্গে একজন টেররিস্টের ক্ষেত্রে যা যা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, হয়েছিল সেসবও। বেশ ক’টি এফআইআর হয়েছিল তাঁর নামে। কারণ টেররিস্ট বীর দাস ‘টু ইন্ডিয়ানস’ নামে তার লেখা একটি কবিতা আবৃত্তির ভিডিও পোস্ট করেছিলেন। না না এই কারণে মোটেই এফআইআর হয়নি যে, তুই ব্যাটা স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান, তোর কাজ হাসানো! তুই হাসা! তুই খামোকা আবৃত্তি করতে গেলি কেন! নালিশ হয়েছিল এই মর্মে যে, বীর দাস নিজের দেশকে ছোট করেছে। দেশের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছেন। কারণ সেই কবিতায় তিনি দু’-ধরনের ভারতের কথা বলেছিলেন। যে ভারতে সকালে মেয়েদের পুজো এবং রাতে গণধর্ষণ হয়, যে ভারতে কোভিড চলার সময় বাচ্চারা মুখোশ পরেই করমর্দন করে কিন্তু ক্ষমতায়, মানে ও পদমর্যাদায় বড়রা মাস্ক ছাড়াই আলিঙ্গনে রত হন ইত্যাদি। ফলত বর্তমান পরিস্থিতিতে রেগে যাওয়া স্বাভাবিক ও আবশ্যিক। আমিও রেগে গেছিলাম। এই আমাদেরই তো কয়েক দিন আগে বেশ রাগ হয়েছিল বীর দাসের ওপর। বাঙালি হিসেবে। বীর দাস ‘ফর ইন্ডিয়া’ নামে তাঁরই আরেকটি স্ট্যান্ড আপ স্পেশালে বলেছিলেন, ভাস্কোদাগামা কালিকটের বদলে কলকাতায় নামলে কয়েক দিন পর তাঁর একখানা আস্ত ভুঁড়ি দেখা দিত। তিনি কোনও কাজকর্ম করতেন না আর দিন কয়েকেই ‘ভাস্কোদা’ নামে খ্যাতি লাভ করতেন । অর্থাৎ একটি অলস এবং অকর্মণ্য জাতি হিসেবে বাঙালির যে চিরকালীন স্টেরিওটাইপ, বীর দাস সেটাকে নিজের স্ট্যান্ডআপ রুটিনের অংশ করে তোলার চেষ্টা করেছেন। হ্যাঁ, ‘ভাস্কোদা’ অংশটি অনবদ্য, কিন্তু বাকিটা? খুবই রাগ হয়েছে! তুই জানিস কী রে ব্যাটা বাঙালিদের! এন্টালাইটেনমেন্ট-মাইকির দিব্যি খেয়ে বলছি, একবার মনেও হচ্ছিল এটা নিয়ে গর্জে ওঠা দরকার! সোশাল মিডিয়ায়। তারপর এত ল্যাদ লেগে গেল যে, রাগের অংশটুকু এগিয়ে দিয়ে বাকিটা দেখে ফেললাম। তাছাড়া আরও অনেকে গর্জেছিল বলে আমার গর্জনটা রক্তদানের মতো জমিয়ে রাখলাম। এখানে ‘বোকার মতো’ ডোনেট করে দিলাম আর তারপর কাল বাড়ির কারওর লাগলে তখন কী হবে! কী হবে জানি না, কিন্তু কেন হবে? আসুন খুঁজে নিই।
হবে কারণ, এই যে বাঙালি নিয়ে ইয়ার্কি করলে তাতে বাঙালি বাদে বাকিরা তো হ্যাহ্যই করেছে নাকি! গুজরাতি, সিন্ধি, মণিপুরি, মালয়ালম, অসমিয়া, তামিলিয়ান ইত্যাদি নিয়ে ইয়ার্কি করায় আমরাও হ্যা-হ্যা করেছি, করিও। বৈচিত্র। আসলে যাদের নিয়ে ইয়ার্কি করা হচ্ছে তারা বাদে বাকিরা বুঝতে পেরেছে কী না যে, বীর দাস যেটা করে, সেটাকে বলে ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডি’। ক, মে, ডি। কিন্তু ধরা যাক, এই সকলেই একসঙ্গে মনে করে– বাঁধাকপি একটা ঐশ্বরিক জিনিস। দিকে দিকে বাঁধাকপির পুজো হয়। কোনো লোকের টিফিনবাক্সে বাঁধাকপির তরকারি পাওয়া গেলে তাকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়। সেই তরকারিতে কড়াইশুঁটি পাওয়া গেলে তার পরিবারকেও। এমন সময়ে বীর দাস এসে ধরা যাক বলল, ‘যারা বাঁধাকপি পুজো করে তারা আসলেই নিজেকেই পুজো করে, কারণ মাথাটা ভেজিটেবল লেভেলে না চলে গেলে ও জিনিস অসম্ভব!’ কী হবে? গর্জন। নালিশ। ঐক্য। কী ভেবে এল সেই ঐক্য? আসুন দেখে নিই।
এল, কারণ আমরা একটা বড় ছাতার অংশ হতে চাই। সকলে । একটা দল, একটা গোষ্ঠী, একটা ক্লাব হতে চাই। আমার দল, আমার গোষ্ঠী, আমার ক্লাব। এবার নিজের ক্লাবের সবকিছু কি আপনার ভাল লাগে? অবশ্যই লাগে না, লাগার কথাও না! এই যে বড়রা ক্লাবে এলেই আপনাকে ক্যারামটা তাদের ছেড়ে দিতে হচ্ছে, এটা কী ঠিক? কিন্তু আপনি সেটা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন কারণ বেপাড়ার যে ছেলেটাকে আপনার বহুদিন ধরে পেটানোর শখ ছিল, ক্লাবের সবাই গিয়ে তাকে পিটিয়ে এসেছে। পেটানো উচিতও। অন্তত আপনার তো তাই’ই মনে হয়। পেটানোর আগে কেউ কোনও প্রশ্নও করেনি কারণ একে বেপাড়া, তায় আবার পুজো কমিটি আলাদা। আপনি চিহ্নিত করেছেন, ব্যাস। যথেষ্ট। ঠিক-ভুলের তো প্রশ্নই উঠছে না। আপনি সেই গোষ্ঠীর সদস্য না! এরপর ভেতরে ভেতরে বাঁধাকপি খেতে চাইলেও পারবেন? পারবেন না। কপিকে পুজোই দেবেন আর বীর দাসকে গালাগাল। যার সাহস একটু কম, সে সোশাল মিডিয়ায় দাপাবে আর যার সাহস, ধক এবং নিজেকে প্রমাণ করার ক্ষমতা ও দায় বেশি– সে নালিশ করে দেবে। তখন কীসের যুক্তি? কীসের শিল্প মানে সাবজেক্টিভ? কীসের বাকস্বাধীনতা? কীসের কমেডিতে কে কী বলবে তা কেউ ঠিক করে দেবে না? এবার মুড়ি-মিছরি সব একদর। আমার বাঁধাকপি-বিশ্বাসকে খণ্ডন করা হয়েছে। খারাপ কথা বলা হয়েছে। পাল্টা দাও। আরে সিকিওরিটিও তো একটা কথা না কি? সোশাল, মেন্টাল, আরও নানা জিনিস আছে। তাহলে কী দাঁড়াল? কমেডি মানেই যা খুশি তাই বলা দেওয়া যাবে না? আসুন বুঝে নিই।
কেন যাবে না! নিশ্চয়ই যাবে। আপনার যদি অপছন্দ হয়, আপনিও বলুন। এই আমারই যেমন মনে হয় আমাদের দেশের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ধর্ষণ, যৌনহেনস্তা নিয়ে পাঞ্চডাউন জোক বলা অন্যায়। কেনেডি সেন্টারে দাঁড়িয়ে জিম কার যেটা করতে পারেন সেটা গুরগাঁও বা গোবরডাঙায় দাঁড়িয়ে আপনি করতে পারে না। কিন্তু এটা আমার মনে হয়। আমার ব্যক্তিগত মতামত। কারণ প্রথমত ‘শিল্প’ হিসেবে এখানে স্ট্যান্ডআপ কমেডি এখনও হামা দিচ্ছে। সবে ফোর্থ ব্যাচ। দ্বিতীয়ত এখানে কনসেন্টের ধারণাই এল এই পরশু দিন। তৃতীয়ত, ভিকটিম ব্লেমিং-এ অভ্যস্থ হওয়া আর শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই। একটা বাংলা স্ট্যান্ডআপ কমিক প্র্যাকটিশনার হিসেবে এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। অন্য একজন কমেডিয়ানের মনে হতেই পারে, এসব ঘণ্টার মাথা আমি মানি না। যা খুশি তাই বলব। এইসব নিয়ম চাপানোই বরং অন্যায়। এক্ষেত্রে সে আর আমি– দু’জনেই ঠিক। আমাদের তর্ক হবে। আলোচনা হবে। একসঙ্গে পরপর শো-ও হবে। কিন্তু আমরা কেউ কাউকে গালাগাল করব না। নালিশ জানাব না। এইবার যে বুদ্ধিদীপ্ত ও সুন্দরী পাঠিকার মুখ কল্পনা করে আমি লিখি, তিনি নিশ্চয়ই ভাবছেন যে, তাহলে এসব নানাবিধ কথার মধ্যে হঠাৎ ওই বহিরাগত, দেশপোমানকারী, বঙ্গবিরোধী বীরকে নিয়ে এত আলোচনা কেন? আসুন মেনে নিই।
বীর দাস একজন ভারতীয় স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান যিনি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এমি পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর নেটফ্লিক স্পেশাল বীর দাস লান্ডিং-এর জন্য। তাই বর্তমানে আমরা তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। বাঙালিরাও। উচ্ছ্বাসের কারণও কম নেই যেহেতু একজন ‘প্রকৃত শিল্পী’ বলতে আমাদের মগজে যে ওএমআর শিটটি আছে তার সবকটিতে টিক পড়ে গেছে। স্ট্রাগল? টিক! কেরিয়ারের একদম শুরুতে হোটেলে বাসন মাজার কাজ করতেন বীর দাস। নিজের এমি পুরস্কারটি হাতে নিয়ে তেমনই এক হোটলের বাসন মাজার জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি দিয়েছেন। বিনয়, টিক! ‘দেখছ ভোলেনি কিন্তু?’ডবল টিক! নেটফ্লিক্স খুললেই প্রথমে বীর দাসের সব স্পেশালের বিজ্ঞাপন, আমূলের বিজ্ঞাপনে বীর দাসের কার্টুন যা কিনা দেশ ও দশের সম্পদ হওয়ার সুপারটিক। দেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে জ্বলজ্বল দ্যুতি এনে দেওয়া ঘরের ছেলে। সোনার টুকরো। মানিক। কিন্তু এসবের মেয়াদ ঠিক ক’দিন? আসুন টেনে নিই।
এসবের মেয়াদ তদ্দিন, যদ্দিন না বীর দাস আবার কারওর বাঁধাকপিকে সবজি বলে ডাকছেন। অর্থাৎ ওই পরের স্পেশালটা বেরোনো পর্যন্ত। ওই বীর দাস, ডেভ শ্যাপেল, রিকি জার্ভিস, সারা সিলভারম্যান, মানিক মাহানা, দেভেশ দীক্ষিত, কুণাল কামরাদের মতো বদ লোকদের যা স্বভাব আর কী। ফালতুমি যত!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved