‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দটি ক্ষমতাশালী যুদ্ধবাজ ইজরায়েলের হাতের মোয়া। এক অশ্লীল আমোদ। যুদ্ধ শুরুও হয় তাদের ইচ্ছেয়, যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়াও তাদেরই ইচ্ছেয়। ফিলিস্তিনিদের ভূমিকা অবজ্ঞাযোগ্য। দখলদার ইজরায়েল রাষ্ট্র ঠিক করে নিয়েছে ‘ফলস ফ্ল্যাগ অফ ওয়ার’ দেখিয়ে কখন যুদ্ধনিনাদ গাঢ় করে তুলবে। অথবা কোনও ফিলিস্তিনির নিজের জন্মভূমিতে ফেরার চেষ্টাকে কখন আক্রমণ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে। ফিলিস্তিনিদের বসতি ছেড়ে না-পালানোর জেদকে কখন সন্ত্রাস বলে ঘোষণা করা হবে। ইজরায়েল রাষ্ট্র আর তাদের তাঁবেদার সংবাদমাধ্যম নিখুঁত উপায়ে এই কাজটিই দশকের পর দশক করে চলেছে। তারপর অবশ্যম্ভাবী ‘যুদ্ধ’।
প্যালেস্তাইনে আদতে ১৯৪৮ সালের মে মাসের পর থেকে যুদ্ধ থামেইনি কখনও। নাতিদীর্ঘ বা স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতি পালিত হয়। কখনও ১৫ বছরের, কখনও ১০ বছরের, কখনও ৫ দিনের কিংবা কয়েক ঘণ্টার। ১৯৪৮ সালের মে মাসে জায়নবাদীদের দখলদারি শুরু– সেই উগ্রতার ফল ‘নাকবা’। বিশৃঙ্খলা। বিপর্যয়। ধ্বংসযজ্ঞ। কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনি জন্মভূমি থেকে উদ্বাস্তু। অগণিত ফিলিস্তিনির মৃত্যু। তারপর থেকে মৃত্যুমিছিল অব্যাহত। কারণ, জায়নবাদীদের সন্ত্রাস আর দখলদারি থামেনি। ‘নাকবা’-র অভিঘাত বেড়ে গেছে। ১৯৬৭-র পরে ইজরায়েল পূর্ব জেরুজালেম আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের আরও ভূখণ্ড জবরদখল করেছে। লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি নতুন বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ‘নাকসা’। যুদ্ধবিরতির ঘোলাটে দিনে পালাতে হয়েছে ঘরবাড়ি ফেলে, প্রিয়জনের স্মৃতি থেকে নিজেদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে। পাঁচের দশক, ছয়ের দশক পরবর্তী প্রত্যেক দশকের প্রত্যেক বছর, মাস, সপ্তাহ, দিনে উজাড় হয়ে গেছে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি। সঙ্কুচিত হয়েছে তাদের প্রিয় দেশ। নদী থেকে সমুদ্র, উপত্যকা কেড়ে নিয়ে বেড়ে চলেছে ইজরায়েলের জমি। ইজরায়েলের বন্ধুরাষ্ট্রগুলি, যারা বিশ্বের আর্থ-রাজনীতির নিয়ন্ত্রা, তারা প্যালেস্তাইন দেশটাকেই অস্বীকার করেছে। দমবন্ধ যুদ্ধ চেপে বসেছে ফিলিস্তিনিদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। আর এই প্রত্যেকটি ইতিহাসে বিস্ময়করভাবে জেগে আছে আরেকটি সত্য। প্রতিরোধ। না, এই প্রতিরোধ কোনও তত্ত্ব, কোনও মতাদর্শ শেখায়নি তাদের। জীবন শিখিয়েছে। যে জীবনে ক্ষয়, শোক পেরিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টাটুকুই সব। নিজের ঘরবাড়ি, জন্মভূমি, প্রিয়জনের মুঠো আর স্বল্প রসদটুকু আঁকড়ে থাকা। জায়নবাদী আর তাদের যুদ্ধসঙ্গীরা একে বলেছে ‘সন্ত্রাস’। এত পেষণ, নিপীড়ন আর বোমাধ্বস্ত বাস্তবতার পরেও নতজানু না হয়ে বেঁচে থাকাটাই সন্ত্রাস! ইজরায়েল রাষ্ট্র আর তাদের অনুগত সংবাদমাধ্যম তেমনটাই বলে। সবলেরা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তুলনামূলক দুর্বলের ওপর। তারপর দুর্বল যখন যুদ্ধভারে হাঁসফাঁস করতে করতে পাল্টা লড়াই দেয়, তাকে দেগে দেওয়া হয় ‘সন্ত্রাস’ শব্দে। সবল সেই সন্ত্রাস থামাতে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ চাপায়। ক্ষমতাশালী যুদ্ধবাজ সবসময়েই চায় তাদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে বিনা প্রতিরোধে বিপক্ষ পরাজয় স্বীকার করে নিক। বিজিতরা অধিকার ভুলে যাক। জন্মভূমির স্বপ্ন ভুলে যাক। প্রজন্মান্তরে বয়ে আসা গল্প, কবিতা ভুলে যাক। স্থিতি ছেড়ে, স্মৃতি ছেড়ে পালাক তারা, পালাক। যদি তা না হয়, তাহলে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয় যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র। প্রতিরোধে অমরত্বের স্বাদ পেতে যদি ভিটেমাটি আর যাপন আঁকড়ে থাকে প্রতিস্পর্ধী সত্তা, তাহলে আর্থ-সামাজিক অবরোধ বাড়িয়ে তোলে দখলদার। নিরন্তর যুদ্ধ আর মাঝে মাঝে যুদ্ধবিরতির মৌতাত উপভোগ করে পেষণ বাড়াতে থাকে।
আরও পড়ুন: অজস্র নদী এসে মিলছে স্বাধীনতার সমুদ্রে
২.
‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দটি ক্ষমতাশালী যুদ্ধবাজ ইজরায়েলের হাতের মোয়া। এক অশ্লীল আমোদ। যুদ্ধ শুরুও হয় তাদের ইচ্ছেয়, যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়াও তাদেরই ইচ্ছেয়। ফিলিস্তিনিদের ভূমিকা অবজ্ঞাযোগ্য। দখলদার ইজরায়েল রাষ্ট্র ঠিক করে নিয়েছে ‘ফলস ফ্ল্যাগ অফ ওয়ার’ দেখিয়ে কখন যুদ্ধনিনাদ গাঢ় করে তুলবে। অথবা কোনও ফিলিস্তিনির নিজের জন্মভূমিতে ফেরার চেষ্টাকে কখন আক্রমণ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে। ফিলিস্তিনিদের বসতি ছেড়ে না-পালানোর জেদকে কখন সন্ত্রাস বলে ঘোষণা করা হবে। ইজরায়েল রাষ্ট্র আর তাদের তাঁবেদার সংবাদমাধ্যম নিখুঁত উপায়ে এই কাজটিই দশকের পর দশক করে চলেছে। তারপর অবশ্যম্ভাবী ‘যুদ্ধ’। ফিলিস্তিনি বনাম জায়নবাদীদের দ্বন্দ্ব অবশ্য ঠিক যুদ্ধ নেই আর। এ নিছকই গণহত্যা। ‘যুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যাতে ইজরায়েলের আক্রমণ আর দখলদারিকে একটু হলেও ন্যায্যতা দেওয়া যায়। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র আর সমরকৌশলে গাজা স্ট্রিপকে যখন তারা ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে ফেলবে, তখন ‘যুদ্ধবিরতি’-র আবেদনপত্র জমা পড়বে। এতে জায়নবাদীদের অহং সার-জল পাবে। দখলদারি অহংয়ে তেল মালিশ হবে। বাকি বিশ্বকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে ফিলিস্তিনিদের পিষে মারা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তারা জানে ফিলিস্তিনিরা কিছু রসদ, কিছু ত্রাণ, কিছু যোগাযোগ আর অনেকটা সহানুভূতি পাবে বহির্বিশ্ব থেকে। প্রতিবেশী দেশ থেকে ত্রাণ, চিকিৎসা সামগ্রী, জল সরবরাহ হবে। ইজরায়েল রাষ্ট্র শক্ত মুঠো আলগা করবে। দয়া, করুণা। এই অমানবিক খেলায় ফিলিস্তিনিদের আরও কয়েকদিন বাঁচার সুযোগ দেওয়া মাত্র। তারপর দখলীকৃত ভূখণ্ডকে ‘ঈশ্বরপ্রতিশ্রুত’ বলে ন্যায্যতা দিয়ে ইজরায়েল রাষ্ট্র নতুন উদ্যমে গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতিগত গায়েব অভিযান চালাবে। আবার বন্ধ করে দেওয়া হবে ত্রাণ এবং যোগাযোগ। আরেকটু দখল বাড়িয়ে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনির ভূমি কেড়ে নেওয়া হবে। এই তো জায়নবাদী নীতি। একবার। বহুবার। নিরন্তর। আদতে যুদ্ধবিরতি না, গণহত্যাবিরতি। এই বিরতিটুকুতে পরবর্তী সমরনীতি ছকে ফেলা যায়, বন্ধুশিবির গুছিয়ে নেওয়া যায় এবং আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এঁচে নেওয়া যায়। তবু, যে কোনও যুদ্ধে বহু ক্ষয়ক্ষতির পরে ‘যুদ্ধবিরতি’ প্রয়োজনীয় মানবিক শর্ত। মহাকাব্যেও সেই উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুদের কর্তৃত্বের যুগে সেই মানবিকতাও দুর্লভ। বন্দিবিনিময় আর শোকপালনের যুদ্ধবিরতির অবসর দিতে নারাজ ছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনিদের যৎসামান্য ভূখণ্ড জবরদখলে এবং উন্মত্ত বিজয়োল্লাসে সামান্য বিরতিও তাঁর না-পসন্দ। জাতিপুঞ্জের আবেদনে কয়েকদিনের দখলবিরতি ‘দিলেন’; কিন্তু ঘোষণা করে রাখলেন দখলাভিযান চলবেই। পরবর্তী সন্ত্রাসের প্রস্তুতি নিতে সমরকৌশলের ফাঁকফোকর ঢাকতে এটুকু সময় দরকার ছিল হয়তো নেতানিয়াহুদের।
আর, দশক দশকান্তরে গণহত্যার শিকার হওয়ার বিরতিতে ফিলিস্তিনিরা কী করেন? সন্তানের হাতে তার নাম লিখে রাখেন, যাতে মৃতদেহের ভিড়ে তাকে শনাক্ত করা যায়। ষাটোর্ধ্ব তাহানি আল-নাজার নিজের গুঁড়িয়ে যাওয়া বাড়ির ইট-কাঠ-পাথর সরিয়ে কয়েকটা কাপ অক্ষত খুঁজে পেয়েছিলেন। বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কারণ ওই কাপগুলো যারা ব্যবহার করতেন, সেই আত্মজনরা ইজরায়েলি শেলের আঘাতে সদ্য মারা গেছেন। অনেকে লাইনে দাঁড়ান। সারাদিন। রান্নার গ্যাস ভরানোর জন্য। ভাঙা আসবাব আর ধ্বংস্তূপ থেকে কুড়নো ইট-পাথরে ঘর তুলতে ব্যস্ত অনেকে। কেউ কেউ টমেটো, লেবু, তরমুজ, অলিভের পসরা সাজিয়ে বসেন। ২০২১ সালে আব্দেলকরিম ওয়াহদান ইজরায়েলি বিমানের বোমাবর্ষণ পেরিয়ে তরমুজ-খেত-এ যেতে পারেননি। উত্তর গাজার বেইট হানুন। যুদ্ধবিরতিতে গিয়ে দেখেছিলেন সব তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে চাষের জমিতে ইজরায়েলি ট্যাঙ্ক ঢুকে তছনছ করে দিয়েছিল, সামান্য কিছু বাঁচাতে পেরেছিলেন। আব্দেলকরিম ২০২২-এর শেষে নিজের জমিতে সোলার প্যানেল লাগিয়েছিলেন। দক্ষিণ গাজার আবু মহম্মদ ইজিপ্ট থেকে আসা সেচের আধুনিক পাইপ পেয়েছিলেন। এক একর জমিতে আঙুরের দারুণ ফলন হচ্ছিল। বেজায় খুশি ছিলেন তাঁরা। প্যালেস্তাইনের কৃষিমন্ত্রক ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিল প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার একর জমিতে অলিভ, খেজুর, শাক-সবজির ফলন ভালো হচ্ছে এই মরশুমে। নভেম্বরের যুদ্ধবিরতিতে আব্দেলকরিম, আবুরা দেখবেন আবারও হয়তো তছনছ হয়ে গেছে সব। সামান্য বেঁচে থাকা ফলের পসরা সাজাবেন হয়তো পথের ধারে। কেউ ফুল সাজিয়ে বসবেন। ধ্বংস আর শোকের স্বল্প বিরতিতে একটু রঙিন যদি করে তোলা যায় চারপাশ। কোনও পরিবার মুর্দাঘর আর হাসপাতালে দৌড়োয়। স্বজনের শ্বাসের শব্দ শোনা যায় যদি। না-হোক তার দেহের খোঁজ মেলে যদি। যুদ্ধবিরতি স্বজনের লাশ আর শোকাবহে ভারী হয়ে আছে সেই মহাকাব্যের যুগ থেকে। অ্যাকিলিস টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছিল প্রবলপ্রতাপ শত্রু হেক্টরের মৃতদেহ। প্রতিশোধান্তে বীভৎস উল্লাস তার মুখেচোখে। রাজা প্রায়াম যুদ্ধবিরতির কাতর ক্ষণে অ্যাকিলিসের সামনে নতজানু হয়েছিলেন; সন্তান হেক্টরের দেহ ভিক্ষা করেছিলেন। উদ্ধত অ্যাকিলিসের ক্রোধ শান্ত হয়েছিল, প্রায়ামের চোখের জলে শুধুই বিষাদবিধুরতা, যুদ্ধময় মহাকাব্যের এক মানবিক ক্ষণ। যুদ্ধবিরতির শোকাবহে শেষকৃত্য পালন হয়েছিল হেক্টরের। তবে, গ্রিস বনাম ট্রয়ের সঙ্গে ইজরায়েল বনাম প্যালেস্তাইনের ফারাক প্রচুর। পেট্রোক্লুসের হত্যার বদলা নিতে অ্যাকিলিসের দারুণ ক্রোধ আছড়ে পড়েছিল হেক্টরের ওপর। জায়নবাদীরা কীসের বদলা নিচ্ছেন ফিলিস্তিনিদের ওপরে? ইউরোপের বিভিন্ন প্রদেশে বারবার ইহুদিরা বিপর্যস্ত হয়েছে, তারা ‘শোয়া’-র (হিব্রু শব্দটির সমার্থক শব্দ ‘নাকবা’) সম্মুখীন হয়েছে। তথাকথিত সভ্য ইউরোপীয় জাতিরা তার জন্য দায়ী। ফিলিস্তিনিদের তাতে কোনও ভূমিকা নেই। বরং, আরব দুনিয়ায় তথা প্যালেস্তাইনেও ইহুদিদের সহাবস্থান ছিল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে। বিশ্ব আর্থ-রাজনীতির মহানিয়ন্ত্রাদের অদ্ভুত মন্ত্রবলে জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের শত্রু ঠাউরে নিল। ইজরায়েল রাষ্ট্রের সন্ত্রাসে ‘ইহুদি বনাম মুসলমান’ এক সযত্ননির্মিত প্রতর্ক মাত্র; অর্থনৈতিক দখলদারি আর পুঁজিনিয়ন্ত্রাদের ফায়দাই প্রচ্ছন্ন কারণ। তাই দখল, সন্ত্রাস আর মারণাস্ত্র আছড়ে পড়ল ফিলিস্তিনিদের ওপর। ট্রয় বনাম গ্রিসের সঙ্গে এ যুদ্ধের পার্থক্য তো আছেই। তবে, মহাকাব্যের সঙ্গে এই চলমান যুদ্ধের সাদৃশ্য শোকমিছিলে। যুদ্ধবিরতিতে সন্তানের লাশ অথবা আত্মজনের ছিন্নভিন্ন দেহ অথবা অপরিচিত শিশুর বিকৃত মৃতদেহ ঘিরে জমে ওঠা গাঢ় শোকে। ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মহম্মদ ওমের ‘শেল-শকড: ডিসপ্যাচেস ফ্রম আ ওয়র’ বইতে লিখেছেন ফৌয়াদ জাবেরের কথা। গাজার একজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। ২০১৪ সালে গাজার শেজাইয়াতে হতাহতদের উদ্ধার করছিলেন। বহু আহতকে উদ্ধার করেছিলেন ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে। ইজরায়েলি সেনার ছোড়া মর্টারে অ্যাম্বুলেন্সের গা তুবড়ে গেছিল অনেকটা, তবু ভাঙা অ্যাম্বুলেন্স নিয়েই মৃত্যু থেকে জীবনের সাঁকো গড়ে নিচ্ছিলেন জাবের। এক আগুন-জ্বলা সকালে একটি ভাঙা বাড়ি থেকে আহত শিশুকে উদ্ধারের জন্য এগোতেই ইজরায়েলি শেল তাঁর জীবন কেড়ে নেয়। ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মহম্মদ ওমের লিখেছেন, “জাবেরের পরিবার এই পাঁচদিনের যুদ্ধবিরতিতে এখন শোকজ্ঞাপন করতে পারছে। একমাস আগে নিহত হয়েছে জাবের অথচ নিরবচ্ছিন্ন হামলায় আর ধ্বংসস্তূপের আবহে কোথাও শোকপালনের শান্তিটুকুও ছিল না। জুবেরের বাবা-মা, স্ত্রী আর দু’বছরের মেয়ে হালা একমাস পরে শোকযন্ত্রণা অনুভবের স্থিতি পেল।” প্যালেস্তাইনের শিক্ষা মন্ত্রক ২০২৩-’২৪ শিক্ষাবর্ষ বাধ্যত বাতিল ঘোষণা করেছে। কয়েক হাজার ইশকুল পড়ুয়া শিশু মৃত এবং আরও কয়েক হাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ। ইশকুল বাড়িগুলির অস্তিত্ব নেই। গণনিহত হওয়ার বিরতিতে রুওয়াইদা আমেরের মতো কোনও শিক্ষক নিখোঁজ আর মৃত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শোকনিবন্ধ লিখেছেন। অক্টোবরের শুরুতে তাঁর ক্লাসে বসে এক শিশুপড়ুয়া লিখেছিল, ‘আপনি কী ভাল বোঝান। আপনার গলার আওয়াজ কী মিষ্টি, ম্যাম! ভগবান আপনার ভাল করুন।’ রুওয়াইদা বিপর্যয়ের বিরতিতে সেই সব স্মরণ করে ইজরায়েলি সন্ত্রাস বন্ধের প্রার্থনা করেছেন।
৩.
গণনিহত হওয়ার বিরতিতে ফিলিস্তিনিরা শোকপালনের অবসর পান। তাঁরা ঘরে ফেরেন, যে ঘরের দেওয়াল আর ছাদ ভেঙে পড়ে গেছে। তাঁরা প্রিয়জনের কাফন কেনেন, মৃতদেহ সমাধিস্থ করেন। পোষা অবলা প্রাণী, বাধ্যত যাকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল, তার চিহ্ন খুঁজতে আসেন। ওমের লিখেছিলেন আব্দেসালাম আল-এসসির কথা, যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হওয়া মাত্র তিনি নৌকায় ছুটে গেছিলেন। মাছ ধরা ছাড়া কোনও জীবিকা জানেন না তিনি। ধারকর্জ্জে ডুবে আছেন, ইজরায়েলি অবরোধে মাছধরা বন্ধ, স্বজন হারানোর শোকে বুক ভারি হয়ে আছে, তবু আব্দেসালাম ভাঙা নৌকোর কাছে ফেরেন। গণহত্যা আপাতত থেমেছে, কিছু যদি আয়পয় হয়। নিহত মিছিল থেকে পরের হত্যাযজ্ঞ শুরুর মাঝের অবসরে ফিলিস্তিনিরা দেশ এঁকে নেন। গুগল ম্যাপে সে দেশ নেই। সবচেয়ে শক্তিশালী গণমাধ্যম আর প্রচারসংস্থার আঁকা মানচিত্রে সেই দেশ গায়েব। তবু সেই দেশ তাঁরা খুঁজে নেন বিরতির সময়টুকুতে। এও এক আশ্চর্য বটে। প্রিয়জনের বুকের ছ্যাঁদা থেকে বুলেট বের করে কবিতায় পাল্টে নেন। শিশুর ঝলসে যাওয়া মুখে কোনও মুখফেরতা গানের নতুন বাক্য জুড়ে নেন। দেওয়ালে এঁকে রাখেন হার না-মানার ছবি। লিখে রাখেন দেশের ভেতর বেভূম হওয়ার ব্যথা। হারিয়ে যাওয়া দেশের কথা। ১৯৮০-র এক যুদ্ধবিরতিতে রামালায় চিত্রশিল্পীদের ওপরে নিষেধাজ্ঞা করেছিল ইজরায়েল রাষ্ট্র। প্যালেস্তাইনের পতাকা আঁকা যাবে না। লাল, সবুজ, কালো আর সাদা রঙের ফুল ফোটালে তাও নাকি বাজেয়াপ্ত হবে! চিত্রশিল্পী ইসাম বাদরলকে অপমান করে ইজরায়েলি সেনা অফিসার বলে, ‘তরমুজ আঁকলেও সেটা বাজেয়াপ্ত করব আমরা।’ সত্যিই সেই সময় কয়েকজন যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল রাস্তায় দাঁড়িয়ে তরমুজ খাওয়ার জন্য। কারণ প্যালেস্তাইনের পতাকার লাল-সবুজ-কালো-সাদার সঙ্গে তরমুজের রঙের সাদৃশ্য জায়নবাদীদের চক্ষুশূল ছিল। ২০২১ সালের যুদ্ধবিরতির সময় প্রকাশ্যে প্যালেস্তাইনের পতাকাধারীদের ওপর আক্রমণ নামায় ইজরায়েলি সেনা। তখন তেল আভিভে বসবাসকারী কিছু আরব-ফিলিস্তিনি এঁকে দেন কাটা তরমুজের ছবি। নিচে লেখা– ‘এটা প্যালেস্তাইনের পতাকা না’। ফিলিস্তিনিদের জীবনে কোনও প্রকৃত যুদ্ধবিরতি নেই। তাঁদের দেশ বধ্যভূমি। হয় মৃত্যু নয় আমৃত্যু প্রতিরোধ। জায়নবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে সমস্ত সত্তা দিয়ে অংশ নিতেই হয় তাঁদের। প্রতিরোধের নিত্যনতুন আঙ্গিক খুঁজে নিতে হয়। তাঁরা জানেন, এমনটাই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে গেছে। ২২ বছরের মাহা জারাবা বলেন প্রতিদিন যুদ্ধে বিধ্বস্ত হতে হতে কবিতাই একমাত্র মুক্তির স্বাদ দেয়। যখন ইজরায়েলি বোমা পড়ে, মাহা লেখেন। যখন স্বজনের মৃত্যুর খবর পান, মাহা লেখেন। দেশের কথা লেখেন, সহনাগরিকদের কথা লেখেন। মাহা জানালার ভাঙা কাচ, শিশুর কান্না আর একফালি জানলা চুঁয়ে আসা রোদের কবিতা লেখেন।
না, যুদ্ধবিরতি কোনও সমাধান না। যুদ্ধ চিরতরে বন্ধ করে ফিলিস্তিনিদের হকের ভূমি ফিরে পাওয়াই একমাত্র সমাধান। ইজরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ আর যুদ্ধবিরতির অশ্লীল আমোদ আর কতদিন চলবে? আপাতত যে গণহত্যাবিরতি চলছে, তাতে বন্দিবিনময় হয়েছে। দু’দেশে ত্রাণ এবং রসদ পৌঁছেছে। কিন্তু অনতিবিলম্বে আবার যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চলেছে ইজরায়েল। দেশের ভেতরে দেশ গড়ে ক্রমে কমে আগ্রাসন বাড়িয়ে প্যালেস্তাইনকে মুছে ফেলার যে মানবেতর ‘খেলা’ তারা শুরু করেচ্ছিল, তা চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। তবু যতদিন প্যালেস্তাইনে একজন ফিলিস্তিনিও বেঁচে থাকবেন, যতদিন জন্মভূমি-ভিটেমাটি আঁকড়ে থাকার তিলমাত্র মনের জোরও থাকবে, ততদিন প্রতিরোধ চলবে। সাগর থেকে নদী– হকের ভূমি ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিস্পর্ধা।
এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কোথাও কাজ করছিল 'পথ' শব্দটা। বিভূতিভূষণেরপথের পাঁচালী উপন্যাস ছিল জীবনের কঠিন লড়াইয়ের মধ্যেও হরিহরের স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার গল্প। নায়ক-এ অরিন্দম তার জীবনের যে গল্প অদিতিকে বলতে বলতে যাবে, তা-ও তো জীবনের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে আর এক স্বপ্ন দেখার গল্প, যেন বা আর এক পথের পাঁচালীই।