সাংবাদিক বৈঠকে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী জানিয়েছেন, এবার তাঁরা রাজ্যের সবক’টি সুড়ঙ্গের সুরক্ষা ‘অডিট’ করবেন। ধামীর এই কথাটি বলার জন্য এত বড় একটি সুড়ঙ্গ দুর্ঘটনার প্রয়োজন ছিল। উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর আবেগতাড়িত উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী যে-কথাটি বলেছেন, সেটি কতদূর রক্ষা করা হবে, তা সময়ই একমাত্র বলতে পারবে।
উত্তরকাশীর সিলকিয়ারায় ১৭ দিন ধরে যে উদ্ধার-কাজ গোটা বিশ্ব দেখল, তা দেশের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম। সোশাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় সেই গণসংগীতের লাইনটি ঘুরছে, ‘আমি মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী, জন হেনরি বলে বুক ঠুকে’।
সিলকিয়ারার সুড়ঙ্গে উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাংবাদিক বৈঠকে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী জানিয়েছেন, এবার তাঁরা রাজ্যের সবক’টি সুড়ঙ্গের সুরক্ষা ‘অডিট’ করবেন। ধামীর এই কথাটি বলার জন্য এত বড় একটি সুড়ঙ্গ দুর্ঘটনার প্রয়োজন ছিল। উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর আবেগতাড়িত উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী যে-কথাটি বলেছেন, সেটি কতদূর রক্ষা করা হবে, তা সময়ই একমাত্র বলতে পারবে।
উত্তরকাশীর সিলকিয়ারায় ১৭ দিন ধরে যে উদ্ধারকাজ গোটা বিশ্ব দেখল, তা দেশের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম। সোশাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় সেই গণসংগীতের লাইনটি ঘুরছে, ‘আমি মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী, জন হেনরি বলে বুক ঠুকে’। সিলকিয়ারাতে ছেনি-হাতুড়িরই জয় হয়েছে। পাথর খননের জন্য আনা অত্যাধুনিক তিনটি মার্কিন যন্ত্রই বিকল হয়ে পড়ে। শেষরক্ষা হিসেবে ‘র্যাট হোল মাইনার’দের হাতই ছিল ভরসা। উদ্ধারকাজের শেষে দেশবাসীর সামনে যে ছবি উঠে এল, তাতে বার্তা এটাই যে মানুষের কাছে আজও পরাজিত যন্ত্র। জাতীয় পতাকা হাতে হেলমেট পড়া উদ্ধারকারীরা গ্রুপ ছবি তুলেছেন। অতীতের খনি শ্রমিকদের স্মৃতি উসকে উঠেছে। রাহুল গান্ধী তাঁর টুইটারে লিখেছেন, ‘এঁরাই ভারতকে নির্মাণ করছেন’। কেউ কেউ এঁদের উদ্দেশে বলছেন, ‘ওরা কাজ করে’।
আরও পড়ুন: সুড়ঙ্গের নিচে শ্রমিকরা, উপরে অঢেল উৎসব
সিলকিয়ারার আরও একটি ছবি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, উদ্ধারকাজের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিস্ক সুড়ঙ্গের মুখে বাসুকিনাগের মন্দিরে হাতজোড় করে প্রার্থনা করছেন। তাহলে বিশ্বাসের কাছে কি পরাস্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি? এমন পোস্ট ঘুরছে সমাজমাধ্যমে। দুর্ঘটনার পর অস্থায়ীভাবে মন্দিরটি নাকি স্থানীয় মানুষই বানিয়েছেন। এলাকার মানুষের বিশ্বাস, পাহাড়ে যেভাবে খননকার্য চলছে তাতে বাসুকিনাগ রুষ্ট। সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের এই ১৭ দিনে নিশ্চিতভাবে একটি উপলব্ধি যেন সর্বত্র কাজ করছে, উন্নয়ন ও যন্ত্রের দাপাদাপিতে কোথাও যেন প্রকৃতি বিরূপ। সেই কারণেই কি ছেনি ও হাতুড়ি দিয়ে পাহাড় খুঁড়ে ৪১ জনকে উদ্ধারের পর যন্ত্রের পরাজয় নিয়ে এত উচ্ছ্বাস!
সিলকিয়ারার ঘটনা থেকে আমরা প্রকৃতির রোষ নিয়ে কতটা শিক্ষা গ্রহণ করলাম, এখন প্রশ্ন সেটাই। এই ক’দিনে সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গিয়েছে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, যমুনোত্রী ও গঙ্গোত্রীর সংযোগকারী চারধাম সড়ক প্রকল্পে উত্তরাখণ্ডে ৬০০ হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে। মোট ৫৬ হাজার গাছ কাটা পড়ছে। সব ঋতুতে চলাচল করা যাবে এমন দু’লেনের ১২ মিটার চওড়া মেটাল রোড নির্মাণের জন্য পাহাড়ে মোট ২ কোটি টন মাটি কাটা হচ্ছে। ইচ্ছেমতো ভাঙা হচ্ছে পাহাড়ের গা। এই প্রকল্পের কাটা মাটি ও নির্মাণসামগ্রী ফেলা হচ্ছে গঙ্গা ও যমুনার বুকে। পাহাড়ে নদীখাত বুজিয়ে দিলে যে কী বিপর্যয় হয়, তা ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডেই প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। ভাগীরথী থেকে নেমে আসা হড়পা বানে পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
আরও পড়ুন: ভারত সুড়ঙ্গে আটকে, তীর্থযাত্রায় পুণ্যলাভ রাজনীতির
পাহাড়ের সবুজ ধ্বংসের পরিণতি কী হতে পারে, সম্প্রতি তার নিদর্শন মিলেছে সিকিমেও। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য তিস্তার বুকে তৈরি ব্যারেজ হ্রদ ফাটা জলে নিশ্চিহ্ন হয়ে ভাসিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। উন্নয়নের নামে হিমালয় পর্বতজুড়ে চলছে সবুজ ধ্বংসের লীলা। হিমালয়ে পরিকল্পনাবিহীনভাবে সবুজকে ধ্বংস করে চললে যে ধস, হড়পা বান ইত্যাদি থেকে মুক্তি নেই, তা বুঝতে কেন সমস্যা হয়, সেটা বোধগম্য নয়। হিমালয় নবীন পর্বতমালা। পাথরের বুকে এখনও প্রচুর জল ও মাটি। তাই রাস্তা, সেতু, সুড়ঙ্গ, ব্যারেজ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি করার আগে বিচার করা দরকার পাহাড়ের সেই অংশের ধারণ ক্ষমতা কত? পাহাড়ের মাটি কি নির্মাণের সেই চাপ নিতে পারবে, তা সবার আগে দেখা দরকার। একটি প্রকল্পের জন্য পাহাড়ের সবুজ কতটা ধ্বংস হবে, সেটাও বিচার করা দরকার। সবুজ ধ্বংস হওয়ার ফলে হিমালয়ে গরম বেড়ে চলেছে ধারাবাহিকভাবে। যার পরিণতিতে হিমবাহ গলতে দেখছি। হ্রদ ফাটতে দেখেছি।
চারধাম সড়ক প্রকল্পের ধাপে ধাপে পরিবেশের ওপর এর কী প্রভাব, তা নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা হয়নি বলেই এখন জানা যাচ্ছে। বস্তুত, বৈজ্ঞানিক উপায়ে পাহাড়ের মাটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পরিবেশের ওপর প্রভাব সঠিকভাবে বিচার করলে কোনও প্রকল্পেরই ছাড়পত্র পাওয়ার কথা নয়। পাহাড় ঘিরে পর্যটনশিল্পের বিকাশলাভের সম্ভাবনা বিপুল। কিন্তু বাণিজ্যের লোভে চালিত হয়ে এইভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করলে তার মূল্য চোকাতেই হবে। প্রাণের বিনিময়েই সেই মূল্য দিতে হবে। এ যাত্রায় সুড়ঙ্গ থেকে ৪১ জন শ্রমিক সুস্থভাবে উদ্ধার হয়েছেন। বারবার তা হবে না। হিমালয়ে প্রকৃতির ধ্বংসলীলা চলতে থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। হেনরির হাতুড়ির সুরও কিন্তু স্তব্ধ হয়েছিল পাথুরে পাহাড়ের গায়ে। পাহাড়ের বুকে কান পেতে হেনরির হাতুড়ির সুর যাঁরা শুনতে চাইলেন, তাঁদের একথাও মনে রাখতে হবে।