জোরকদমে চলছে প্রচার। ভোটারদের মন জয়ে প্রকাশিত হয়েছে কোনও দলের ‘সংকল্পপত্র’, কোনও দলের ‘ন্যায়পত্র’ নামে গালভরা ইস্তাহার। কিন্তু কারও সংকল্পে পরিবেশের কথা নেই। প্রকৃতি ধ্বংসের মতো অন্যায়ের প্রতিবাদে হিরন্ময় নীরবতা প্রায় সমস্ত দলের ইস্তাহারেই। পরিবেশের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বহু রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে ঠাঁই পায় না। নির্বাচনী মহোৎসবে ব্রাত্য পরিবেশ। কোনও দলই বুক ঠুকে ‘জলাভূমি বাঁচাব’, ‘বেআইনি নির্মাণ রুখব’, ‘বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ রুখব’, ‘গঙ্গায় বর্জ্য ফেলা ঠেকাব’ বলতে পারে না। এ বিষয়ে শাসক-বিরোধী কারও তফাত নেই!
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
‘রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ বেলার এক দিন। রাঢ়ের শুকনো দুরন্ত গ্রীষ্মের অপরাহ্নবেলায়, এ অঞ্চলের লাল ধূলা-মাটি-কাঁকড়ের সঙ্গে, পড়ন্ত রৌদ্রও যেন রক্তে লাল… রাঢ়ের এই রুক্ষ রক্তমৃত্তিকা অঞ্চলে ঘাম হয় না। বাতাস যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন গা জ্বালা করে।’ সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরে’ শুরু হয়েছিল এইভাবেই।
আর আমরা ফিরে দেখছি– শুধু রাঢ় বাংলাই নয়, কার্যত গোটা রাজ্যেই চৈত্র-বৈশাখ মাসে একই পরিস্থিতি, গায়ে জ্বালা ধরানো গরম। গ্রীষ্মের দাবদাহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কলকাতায় ৭০ বছরের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে। জয়সলমেরও পিছিয়ে কলাইকুণ্ডার থেকে। সোশাল মিডিয়ায় ‘মিম’-এর বন্যা। আপামর সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি রব! এর মধ্যেই জানা গেল, দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, কর্নাটক, কেরল এবং তামিলনাড়ু ভয়াবহ জল সংকটের সম্মুখীন। সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের (সিডব্লিউসি) তথ্য অনুসারে, এই রাজ্যগুলিতে জল সঞ্চয়ের স্তর জলাধারের ধারণক্ষমতার ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, কাশ্মীর থেকে শুরু করে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশের মতো পাহাড়ি রাজ্যে একের পর এক ভূমি ধস, হড়পা বান, বন্যার মতো বিপর্যয় ঘটছে অহরহ। একই অবস্থা অরুণাচল প্রদেশ, সিকিমেও।
অপরিকল্পিত নগরায়নের জেরে সাম্প্রতিক সময়ে আমেদাবাদ, মুম্বই, হায়দরাবাদ, চেন্নাই এবং বেঙ্গালুরুর মতো শহরগুলি ভারী বৃষ্টিপাতের সময় বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। গত ৩০ বছরে ভারতে জলাভূমি কমেছে ৪০ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে দিল্লিতে জলাশয় ছিল ১,০০০টি। ২০২৩ সালে তা নেমে এসেছে ৭০০-তে! সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে ‘টর্নেডো’ হয়েছে। যা কার্যত বেনজির। এর আগে দক্ষিণবঙ্গে দু’-একটা জায়গায় স্থানীয়ভাবে ‘টর্নেডো’ হলেও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী, দুর্বল। কিন্তু উত্তরবঙ্গে তা কার্যত বেশ কয়েকটি গ্রামকে তছনছ করে দিয়েছে। উত্তরবঙ্গে ‘টর্নেডো’র কারণ একটাই– ব্যাপক পরিমাণে বৃক্ষচ্ছেদন। প্রকৃতি ধ্বংস করে ব্যাপক নগরায়ন হয়েছে। জলাশয়, পুকুর বোজানো থেকে সবুজ নিধন, কিছু বাকি নেই। তার ফল ভুগছে জনতা। বাড়ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। বড় বড় শহরে বায়ুদূষণ ব্যাপক আকার নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এর ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ-সহ অন্য রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের ক্যানসার, ছানি, নিউমোনিয়া, গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের সমস্যা, ডায়াবেটিস, স্নায়ুর রোগও। অথচ আমরা এখনও ‘চোখ থাকতেও দৃষ্টিহীন’।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
উত্তরবঙ্গে ‘টর্নেডো’র কারণ একটাই– ব্যাপক পরিমাণে বৃক্ষচ্ছেদন। প্রকৃতি ধ্বংস করে ব্যাপক নগরায়ন হয়েছে। জলায়শ, পুকুর বোজানো থেকে সবুজ নিধন, কিছু বাকি নেই। তার ফল ভুগছে জনতা। বাড়ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। বড় বড় শহরে বায়ুদূষণ ব্যাপক আকার নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এর ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ-সহ অন্য রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের ক্যানসার, ছানি, নিউমোনিয়া, গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের সমস্যা, ডায়াবেটিস, স্নায়ুর রোগও। অথচ আমরা এখনও ‘চোখ থাকতেও দৃষ্টিহীন’।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এই আবহেই দেশে চলছে লোকসভা ভোটের প্রক্রিয়া। সাজ সাজ রব সব রাজনৈতিক দলে। জোরকদমে চলছে প্রচার। ভোটারদের মন জয়ে প্রকাশিত হয়েছে কোনও দলের ‘সংকল্পপত্র’, কোনও দলের ‘ন্যায়পত্র’ নামে গালভরা ইস্তাহার। কিন্তু কারও সংকল্পে পরিবেশের কথা নেই। প্রকৃতি ধ্বংসের মতো অন্যায়ের প্রতিবাদে হিরন্ময় নীরবতা প্রায় সমস্ত দলের ইস্তাহারেই। পরিবেশের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বহু রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে ঠাঁই পায় না। নির্বাচনী মহোৎসবে ব্রাত্য পরিবেশ। কোনও দলই বুক ঠুকে ‘জলাভূমি বাঁচাব’, ‘বেআইনি নির্মাণ রুখব’, ‘বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ রুখব’, ‘গঙ্গায় বর্জ্য ফেলা ঠেকাব’ বলতে পারে না। এ বিষয়ে শাসক-বিরোধী কারও তফাত নেই! বিধানসভা ভোটের আগে বামফ্রন্ট বা তৃণমূলের ইস্তাহারে অবশ্য এ বিষয়ে কিছুটা নজর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেশের সরকার গঠন করতে যারা মূল যুযুধান প্রতিপক্ষ, তাদের এ বিষয়ে বিশেষ হেলদোল দেখা যায়নি। এখনও যে কোনও রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে ‘পরিবেশ’ আদতে একটা ‘ফুটনোট’ মাত্র। মন্দের ভালো, যত ভোট পাবেন, ততগুলি গাছ লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ঘাটালের তৃণমূল প্রার্থী দেব। আশা করা যায়, তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। যদিও পরিবেশ নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবনাচিন্তা করা বা প্রতিশ্রুতি পূরণে দায়বদ্ধতা দেখানো, এখনও অনেক পথ চলা বাকি।
যেমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধি ২০১৬ লঙ্ঘন করে গোটা রাজ্যে, দেশেও নিষিদ্ধ প্লাস্টিক বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। সচেতনতা নেই। কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে তা রোখার উদ্যোগই বা কোথায়? বিভিন্ন রাজ্যে ভূগর্ভের জল স্তর ক্রমশ বিপজ্জনকভাবে নেমে যাচ্ছে। তার পরও চাষ, কলকারখানা ও বহুতলে যথেষ্ট পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল তোলা হচ্ছে। রাস্তা চওড়া করার নামে, সেতু তৈরি করতে গিয়ে, মেট্রো রেলের প্রকল্পে, আবাসন তৈরিতে লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। যার জেরে ব্যাপকভাবে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন শুভেন্দু দাশগুপ্ত-র দেওয়াল লেখার কথা: আন্দোলনের চিহ্ন যে দেওয়াল লেখারা, তাদের মুছে দেওয়া হয়েছে
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বই আজ উষ্ণায়নের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু তা নিয়ে হেলদোল নেই বিশ্বনেতাদের। ২০১৫ থেকে ২০২২, বিশ্বব্যাপী রেকর্ড অনুযায়ী উষ্ণতম আটটি বছর। যে রেকর্ড এবার ভেঙে যেতে পারে। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বিশ্বের শিল্পোন্নত ও বেশি পরিমাণে কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলি তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করছে না।
কবিগুরু ভগবানের কাছে ‘প্রশ্ন’ তুলেছিলেন, ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো, তুমি কি বেসেছ ভালো?’ এখনও যদি আমরা চুপ করে থাকি, রাজনৈতিক দল তথা নীতিনির্ধারকদের প্রশ্ন না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিন্তু আমাদের ক্ষমা করবে না।