এই এত বছরে অনেক বিভাগ এসেছে। আর আসত প্রতি রবিবার নিত্যনতুন প্রচ্ছদ কাহিনি। সেই প্রচ্ছদ কাহিনি যথেষ্ট মনগ্রাহী হত, এবং এখনও হয়। বলতে দ্বিধা নেই, মাঝে কয়েকটি সংখ্যা একটু নিরাশ করেছিল। কিন্তু এখন আবার স্বমহিমায়। বিশেষ ভালো লেগেছিল ‘বন্ড’, ‘নাস্তিক’, ‘দত্ত ভুবন’, ‘রাই আমাদের’, ‘নারায়ণী সেনা’ ইত্যাদি সংখ্যাগুলি। আঠেরো, পাঠেরও সিরিজের এই লেখা পাভেল ঘোষ-এর।
‘শব্দের সন্ধানে’
বলতে অপেক্ষা রাখে না শব্দ দুটো কার লেখা। নবনীতা দেবসেনের।
‘রোববার’ পড়ার শুরু আমার এই শব্দ দুটোর টানেই। পত্রিকা স্টলে গিয়ে কাগজ ঘাঁটার একটা অভ্যাস ছিল কলেজ জীবনে প্রতি রবিবার। প্রতিটি কাগজের সাপ্লিমেন্টে থাকত আলাদা আলাদা বিষয়। তার মধ্যেই একদিন চোখে পড়েছিল ‘রোববার’ পত্রিকাটি।
আর এই শব্দ দু’টি। সেইখানেই দাঁড়িয়েই পড়া শুরু করলাম ‘ভালোবাসার বারান্দা’। তারপর যতদিন নবনীতা দেবসেন বেঁচে ছিলেন, আমাকে আষ্টেপৃষ্টে ভালোলাগার মোড়কে জড়িয়ে রেখেছিল এই কলাম।
এরপর শুরু করেছিলাম প্রতি রবিবার এই সাপ্লিমেন্টটি নিয়মিত সংগ্রহ করা এবং পড়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার বয়স বেড়েছে। সরেছে পুরনো বিভাগ, এসেছে নতুন অনেক বিভাগ। তবে জীবনের প্রথম অনেক কিছুর মতোই আজও প্রথম দিকের বিভাগগুলোই মনের বেশি কাছাকাছি।
যাঁর সম্পাদনাতে পত্রিকার পথ চলা শুরু, তাঁর কলামের কথাই বলব আগে।
‘ফার্স্ট পার্সন’। বলার অপেক্ষা রাখে না অন্য অনেকের মতো এটিই ছিল পত্রিকা হাতে আসার পর প্রথম পাঠ। লেখা কেমন ছিল, সেইটা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এত সাবলীল গদ্যের চলনে খুব কম লেখকই পারেন লিখতে। পরে বই আকারেও সংগ্রহ করেছি।
‘রোববার লাইব্রেরি খোলা’ বিভাগটি থেকে পেয়েছি অনেক নতুন বইয়ের সন্ধান। এবং তার সঙ্গে মনগ্রাহী বিশ্লেষণ সেই বইটির। বইয়ের জগৎ যে কতটা অসীম, অফুরন্ত আর বিচিত্র, তা উপলব্ধি করেছিলাম। রঞ্জনবাবুর ভাষাও ছিল সাবলীল।
আরেকটি বিভাগ আজও মনে ধরে আছে, সেইটা হল ‘গোঁসাইবাগান’। জয় গোস্বামীর গোঁসাইবাগানে ছিল বিভিন্ন কবির অমূল্য কিছু লাইন, আর ছিল সেইসব কবিতার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা l কবিতা তো অনেকটাই প্রকৃতির মতো হয়, সে শুধু তার পাঠককে দিয়ে যায় সর্বস্ব উজাড় করে, বিনিময়ে কিছুই চায় না। কিন্তু গোঁসাইবাগান কবিতার সঙ্গে আমাদের একটা অন্তহীন আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি করে, যে বন্ধন থেকে কোনও পাঠকই কোনও পরিস্থিতিতেই মুক্ত হতে পারবে না। কবিতা পড়ার অভ্যাস যাদের আছে, তারাও সন্ধান পেত এক নতুন দিগন্তের। গোঁসাইবাগানের প্রতিটা পৃষ্ঠাতেই যেন চমক ছিল। উল্লেখ করা কবিতার প্রতিটা লাইন এবং আমাদের অন্তরাত্মার মধ্যে যোগসূত্রের পথ এই বিভাগ উন্মোচিত করেছিল। কোথায় থামতে হয়, কোথায় কোন মাত্রা, কোন ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে, কোথায় কী রূপক ব্যবহার করা হয়েছে, আরও কত কিছু কত সুনিপুণভাবে তুলে ধরছেন আমাদের সামনে কবি। কিছু কবির নাম এখানে উল্লেখ করি, যেমন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মণীন্দ্র গুপ্ত, শিশির চক্রবর্তী, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শামসুল হক, মল্লিকা সেনগুপ্ত, কালীকৃষ্ণ গুহ, আরও কত।
বুঝতে পারতাম না বাগানে বিচরণ করতে করতে কখন মনের নিবিষ্ট অবস্থাতে প্রবেশ করে গেছি।
আরও কিছু প্রিয় ছিল, যেমন ‘ফুল ফল মফসসল’; ‘রাহুলের নোটবুক’ ইত্যাদি। বলে শেষ হয়তো করা যাবে না।
এই এত বছরে অনেক বিভাগ এসেছে। আর আসত প্রতি রবিবার নিত্যনতুন প্রচ্ছদ কাহিনি। সেই প্রচ্ছদ কাহিনি যথেষ্ট মনগ্রাহী হত, এবং এখনও হয়। বলতে দ্বিধা নেই, মাঝে কয়েকটি সংখ্যা একটু নিরাশ করেছিল। কিন্তু এখন আবার স্বমহিমায়। বিশেষ ভালো লেগেছিল ‘বন্ড’, ‘নাস্তিক’, ‘দত্ত ভুবন’, ‘রাই আমাদের’, ‘নারায়ণী সেনা’ ইত্যাদি সংখ্যাগুলি। বিষয়বস্তুর বৈচিত্রও অনেক।
পত্রিকার সম্পাদনার কাজটাও যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। কয়েক দশক ধরে পাঠকদের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও চিন্তা-ভাবনামূলক বিষয়বস্তু সরবরাহ করে চলেছে বলেই পত্রিকাটি বিশিষ্ট প্রকাশনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং সেই যাত্রা যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে বহমান এখনও। চিন্তাকর্ষক গল্প বলা, উপন্যাস প্রকাশ করা। স্বপ্নময় চক্রবর্তী জনপ্রিয় উপন্যাস ‘হলদে গোলাপ’ এইখানেই প্রথম পড়ি। এই উপন্যাসে তৃতীয় লিঙ্গের কথা খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। তবে প্রথম সারির অন্য কোনও পত্রিকা এই উপন্যাস প্রকাশে এগিয়ে আসত কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ‘রোববার’ সেই সাহস দেখিয়েছিল।
জটিল বিষয়কে সহজ এবং প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য ‘রোববার’-এর একটি অনন্য দক্ষতা রয়েছে, যার ফলে পাঠক ব্যাক্তিগতভাবে জুড়ে যায়। দ্রুত বিশ্বায়ন এবং নিরন্তর পরিবর্তনের যুগে, ‘রোববার’ ধারাবাহিকভাবে বিবর্তিত বিশ্বের সারমর্মকে ধারণ করার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। পত্রিকাটি রাজনীতি ও সংস্কৃতি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে। এর অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং গভীর বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে, ‘রোববার’ বিশ্বের একটি জানালা হিসাবে কাজ করে। পাঠকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিস্তৃত করে এবং আমাদের সময়ের জটিলতাগুলিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।
সময়ের নিয়ম মেনে ‘রোববার’ এখন ডিজিটালেও এসে গেছে। তাতে আমাদের মতো মানুষদের সুবিধাই হয়েছে। যে কোনও জায়গাতে বসে পড়ে ফেলা যায় এখন।
‘রোববার’ এভাবেই এগিয়ে চলুক, এই ইচ্ছা রাখি।