ফোন করে কেবল বলেছিলাম, একদিন দেখা করে কিছু কথা বলতে চাই। জিজ্ঞেস করেননি কিছু, কেবল সময় দিয়েছিলেন। অমুকদিন বিকেলবেলা, এতটার সময়। অনেকখানি ভয় আর সংকোচ নিয়ে হাজির হলাম নির্ধারিত দিন ও সময়ে। তিনি কত মস্ত মানুষ, কত বড় মাপের কবি তিনি। তাঁর সময়ের দাম মাপাও আমার সাধ্যে নেই। তেমন মানুষের কাছে নিজের এই সমস্যা নিয়ে চলে এলাম? যদি কিছু মনে করেন? যদি রুষ্ট হন?
এ-ঘটনার কথা আগেও লিখেছি হয়তো কয়েকবার। তবু মনে হয়, আরও একবার লিখলে দোষের হবে না। জীবনে এমন কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যাদের আয়ু চিরকালীন। তাই ফিরে ফিরে তাদের মনে করাটাই স্বাভাবিক, বারেবারে তাদের কথা বলতে চাওয়াটাই স্বতঃস্ফূর্ত। কেননা সেইসব মুহূর্ত থেকে, বা বলা ভাল সেইসব মুহূর্তের দৌলতেই জীবন বদলে যায়, এমনকী, মানুষও আগের মতো থাকে না আর। তাই সারা জীবন ধরে সেইসব মুহূর্ত ফিরে ফিরে আসতে থাকে কথায়, লেখায়।
তখন বয়স বেশি না আমার, সদ্য তরুণই বলা চলে একরকম। লেখালেখি যদিও করছি অনেক বছর, কিন্তু বেশিরভাগটাই লুকিয়ে। নিজের গোপন ডাইরি ছাড়া যাদের তেমন সাক্ষী নেই। সেই এক-দু’বছর হল সেসব লেখা বন্ধুদের তাগাদায় প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। তাদেরই তদবিরে এদিক-ওদিক পাঠাচ্ছি কিছু লেখা, ছাপা হচ্ছে পত্রপত্রিকায়। আর আস্তে আস্তে আমিও বুঝতে পারছি, এখানে, এই কলকাতায়, লেখালিখির একটা বৃত্ত আছে। সত্যি বলতে কী, একটা নয়, অনেক বৃত্ত। কেউ কেউ পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকে, কেউ কেউ একে-অপরের মুখ দেখে না। কিন্তু আছে অনেক বৃত্ত, লেখালিখির। আর নিজের অজান্তেই কখন সেই একটা কি দুটো বৃত্তের মধ্যে ঢুকেও পড়েছি যে, সে বেশ টের পাচ্ছি তখন। প্রান্তিক হলেও, আছি কোথাও একটা। কেননা, না থেকে উপায় নেই বিশেষ।
তখন ওই পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়ার সুবাদেই এদিক-সেদিক থেকে কবিতা পড়ার ডাক আসছে। ঝোলা কাঁধে চলেও যাচ্ছি। কবিতার মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হচ্ছে। সমসময়ে লিখতে আসা তরুণী-তরুণরা যেমন আছেন তার মধ্যে, আছেন সেইসব নক্ষত্রও, যাঁদের কবিতার দিকে বিস্মিত মন নিয়ে বড় হয়েছি। এই পরিসর ক্রমে বাড়ছে আর আমি বুঝতে পারছি, কবিতার জগতে ঢুকে পড়ছি এবার। ঢুকে পড়ছি, আর আনন্দের বদলে কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে? অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। যে-শিল্প এত উচ্চ, এত সূক্ষ্মমানের, তার জাগতিক পরিসর তো আনন্দময় হওয়ারই কথা, এমনটা ভাবতাম আমি। কিন্তু পরিচয় ঘটতেই দেখলাম, আদপে তা নয়। বরং উল্টোটাই সত্যি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বরাবরের মতো শুভ্র ও শান্ত। নীরব ও প্রবল। আমি ঠিক কথা খুঁজে পেলাম না। যে-কথা বলতে এসেছিলাম, তা আর বলে ওঠার সাহস নেই তখন। কে আমি, ক’দিনই বা লেখালিখি করছি, কতটুকুই বা চেনেন আমায় উনি আর কী-ই বা আমার অস্তিত্ব। তিনি, শঙ্খ ঘোষ, এই সমাজকে দিশা দেন। তাঁর সামনে এই তুচ্ছ ব্যক্তিসমস্যা তুলে ধরা তো বোকামিই একরকম। চুপ থাকলাম তাই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কারণ এখানে কেউ কাউকে ভালোবাসে না, পছন্দ করে না। এই অবধি যদি বা ঠিক থাকে, আরও বেশি করে সত্যি হল, এখানে প্রায় সকলে সকলকে অপছন্দ করে, একে অপরের বিরুদ্ধে পরিশুদ্ধ অসূয়া পোষণ করে, এমনকী, সারাক্ষণ একে অন্যের ক্ষতি চায়। তেমন কিছু চাওয়ার পরিচয় খোদ আমিও পাচ্ছিলাম। এবং যাঁদের কাছ থেকে আসছিল তেমন সব সংকেত, তাঁরা আমার পূজনীয়। ফলে হল কী, বহুদিনের লালিত একখানা ধারণা চুরমার হয়ে যেতে থাকল আমার ভিতরে। এই তাহলে, কবিতার জগৎ? এত কালিমা, এত ক্লেদ, এত কলহের আধার সে?
দেখতে দেখতে মন নিভে এল আমার। কবিতার জগতের প্রতি যে-অদম্য আকর্ষণ ছিল এক সময়ে, তা অস্বস্তিতে বদলে গেল। কিন্তু এই অস্বস্তি মাথায় নিয়ে থাকা যায় না বেশিদিন। কারও সঙ্গে তো বলতে হবে এই নিয়ে কথা, কারও কাছে তো নামিয়ে রাখতে হবে এই যন্ত্রণার ভার। নইলে স্বাভাবিক যাপন সম্ভব হবে না আমার, কবিতার জগৎকে এতখানি অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে জানার পর। কে আছেন? কার কছে যাওয়া যায় তবে? মনে এল শঙ্খবাবুর কথা। বলা দরকার, তখনও তাঁর বাড়ির রোববারের আড্ডার নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠিনি আমি, কাজে-অকাজে তাঁকে বিরক্ত করার অধিকার তখনও তিনি দেননি আমায়, তখনও তাঁর ধারাবাহিক স্নেহে ঢেকে যাইনি আমি। একটা-দুটো সভায় দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে, স্মিত হেসে কথা বলেছেন– এই যা। আর অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে তাঁর বাড়িতে নিজের দু’খানা রোগা রোগা বই নামিয়ে রেখে এসেছি। ওঁর সঙ্গে এটুকুই আমার সংযোগ। তাহলে মাথায় এল কেন ওঁর কথা? কেননা ততদিনে আমি শুনেছি, শঙ্খবাবু ফিরিয়ে দেন না কাউকেই। সকলের জন্যই তাঁর দরজা খোলা, সর্বক্ষণ। আমাকেও কি জায়গা দেবেন না একটু? ভেবেছিলাম এইরকমই।
দিলেন জায়গা। ফোন করে কেবল বলেছিলাম, একদিন দেখা করে কিছু কথা বলতে চাই। জিজ্ঞেস করেননি কিছু, কেবল সময় দিয়েছিলেন। অমুকদিন বিকেলবেলা, এতটার সময়। অনেকখানি ভয় আর সংকোচ নিয়ে হাজির হলাম নির্ধারিত দিন ও সময়ে। তিনি কত মস্ত মানুষ, কত বড় মাপের কবি তিনি। তাঁর সময়ের দাম মাপাও আমার সাধ্যে নেই। তেমন মানুষের কাছে নিজের এই সমস্যা নিয়ে চলে এলাম? যদি কিছু মনে করেন? যদি রুষ্ট হন? তাঁর বইঘেরা বাইরের ঘরে বসে এই সমস্ত ভাবছি, যখন একজোড়া জানলার বাইরের মাঠে বিকেলের রোদ মিইয়ে আসছে। কিন্তু খবর চলে গেছে ভিতরঘরে, যে কোনও মুহূর্তে তিনি এসে পড়লেন বলে। এখন তো আর পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
এলেনও। বরাবরের মতো শুভ্র ও শান্ত। নীরব ও প্রবল। আমি ঠিক কথা খুঁজে পেলাম না। যে-কথা বলতে এসেছিলাম, তা আর বলে ওঠার সাহস নেই তখন। কে আমি, ক’দিনই বা লেখালিখি করছি, কতটুকুই বা চেনেন আমায় উনি আর কী-ই বা আমার অস্তিত্ব। তিনি, শঙ্খ ঘোষ, এই সমাজকে দিশা দেন। তাঁর সামনে এই তুচ্ছ ব্যক্তিসমস্যা তুলে ধরা তো বোকামিই একরকম। চুপ থাকলাম তাই। সামান্য কুশল বিনিময়ের পর চা-জলখাবার এল। কোনওরকমে সেসব শেষ করে উঠে পড়ছি, প্রণাম করতে যাব, এমন সময়ে বললেন, ‘কী যেন বলার কথা বলছিলে সেদিন?’
হ্যারি বেলাফন্টেকে অক্ষর-তর্পণ করলেন উপল সেনগুপ্ত: এই নীল রঙের গ্রহকে গান দিয়ে বদলে দিতে চাইতেন হ্যারি বেলাফন্টে
প্রশ্নটা আমাকে বসিয়ে দিল আবার। মিথ্যে বলা যায় না এর উত্তরে। ওঁকে বলা যায় না অন্তত। বাঁধ ভেঙে গেল শেষমেশ। আটকে আর রাখতে পারলাম না নিজেকে। এতদিনকার জমা সমস্ত হতাশা আর যন্ত্রণা বেরিয়ে এল এক ধাক্কায়। কতক্ষণ একটানা বলে গেছি সব কথা, সে-খেয়ালও নেই। কেবল মনে আছে, আমার শেষ বাক্যটি ছিল এরকম, ‘কবিতার জগৎ যে এত অন্ধকার, আমি তা ভাবতেও পারি না’। সবটুকু শুনে উনি চুপ করে থাকলেন। অনেকক্ষণ। তাকিয়ে থাকলেন জানলা দিয়ে বাইরের দিকে। ওপাশের মাঠে তখন সন্ধে নামছে। আমি চুপ করে বসে আছি একপাশে। সবটা বলতে পেরে যেমন হালকা লাগছে, তেমনই শঙ্কা হচ্ছে এই ভেবেও যে, কী মনে করলেন উনি।
আমি ভাবছি এবার তবে উঠে পড়াই ভাল, এমন সময় ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। আর প্রশ্ন করলেন একখানা। প্রশ্ন বলছি বটে, কিন্তু আদতে সেটাই ছিল ওঁর উত্তর। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি ধারণা, কবিতার জগৎটা তোমার বাইরে?’ আমি চুপ করে ছিলাম এতক্ষণ, এই প্রশ্নের সামনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম এবার। সত্যিই তো! এভাবে ভেবে দেখা হয়নি কখনও। কবিতা, যা আমার শিল্প, তার সঙ্গে তো বহির্জগতের সংযোগ নেই কোনও। সে তো অভ্যন্তরীণ, আন্তরিক এক প্রক্রিয়া। বাইরের পৃথিবীতে যা-ই ঘটে চলুক না কেন, তার ছায়া তো কবিতার শরীরে পড়ার কথা নয়। যাকে নিয়ে আমার এত দ্বিধা, সে তো কবিদের জগৎ আসলে। কবিতার নয়। আর কেবল কবিতা কেন, সব শিল্পের ক্ষেত্রেই একথা সত্যি। শিল্পের জগৎ আসলে শিল্পীর ভিতরে, তার মননে, তার চেতনায়। তাকে কোনও অসূয়া, কোনও ঈর্ষা, কোনও কলহ বা কোনও কূটভাবনা স্পর্শ করতে পারে না। সে সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ-প্রশ্নের উত্তর আসলে প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। তাই সেদিন আর কোনও কথা বলিনি। প্রণাম করে বেরিয়ে এসেছি পথে। সন্ধের কলকাতা তখন সেজে উঠছে রোজকার মতোই। কেবল একজন তরুণ বদলে গেছে, ভিতর থেকে, চিরকালের মতো। ওঁর এই প্রশ্নটুকু আমাকে পথ দেখিয়ে আসছে আজ কয়েক দশক হল। দেখাবেও। যতদিন আমি জীবিত থাকব। স্নেহ বা প্রতিপালনের অনুভূতি থাকলেও, দিক নির্ণয় করে দেওয়ার ক্ষমতা সকলের মধ্যে থাকে না। শঙ্খবাবু ছিলেন সেই কম্পাস, সেই ধ্রুবতারার মতোই, হালভাঙা নাবিক যার দিকে তাকিয়ে খুঁজে নিতে পারে কিনার। আমি তাই স্মরণ করি না ওঁকে। স্মৃতি তো তাঁর, যিনি নেই। আমার দৈনন্দিনে ওঁর ভাবনা এত বেশি বিদ্যমান যে, স্মৃতি বলে তাকে মেনে নিতে পারি না। বরং শঙ্খ ঘোষ অনেক বেশি করে আমাদের সত্তা। আর ভবিষ্যৎ তো বটেই।
যদি দাগই মুছে ফেলো, স্মৃতিও মুছে ফেলা দস্তুর। পারবে পুরাতন প্রেম ছাড়া বেঁচে থাকতে? পারবে সেই আদিম ডাককে অস্বীকার করতে? বারবার জিতে যাওয়াগুলো ভুলে যেতে? সেইসব অপ্রেমের ভেতর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ওই আনন্দ ভুলে যেতে? কাটাগাছে হাত কেটে রক্তাক্ত, তবুও রাতের শেষে সেদিন বাঁকা চাঁদ উঠলে তুমিই তো আলোয় ভরে উঠেছিলে, আরও কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিলে। ফেরার রাস্তা ভুলতে চেয়েছিলে। আধেক আলো আর গোটা জীবন নিয়ে ফিরে এসেছিল সকাল হতে।
‘বাঘের মতো নিষ্ঠুর’ বা ‘বাঘের মতো রক্তপিপাসু’ এসব কথা কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারতেন না জিম করবেট। বারবার বিভিন্ন লেখায় বাঘকে ‘সাহসী প্রাণী’ বলেছেন। আর বলেছেন, ভারতের জীববৈচিত্র রক্ষায় বাঘের মতো প্রাণীর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার গুরুত্বের কথা।
দীর্ঘ সময়ের কাজ, রাস্তায় অনেকক্ষণ কাটানো, শৌচালয়ের অভাব, পথের নানা বিপদ, চাকরি টেকার অনিশ্চয়তা, পুরুষ সহকর্মীদের শ্লেষ, বসের হাতে হেনস্থার ভয়, কাজটা সহজ ছিল না 'মহিলা সেলসম্যান'দের। বড়লোক কাস্টমারদের মেজাজের ওঠানামাও সামলাতে হত তাঁদের।