পুজো মানেই অল্প জিরিয়ে নেওয়া। আর অল্পের হাত ধরেই আসে গল্প। জীবনের ফাঁকফোকরে কয়েক মিনিট একটু অন্য জীবনের ডেরায় ঘুরে আসা। একটু চক্কর মেরে আসা আরেকটা জীবনে। সে জীবন, নিজের জীবন থেকে খুব দূরের নয়। আসুন পড়ে নিই, রোববার.ইন-এর পাতায় অষ্টমীর গল্প। লিখেছেন বিশ্বদীপ দে।
‘ধ্রুব, তুই নিশ্চয়ই জানিস। আমাকে বলছিস না। আবির আর ওই মেয়েটার কথা বাংলা বাজারে কে জানে না? বীর বিক্রমে কলেজ স্ট্রিট চত্বরে ওদের হাতে হাত রেখে হাঁটতে দেখেছে সবাই।’ বেশ স্বাভাবিক স্বরে কথাগুলো বলল রিনিদি। এমনিতেও নাটকীয় ঢঙে কথা ও কখনওই বলে না। কিন্তু এখন যেন বাড়তি নিস্পৃহতা মিশে রয়েছে কণ্ঠস্বরে। না কি এর মধ্যে মিশে রয়েছে এক ধরনের ক্লান্তি?
হেমন্তের এই সন্ধে আমার মনে আশ্চর্য বিষাদের জন্ম দিতে থাকে। কোথায় যেন তীব্র সূর্যালোকের ইমেজের ভিতর থেকে জেগে ওঠে ঝিম ধরা সময়ের জলছাপ। মেট্রো তার টানেলে ছুটছে। একের পর এক আলোকিত স্টেশন পেরিয়ে। রিনিদির চুলে বেশ কিছু রুপোলি রেখা আর চোখের দু’পাশে কাকের পায়ের ছাপ। চশমার আড়ালে সামান্য ক্লান্তির কালো ছোপও যেন। আমার রক্তে অ্যাড্রিনালিন রাশ… এ-ও সম্ভব?
মাথার মধ্যে অনেক স্মৃতি, আলো-অন্ধকার ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। রিনিদি আর আবিরদা। আমার প্রথম তারুণ্যের ভিতরে একটা সেতুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে দু’জনে। সেতুটার তলা দিয়ে কোপাই নদী বয়ে যাচ্ছে। খুব ধীরে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে গাইছে রিনিদি। কী গান আজ আর মনে নেই। রবীন্দ্রসংগীত হতে পারে। কিংবা সুমন। অথবা জোন বায়েজও হতে পারে। যাই গাক, ও গান শুরু করলেই আমি, আমরা পাগল হয়ে যেতাম। আর তার পর যদি আবিরদা সেই গানে ঢুকে পড়ে…
টের পেলাম মাঝখানে বেশ কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে। রিনিদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বললাম, ‘না গো। সত্যিই জানি না। লাস্ট দু’বছর হায়দরাবাদে বসে বসে এই বাংলা কবিতার দুনিয়া থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। কিন্তু… ইটস ইমপসিবল।’
রিনিদি বিষণ্ণ হেসে বলল, ‘হাতে সময় আছে? আচমকা যখন দেখা হয়েই গেল… কয়েকটা কথা তোর জানা দরকার। অ্যান্ড আই নিড ইওর হেল্প ধ্রুব।’
২.
আলো ঝলমলে এক কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে আমি ঐন্দ্রিলাকে দেখলাম। এই-ই আবিরদার নতুন প্রেমিকা? একটু ভারী ফ্রেমের চশমার আড়ালে চোখ লুকোলেও দিব্যি দেখতে পাওয়া যায় তারুণ্যের ঝিলিক।
জীবনানন্দ সভাঘর হাউসফুল। আবিরদার হাতে কবি অমল রায়ের নতুন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ প্রথম পর্বে। মাঝে ছোট্ট চা ব্রেক। আর তারপর এই সময়ের কবিদের কবিতা পাঠ। আমি বসে আছি মাঝামাঝি। চারপাশে পুরনো চেনা মুখ যেমন আছে, আধা চেনা নতুন মুখ যাদের মূলত ফেসবুকে দেখি তারাও রয়েছে। কিন্তু এরা কেউই জানে না আজ এখানে কবিতাপ্রেমী হিসেবে নয়, আমি এসেছি গোয়েন্দা হয়ে। বিখ্যাত কবি আবির সেনের দাম্পত্যে ফাটল ধরেছে যে তৃতীয় মানুষটির জন্য তাকে দেখতে। এবং তার সঙ্গে আবিরদার চোখাচোখি কিংবা গোপন ইশারার সংকেতলিপি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করতেও বটে।
চায়ের বিরতির সময় আবিরদা ওকে ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যেও একবার এসে টোকা দিয়ে গেল। চোখেমুখে একটা খুশির ঝলক। ‘তুই এখানে? জানতামই না। কবে ফিরলি?’
‘জাস্ট দিনকয়েক হল। নেক্সট উইকে ‘খবর এখন’-এর পোর্টালে জয়েন করছি। হাতে সময় আছে তাই ভাবলাম…’ বলতে গিয়ে মনে হল আবিরদা তো জানতে চায়নি কেন এসেছি। আমিই আগ বাড়িয়ে কৈফিয়ত দিয়ে বসলাম!
আবিরদা বলল, ‘বেশ করেছিস। হায়দরাবাদে বসে চাকরি করলে কবিতা লিখবি কখন? এখানকার মিডিয়া কী দোষ করল?’
ওর প্রায় গা ঘেঁষে দু’জন যশোপ্রার্থী কবি উসখুস করছিল। তাই কথা না বাড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘অনুষ্ঠান শেষে ওয়েট করবি। তোকে আজ বাড়ি নিয়ে যাব। অনেক দিন পর পেয়েছি। আর ছাড়াছাড়ি নেই।’ দেখলাম কালো ফ্রেমের চশমার ব্যাকগ্রাউন্ডে আবিরদার চকচকে ফরসা মুখটা যেন আরও ঝলমল করছে। চারপাশের আলোর জন্য? নাকি নতুন প্রেমের দ্যুতি? নাকি আমি রিনিদির সাপোর্টার হয়ে জোর করে এইসব ভেবে নিচ্ছি?
ঐন্দ্রিলার কবিতা পড়ার সময় আবিরদার মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। সামনের সারিতেই বসে আছে। কিছু বোঝার সত্যিই উপায় নেই। এমনকী, মোবাইল ফোন তাক করে ভিডিও করারও চেষ্টা নেই। হতেই পারে, সম্পর্কের গুঞ্জনটা ভালোমতোই ছড়িয়েছে বলে বাড়তি সতর্কতা রয়েছে। হয়তো কেবল আমি নই, আরও অনেকেই নজর রেখেছে ওদের দিকে।
মনে পড়ল রিনিদির কথা। সেদিন মেট্রো থেকে নেমে একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসেছিলাম আমরা। সেখানেই রিনিদি অকপট ভঙ্গিতে স্বামীর পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিল। ক্যাফের স্নিগ্ধ পরিবেশ, আশপাশের সাজানো গোছানো মানুষ ও কথার গুনগুনের মাঝখানে রিনিদির কথাগুলো যেন বেমানান, খড়খড়ে। গলার স্বর নিচুই। কিন্তু আর্তনাদে আমার কান ফেটে যাচ্ছিল।
‘ও রিলেশনটার কথা স্বীকার করেনি। উলটে কী বলেছে জানিস? একদিন খুব ঝগড়ার মাঝখানে সোজা বলল, পুরনো দিনগুলো ওর এখন ইয়ার্কি মনে হয়। মনে হয় টাইম মেশিনে করে সেখানে গিয়ে আমার গলা টিপে… যাতে এখনকার এই সব মোমেন্ট তৈরিই না হয়।’
রিনিদির হাতে আলতো করে চাপ দিই আমি, ‘রাগের মাথায় মানুষ অনেক কিছু বলে। তাছাড়া এতদিনের একটা রিলেশনে এই ধরনের ঝগড়া…’
রিনিদি হাসতে থাকে। যদিও সেটা প্রায় কান্নার মতোই দেখায়। ‘তুই সত্যিই অনেক বড় হয়ে গেছিস রে। আমার সেই ছোট্ট ভাইটা, দল বেঁধে লিটল ম্যাগ বিক্রি করত বইমেলায়, রবীন্দ্র সদনে… সে এখন আমাকে কত কী বোঝাচ্ছে!’ তারপর সামান্য থেমে কেটে কেটে বলল, ‘ওকে আমার চেয়ে ভালো কে চেনে বল। আর কেউ না জানুক তোরা তো জানিস। ও মেয়েটার মধ্যে এমন কিছু পেয়েছে, যা আমার মধ্যে নেই। বলতে পারিস ইন্টেলেক্ট… কিন্তু এসব কথা স্বীকার করার সাহস এখনও ওর হয়নি। কত কত রাত কথা কাটাকাটি আর তার পরের দুঃসহ নীরবতার ভিতর দিয়ে যে কেটে গেল আমাদের… বিশ্বাস কর, মা হতে পারিনি বলে আমার মধ্যে কোনও আফসোস নেই। কিন্তু আবিরের মতো সঙ্গী ক্রমশ দূরে চলে গেলে আমি সত্যিই একেবারে একা হয়ে যাব।’
আরও অনেক কথা বলে গিয়েছিল রিনিদি। শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলাম না আসল সত্যিটা কী। একসময় আমাদের একটা লম্বা দল ছিল। সাত-আটজনের। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। লেখালেখিও সবারই অনিয়মিত। কিন্তু একসময় ‘মায়ানগর’-এর মতো কবিতার পত্রিকা বের করে হইহই ফেলে দিয়েছিলাম আমরা। সেই অতীতটার সঙ্গে অবধারিতভাবে জুড়ে ছিল দুটো নাম। রিনিদি আর আবিরদা। আবিরদা ততদিনেই খ্যাতিমান। রিনিদিও কবিতা লিখত। তবে অনিয়মিত। লেখা চাইতে গিয়ে যে সম্পর্কের শুরুয়াৎ, তা অচিরেই গভীর হয়ে ওঠে। দল বেঁধে কখনও শান্তিনিকেতন, কখনও বকখালি। ওদের তখনও বিয়ে হয়নি। সেসব বছর পনেরো আগের কথা।
কাট টু এই সময়। আবিরদা চল্লিশ পেরনো সেলেব কবি-অধ্যাপক। সম্ভবত বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ হবে। রিনিদি হাউস ওয়াইফ। ওরা সমবয়সিই বোধহয়। দশক পেরনো দাম্পত্যে এখন ফাটল। রিনিদির কথায়, ‘উই আর অ্যাবাউট টু ব্রেক।’ কিন্তু সত্যিই কি তাই? নাকি ঐন্দ্রিলা স্রেফ একঝলক টাটকা বাতাসের মতো বয়ে যাচ্ছে আপাতত। হাওয়া থেমে গেলে আবিরদা আবারও ফিরে যাবে পুরনো সম্পর্কের কাছে? কিন্তু ঝড় থেমে গেলে কি বালির কণারা আগের জায়গায় ফিরে আসে? অবিকল?
৩.
আবিরদা-রিনিদির ফ্ল্যাটটার বয়স প্রায় সাত বছর। শেষ এসেছি তাও হয়তো চার বছর হবে। আজ একরকম বগলদাবা করেই আমাকে গাড়িতে তুলল আবিরদা। এরকম পরিস্থিতিতে ওদের দু’জনের মাঝখানে যেতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু আবিরদা যেন নাছোড়বান্দা। বলল, ‘তোকে সকালে বেশিক্ষণ আটকাব না। সেরকম হলে ফার্স্ট মেট্রোয় বেরিয়ে যাস। উত্তমকুমার থেকে এম জি রোড… কতক্ষণ আর লাগবে। তাছাড়া তুই এখন ফ্রি আছিস। কতদিন আমরা বসি না বল তো? বলে দে বাড়িতে।’
মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও মুখের ওপরে সত্যিই এই মানুষটাকে ‘না’ বলা সম্ভব নয়। অতএব ওর সদ্য কেনা গাড়িতে চেপে বসলাম। দূরত্ব খুব বেশি নয় বলে আজ আবিরদা ড্রাইভার আনেনি। নিজেই চালাচ্ছিল। বলল, ‘আগে হলে তোকে এত সাধতে হত না। কেবল বললেই হত, কী রে সমুদ্রে যাবি? তোর মনে আছে একবার আমার সেই আর্টিস্ট বন্ধু রবির গাড়িটা নিয়ে তোকে কেমন বোকা বানিয়ে বাড়ি থেকে তুলে সোজা দিঘায় চলে গেছিলাম।’
‘মনে আছে। কিন্তু সমুদ্র তো সরে সরে যায়। আজ আর সেখানে গেলে সমুদ্রকে পাবে না আবিরদা। সময়ের ফেনা পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে।’
‘বাপ রে! কীসব বললি রে? চল আজ তোর নতুন কবিতা শুনব। আমার নতুন লেখাও শোনাব। আমার লেখায় একটা বাঁক এসেছে। জানিস তো…’
কথাটা শুনে বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল আমার মুখে। তোমার সেই বাঁকটার মুখেই তো আশ্চর্য কুয়াশা জমেছে। রিনিদি একা হাতে অসহায়ের মতো সেই কুয়াশার ধোঁয়া সরাতে চেষ্টা করে চলেছে। বললাম, ‘কবিতার আগে গান শুনব। কতদিন তোমাদের গান শুনি না।’
‘তোমাদের’ কথাটা ইচ্ছে করেই বলা। আবিরদার অভিব্যক্তিতে কোনও পরিবর্তন হল না। কেবল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ধুর! আজকাল আর গান গাই না। বরং তোকে শায়েরি শোনাব। রাহত ইন্দোরির। আসমান লায়ে হো? লে আও। জমিন পর রাখ দো। এটা শুনেছিস? ইউটিউবেই আছে। ওহ… এই লোকটা…’
আবিরদার মধ্যে এই একটা পরিবর্তন এসেছে। চট করে কথা ঘুরিয়ে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা। আজ গাড়িতে ওঠার আগে ঐন্দ্রিলা আর তার এক বান্ধবী দেখা করতে এল যখন, তখনও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ঐন্দ্রিলা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার গাড়িতে কি লিফট দেবে নাকি?’ তাই শুনে আবিরদা বেশ তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বলল, ‘ধুস! আজ আমার এই ভাইটাকে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের বাড়ি। তোরা মেট্রোয় চলে যা। সবে তো সাড়ে আটটা।’ অর্থাৎ ও ঐন্দ্রিলার মতো তরুণীর সঙ্গ পেতে একেবারেই আগ্রহী নয়, এই ভঙ্গিটাই যেন ফুটিয়ে তুলল। মানে আমি যদি কিছু শুনেও থাকি, সেটা মাথায় রেখেই এই স্টান্স। এতক্ষণের গোয়েন্দাগিরিতে কিছু না বুঝলেও এই একটা ভঙ্গি, এই চালাকিটাই যেন অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু আমি কি রিনিদিকে এসব কথা বলতে পারব?
৪.
যেমন ভেবেছিলাম পরিস্থিতিটা কিন্তু সেরকম থাকল না। দরজা খুলে আমাকে দেখে রিনিদি অবাক হল। আর তারপর চওড়া হাসিতে ফেটে পড়ল প্রায়। ‘তুই! আয় আয়। কদ্দিন বাদে! দাঁড়া, চিকেন বানাই।’
আবিরদা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসর বসিয়ে ফেলল। মাইক্রোওয়েভে দোকান থেকে আনা চিকেন পকোড়া গরম করা। সেই সঙ্গে মদ, বরফ, গ্লাস ও অন্যান্য আয়োজনও সাড়া হয়ে গেল। ওদের ড্রইংরুমের ডিভানে বসলাম দু’জনে। রিনিদি রান্না বসিয়েছে। ভাত, ডাল, মাছ ছিলই। আমার জন্য স্পেশাল চিকেনটা কেবল বানাবে। বারণ-টারণ করে লাভ হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধে চনমনে হয়ে গেল খিদেটা। জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে। এমন হাওয়ায় একটা পুরনো সময়ের গন্ধ থাকেই। ফলে কেমন যেন অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলাম বলে মনে হল। যেন এক নিরিবিলি সংসারের ফুরফুরে বাতাস সর্বত্র। আমি রিনিদির কাছে পৌঁছে দিয়ে এলাম ওর গ্লাস। রিনিদি অবশ্য ইশারায় বুঝতে চাইছিল ঐন্দ্রিলাকে দেখেছি কি না। অস্ফুট উচ্চারণে জানিয়ে দিয়েছি, পরে জানাব।
আবিরদা ওর নতুন বই ‘হে প্রণয়, হে ক্ষত’ আমাকে উপহার দিল। হাতে নিয়েই মনে পড়ল সেদিন ক্যাফেতে রিনিদির বলা কথাটা, ‘ওর নতুন বইটা পড়লেই বুঝে যাবি। বহু জায়গায় সংকেত-টংকেত সরিয়ে সরাসরি অনেক কথা বলা আছে। বিয়াল্লিশের গ্রহাণু থেকে খামচে নিচ্ছ তোমার সাতাশ বসন্তের প্রহেলিকা। এসব লাইনের মানে সবাই বোঝে।’ আবিরদা এখন এসব কবিতা পড়তে শুরু করলে তৈরি হওয়া আবহ মুহূর্তে ছিঁড়েখুঁড়ে যাবে। তাই বইটা নিয়ে কথা হওয়ার আগেই বললাম, ‘তোমার এককথা চলে এলাম। আমার রিকোয়েস্টও কিন্তু রাখতে হবে। গান চাই।’
আবিরদার মুখেচোখে একটা অস্বস্তি। ‘না রে। আজকাল আর গান…’
‘তোমাদের গান বহুকাল শুনি না। আজ শুনব।’
‘রিনি, তুমি গাও।’ আবিরদার কথা শুনে রান্নাঘর থেকে গম্ভীর মুখে উঁকি দিল রিনিদি। আমার মনে পড়ল, ফ্ল্যাটে ঢোকার পর এই প্রথম রিনিদির সঙ্গে সরাসরি কোনও কথা বলল আবিরদা। আমি যেন আচমকাই বুঝতে পারলাম, আমাকে সামনে রেখে চলতে থাকা অস্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে পড়তে চাইছে আবিরদা। অন্তত একরাতের জন্য। হয়তো সেই জন্যই এভাবে জোর করে নিয়ে এল। বললাম, ‘আচ্ছা রিনিদি, তুমিই শুরু করো।’
‘আমি রান্না করছি রে। এখন…’
রিনিদির গম্ভীর স্বর শুনে আবিরদাও কিছু বলার সাহস পেল না। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। একসময় কথায় কথায় গান যাদের মাঝখানে সেতু হয়ে উঠত, তাদের মাঝখান থেকে গান কখন উঠে চলে গেছে তারা নিজেরাও জানে না! কিছুটা সময় কাটল। হঠাৎই আমাকে চমকে দিয়ে আবিরদা গেয়ে উঠল, ‘হারিয়ে গিয়েছি এই তো জরুরি খবর… অবাক দু’চোখে, ছায়া কাঁপে ভয়ে অভিমানে।’ ধীরে ধীরে গানটা দুলতে দুলতে ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। যেন অনেক দিন পর আগল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে। জমে থাকা কান্নার মতো জমিয়ে রাখা গানেরও একটা নিজস্ব জোর আছে। আবিরদাও সেই জোরের পাল্লায় পড়ে চলে গেল পরের গানে। ‘তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগি হয়রান হুঁ ম্যায়।’ এই গোটা সময়টা আমার নজর ঘুরছিল রিনিদির দিকে। দু’-একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল রিনিদি। শসা, পেঁয়াজ কেটে এ ঘরে এসে রেখে গেল। আবার রান্নাঘরে ফিরে গেল। কিন্তু ওর চলনের মধ্যে গানের রেশ ঢুকে পড়ছে। ও কি ভাবার চেষ্টা করছে কতদিন পরে গান গাইছে আবিরদা? মুখে-চোখে ফিকে হলেও প্রশান্তির একটা আলো।
‘নীল নীল আকাশের কাছে আজ যাওয়া চাই… স্বপ্নের রঙে আজ মনে রং মাখা চাই… সাড়া দাও’ আবিরদা এই গান ধরার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই গানটা ধরে নিল রিনিদি। আমি চমকাইনি। সুরে বেজে উঠেছে ঘরটা। ‘সুর চায় তোমাকে, আমাকেও চাই তার… আমাদের মনে রং মিলে যাক দুনিয়ার।’ কে কার কাছে সাড়া চাইছে সেসব এই মুহূর্তে ব্রাত্য। কেবল এই গান, এই উচ্চারণটুকুই একমাত্র সত্যি হয়ে উঠেছে। বহুদিনের নীরবতা ভেঙে কথারা সুরের কুয়াশা মেখে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আজ।
গানটা শেষ হতেই খেয়াল করলাম আবিরদা উঠে জানলার কাছে চলে গেছে। রিনিদি এসে বসেছে ঘরের কোণে রাখা চেয়ারটায়। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। আবিরদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডায়মন্ডস অ্যান্ড রাস্ট?’ আসলে রিনিদির দিকে সরাসরি তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। রিনিদি শুরু করল, ‘ওয়েল আই’ল বি ড্যামড… হেয়ার কামস ইওর ঘোস্ট এগেইন…’
আবিরদার আঙুলে পুড়ে যাচ্ছিল সিগারেট। রিনিদি গাইছিল, ‘হিয়ারিং আ ভয়েস আই’ড নোন… আ কাপল অফ লাইট ইয়ার্স এগো।’ দুই আলোকবর্ষ দূর থেকে এই কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন জোন বায়েজ। প্রেমিক বব ডিলানের কণ্ঠস্বর। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার দশ বছর পরে। নাহ! আসলে দুই আলোকবর্ষ।
কোটি কোটি নক্ষত্র আর অনন্ত মহাশূন্য পার করে ভেসে আসছিল গানটা। ‘উই বোথ নো হোয়াট মেমরিজ ক্যান ব্রিং… দে ব্রিং ডায়মন্ডস অ্যান্ড রাস্ট।’ এই গান আগেও রিনিদির গলায় শুনেছি। কিন্তু আজ গানটা থেকে খসে খসে পড়ছে হিরে আর মরচে। এঘরে আজ কেবল আবির আর রিনিই আছে। আর আছে একটা গাছ। আমার দুই ডালে এসে বসেছে দুই গানের পাখি। ওদের প্রশ্ন করলাম, ‘গান থেমে গেলে তোমরা কি ফের সেই অবিশ্বাস আর চিৎকারের মধ্যেই ফিরে যাবে?’
ঘরময় ছড়িয়ে থাকা হিরে আর মরচের গুঁড়োয় জ্বলজ্বল করছিল হারানো সময়। যখন তখন তাকে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে ঢুকে পড়তে পারে নতুন সম্পর্কের দাবি। কিন্তু আপাতত এই গান সমস্ত শুশ্রুষার প্রতিশ্রুতি হয়ে জন্ম নিচ্ছিল।
অলংকরণ শান্তনু দে