কর্তৃপক্ষ কয়েক বছর ষষ্ঠির দিন এই অনুষ্ঠান প্রচার করার পরেও জনপ্রিয়তা সেইভাবে বৃদ্ধি পেল না। এই রহস্য নিয়ে পর্যালোচনা করে জানা গেল যে, ষষ্ঠির দিন সবার বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে, কলকাতায় চাকরি করা মানুষেরা লম্বা ছুটিতে অবিভক্ত বাংলার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে রওনা দেয়, তাই জিনিসপত্র গোছানো আর আসন্ন যাত্রা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাই এই অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করতে পারে না। ফলে এই অনুষ্ঠান পর্যাপ্ত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। আরও পর্যালোচনা করে দেখা গেল যে মহালয়ায় তর্পণ করার জন্যে অধিকাংশ হিন্দু অফিস থেকে ছুটি নেয় আর মহালয়ার ভোরে উঠে নদীতে গিয়ে তর্পণ করে। আর কালক্ষেপ না করে তিরিশের দশকের দ্বিতীয় ভাগে অনুষ্ঠানের দিন আর সময় বদলে ফেলা হয়– মহালয়ার দিন সকাল চারটের সময় প্রচারিত হল অনুষ্ঠান, যাতে এই অনুষ্ঠান শুনে মানুষ তর্পণ করতে যেতে পারে। আর বাকিটা ইতিহাস।
যতক্ষণ না মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ঘোষণা করছেন ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা’, বাঙালিদের পুজো চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়িতে ঢোকে না। মা’র কাছে শুনেছি আজ থেকে ৭০ বছর আগের কথা– এলাকায় শুধু আমাদের বাড়িতে রেডিও ছিল। মহালয়ার দিন মাঝরাতে উঠে কাকু সেই রেডিও বাড়ির উঠোনে বসিয়ে দিত, আর সকাল চারটের আগেই এসে হাজির হতেন পাড়ার সব লোকজন। অনেকে আবার সেই সকালে স্নান করে আসতেন। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে রাজস্থানের উদয়পুরে মহালয়ার দিন সকাল চারটেয় যখন ক্যাসেট চালিয়ে মহিষাসুরমর্দিনী শুনেছিলাম, সেদিন থেকে সেই দেড় হাজার মাইল দূরের শহরে পুজোর জন্যে প্রতীক্ষা শুরু হয়েছিল যেখানে পুজো হত সাকুল্যে তিনটে– যার একটা বাড়ির পুজো। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র মহিষাসুরমর্দিনী, মহালয়া আর দুর্গাপুজোর মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সারা পৃথিবী জুড়ে– রবীন্দ্রসংগীতের আধুনিকীকরণ তবু বাঙালি সহ্য করে নেবে, কিন্তু মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর বদলে অন্য কারও গলা? প্রশ্নই ওঠে না!
অনেকেই জানে না এই মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান শুরুতে মহালয়ার দিনের অনুষ্ঠান ছিল না। বেশ কিছু বছর পর এটা মহালয়ায় প্রচারিত হতে শুরু করে। যেমন প্রায় কেউই জানে না এই অনুষ্ঠান আদপে কার মস্তিষ্কপ্রসূত। রেডিওর একেবারে শুরুর দিনগুলোয় একঝাঁক মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রেডিওকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্যে। পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বাণী কুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্ররা নতুন যোগ দিয়েছেন, বয়সে তখন নিতান্ত তরুণ। নিত্য আলোচনার তুফান উঠছে গার্স্টিন প্লেসের অফিসে, আর অনুষ্ঠানে রদবদল আনা হচ্ছে– সবার একটাই প্রচেষ্টা, কীভাবে সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করা যায় আর কীভাবে এই মাধ্যমকে জনপ্রিয় করে সবার মধ্যে পৌঁছে দেওয়া যায়। সেই সময় পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা বেশি, তাই অল ইন্ডিয়া রেডিও মনস্থ করল নিজেদের এক পত্রিকা প্রকাশ করার, যার মাধ্যমে সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছতে পারবে। ‘বেতার জগৎ’ নামে এক পত্রিকা প্রকাশ শুরু হল ১৯২৯ সাল থেকে, ‘মহাস্থবির জাতক’ লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ছিলেন সেই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা আর প্রথম সম্পাদক। আড্ডাবাজ হিসাবে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর জুড়ি ছিল না– বয়স নির্বিশেষে সবার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব, কাজেই গার্স্টিন প্লেসে তাঁর দপ্তর অচিরেই এক আড্ডাপীঠে পরিণত হল, আর সেই পীঠে মূল সাধনার বিষয়ে কীভাবে রেডিওর অনুষ্ঠানকে জনপ্রিয় করা যায়। আর এই আড্ডায় বীরেন্দ্র ভদ্ররাও অংশগ্রহণ করতেন সাগ্রহে। ১৯৩১ সালের এক বর্ষার দিনে এমনই এক আড্ডায় দুর্গাপুজো নিয়ে আড্ডা হচ্ছিল। হঠাৎ প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মাথায় এক অভিনব বুদ্ধি আসে আর সময় নষ্ট না করে সেদিনের সেই আড্ডাতেই তাঁর পরিকল্পনার কথা বলে ফেলেন। দুর্গাপুজো নিয়ে রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান করার কথা ভাবেন তিনি, যেটা বাণীকুমার লিখবেন, পঙ্কজ মল্লিক সুর দেবেন আর বীরেন্দ্র ভদ্র পাঠ করবেন। বীরেন্দ্রর স্তোত্রপাঠে মুনশিয়ানার কথা মাথায় রেখে এই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা হবে। সবাই হইহই করে মেনে নিল এই প্রস্তাব আর ঠিক হল যে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন সকালে এই অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে।
যেমন পরিকল্পনা করা হয়েছিল, অনুষ্ঠান প্রচার করা হল। সেই অনুষ্ঠান অনেক প্রশংসিত হল, কিন্তু আশানরূপ জনপ্রিয়তা পেল না। রেডিও কর্তৃপক্ষ এক অভূতপূর্ব সমস্যায় পড়ল– প্রশংসিত অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা পায়নি, এই রকম কখনও হয়নি আগে। কর্তৃপক্ষ কয়েক বছর ষষ্ঠীর দিন এই অনুষ্ঠান প্রচার করার পরেও জনপ্রিয়তা সেইভাবে বৃদ্ধি পেল না। এই রহস্য নিয়ে পর্যালোচনা করে জানা গেল যে, ষষ্ঠীর দিন সবার বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে, কলকাতায় চাকরি করা মানুষেরা লম্বা ছুটিতে অবিভক্ত বাংলার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে রওনা দেয়, তাই জিনিসপত্র গোছানো আর আসন্ন যাত্রা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাই এই অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করতে পারে না। ফলে এই অনুষ্ঠান পর্যাপ্ত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। আরও পর্যালোচনা করে দেখা গেল যে মহালয়ায় তর্পণ করার জন্যে অধিকাংশ হিন্দু অফিস থেকে ছুটি নেয় আর মহালয়ার ভোরে উঠে নদীতে গিয়ে তর্পণ করে। আর কালক্ষেপ না করে তিরিশের দশকের দ্বিতীয় ভাগে অনুষ্ঠানের দিন আর সময় বদলে ফেলা হয়– মহালয়ার দিন সকাল চারটের সময় প্রচারিত হল অনুষ্ঠান, যাতে এই অনুষ্ঠান শুনে মানুষ তর্পণ করতে যেতে পারে। আর বাকিটা ইতিহাস।
বাঙালির জীবনে মহালয়ার দিনের মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের প্রভাব কতটা, সেটা আজকের বাঙালির ‘শুভ মহালয়া’ বার্তাতেই বোঝা যায়। মহালয়া এক পুণ্য লগ্ন, যেদিন পরলোকবাসী পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই রীতি সব ধর্মেই আছে– খ্রিস্টানরা ‘অল সোল্স ডে’ বা ইসলাম ধর্মের শবে বরাত-এর মতো মহালয়া এক পুণ্যের দিন। কিন্তু তাই বলে কি ‘হ্যাপি মহালয়া’ বলা যায়? মহালয়া তো পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষ তো আগামীকাল থেকে!
তত্ত্ব নিয়ে লাভ নেই– মহালয়ার দিন, ভোর চারটে আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র– এই ত্র্যহস্পর্শ মানে পুজো এসে গিয়েছে– সবই শুভ, সবই হ্যাপি!