মহাদেবী দুর্গার অসুরমর্দিনী ভাব কিংবা দশভুজার দশ হাতে কাজ করার সঙ্গে মেয়েদের তুলনা দেওয়াটাকে আমি ঠাকুমা-দিদিমার স্নেহশব্দের উচ্চারণ বলে মনে করি। করিতকর্মা, শিক্ষিত এবং অফিস করা নাতনির জন্য এগুলি তাঁদের সোহাগ-বাক্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেবী দুর্গার এই অসুরদলনী রূপের সঙ্গে মেয়েদের তুলনা অথবা তাঁর দশভূজার স্বরূপে মেয়েদের আদল খোঁজার ব্যাপারটার মধ্যে উপমা অলংকারের সাধারণ ধর্মটিকেই খুঁজে পাই না। বরঞ্চ সপ্তশতী চণ্ডীর মধ্যে সেই যে মহাকাব্যটি, যা স্বয়ং ঋষিদের মুখ থেকে মহাশক্তির উপমানে উৎসারিত হচ্ছে মহাসত্যের মতো, আমি সেই শক্তির উপমানে মেয়েদের দেখতে পেলেই তবে সেটাকে আমি নারীর ক্ষমতায়নের সার্থক বোধ বলে মনে করি।
প্রচ্ছদ শিল্পী: শান্তনু দে
১.
নারীশক্তি কথাটা আমার কাছে ভীষণ হাস্যকর এবং বিভ্রান্তিমূলক মনে হয়। বিশেষত পুজো আসলেই দেবী দুর্গার অসুর-বধের মাহাত্ম্য চারদিকে এমনভাবে উচ্চারিত এবং মুখরিত হতে থাকে– মনে হয়– একজন মহিলা যদি দু’-চারটে বলোদীপ্ত পুরুষকে খানিক দুমদাম পিটিয়ে রাস্তায় শুইয়ে দিতে পারত, তাহলেই বলতে পারি– নারীশক্তি জাগ্রত হচ্ছে! অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের বাবা-মায়েরা ভবিষ্যতে বহু ধরনের পুরুষাসুর-বধের আশায় মেয়েদের ক্যারাটে শিক্ষা দিচ্ছেন। মেয়ে-দরদি অনেক ক্লাব-কর্তৃপক্ষও বিভিন্ন পার্কে এই ক্যারাটের হুম-হামের ব্যবস্থায় মেয়েদের বৈকালিক ভবিষ্যৎ তৈরি করার চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু বাস্তবের ভবিষ্যতে মেয়েরা ক্যারাটের মাধ্যমে অপশব্দ-উচ্চারণকারী কোনও গুণ্ডা-জাতীয় পুরুষকে ধরাশায়ী করেছে– এমন সংবাদ শিরোনামে দেখিনি কোথাও। আর ভিডিওগুলিতে যে এ-বাবদে নারীশক্তির মহিমা দেখি, সেটা প্রামাণিক হলে আমাদের মেয়েদের জাপান কিংবা চিনে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।
তার মানে দেবী দুর্গা যে অলৌকিক মাহাত্ম্যে এক পা সিংহের পিঠে, অন্য পা মহিষাসুরের ডান কাঁধে রেখে, দু’হাতে যেভাবে অসুরের পিঠে-বুকে ত্রিশূল বিঁধিয়ে রীতিমতো স্থাপত্য-রীতির নির্মাণ-কৌশলে আপন শরীরের ‘পারফেক্ট ব্যালেন্স’ তৈরি করেন, তেমনটা আধুনিক বাস্তবে কোনও মহিলার পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। একটা ছৌ-নাচের আসরেও একজন ছৌ-শিল্পীকে ওই অসুরদলনী দুর্গার ভূমিকায় পৌঁছতে ক’জন পদানত পুরুষ-সিংহ, পুরুষ-মহিষ এবং অসুরকে কত নড়েচড়ে দুর্গাকে সাহায্য করতে হয়, সেটা বুঝলে আজকের বাস্তবে আমাদের ভারতীয় নারীদের পক্ষে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও কোনও আসুরিক এবং নারীত্বের অবমাননাকারী পুরুষকে বধ করা সম্ভব হবে না। বিশেষত এইসব সতত বঞ্চিত-ভাবনায় বিকারগ্রস্ত পুরুষদের বধ করার মতো অতিসাহসিক দণ্ড দিয়েও কোনও মহিলা তো জীবনে শান্তি পাবেন না। কেননা এখন তো ভারতে আমাদের পোড়া গণতন্ত্র আছে, আছেন সেই গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী ভুঁড়িওয়ালা পুলিশ, আছেন বিপক্ষের উকিল এবং আইন-আদালত, রাষ্ট্র এবং সবার শেষ রাষ্ট্রপতি।
……………………………………………
কেননা, এ-ব্যাপারে আমাদের উওম্যান এমপাওয়ারমেন্টের কথা ভাবতে হলে আমাদের রমণীকুলকে দেবতেজে নির্মাণ করা দরকার এবং তা এই মর্ত্য-জগতেই সম্ভব যদি রাষ্ট্র তার অনুমতিহীন নির্বিচারে গুলি করার শক্তিটি নারীদের উপহার দেয়। এবার অপকারী পুরুষাসুরকে বধ করার পর শুধু নারীপক্ষের উকিলই স্বমত-সিদ্ধির জন্য জজ-সাহেবের কাছে নিবেদন করবেন এবং বিপক্ষে কোনও উকিল সেখানে অসুরের পাশে দাঁড়াবেন না।
……………………………………………
আমাদের ভারতীয় রমণীদের ‘নারীদেহ’ দুর্গা-চণ্ডীর দেহের মতো ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এবং অন্যান্য দেবতার তেজে নির্মিত নয়, এমনকী কোনও দেবতার দেওয়া দিব্য অস্ত্রও তাঁর নেই। এমত অবস্থায় আমরা যখন পুজোর সময় প্রত্যেক প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে মহাদেবী দুর্গাকে অসুরদলনী এবং বিপক্ষ-ছেদিনী ভূমিকায় রেখে আধুনিকা রমণীদের তুলনা করি, তখনই আমার মনে হয়– এটা অনর্থক স্তোকবাক্য।
কেননা, এ-ব্যাপারে আমাদের উওম্যান এমপাওয়ারমেন্টের কথা ভাবতে হলে আমাদের রমণীকুলকে দেবতেজে নির্মাণ করা দরকার এবং তা এই মর্ত্য-জগতেই সম্ভব যদি রাষ্ট্র তার অনুমতিহীন নির্বিচারে গুলি করার শক্তিটি নারীদের উপহার দেয়। এবার অপকারী পুরুষাসুরকে বধ করার পর শুধু নারীপক্ষের উকিলই স্বমত-সিদ্ধির জন্য জজ-সাহেবের কাছে নিবেদন করবেন এবং বিপক্ষে কোনও উকিল সেখানে অসুরের পাশে দাঁড়াবেন না। পুনশ্চ, জজ-সাহেবও নারীশক্তির এহেন উদ্যাপনে বিস্ময়-মুকুলিত-নেত্রে উদ্বাহু হয়ে সেই পুরুষদলনী মহিলাকে বেকসুর খালাস করে দেবেন এবং স্মিতহাস্যে মন্তব্য করবেন– খুকির গায়ে এত কী জোর আছে! আরও কথা, এখানে উচ্চ-আদালতে যাওয়ার কোনও বিকল্পই থাকবে না। বরঞ্চ রাষ্ট্রপতি তাঁকে পরমবীর চক্র দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার পরেই– অসুর-বধের পর দেবতারা যেভাবে মহাদেবীর স্তব করেছিলেন, সেইভাবে ভারতের সংবাদপত্রগুলি সেই পুরুষ-মর্দিনী মহিলার স্তুতি রচনা করবেন।
আধুনিক কালে একমাত্র এইভাবেই দেবতেজে মেয়েদের শক্তিবর্ধন করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে যেহেতু এই পদ্ধতির প্রয়োগ কোনও ভাবেই সম্ভব নয়, তাই দেবীর অসুরনাশিনীর ভূমিকায় মেয়েদের স্থাপন করাটা শেষ পর্যন্ত ফৌজদারি সমস্যা তৈরি করে দেবে। তাছাড়া দেবতেজের এই বিভূতির কণামাত্রও যেসব নারীশরীরে বর্তমান, তিনি অস্ত্রহীন বাগবিভূতিতেই তাঁর চেনাজানা পুরুষদের ধরাশায়ী করে দিতে পারবেন।
……………………………………………………
আমাদের ভারতীয় রমনীদের ‘নারীদেহ’ দুর্গা-চণ্ডীর দেহের মতো ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এবং অন্যান্য দেবতার তেজে নির্মিত নয়, এমনকী কোনও দেবতার দেওয়া দিব্য অস্ত্রও তাঁর নেই। এমত অবস্থায় আমরা যখন পুজোর সময় প্রত্যেক প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে মহাদেবী দুর্গাকে অসুরদলনী এবং বিপক্ষ-ছেদিনী ভূমিকায় রেখে আধুনিকা রমণীদের তুলনা করি, তখনই আমার মনে হয়– এটা অনর্থক স্তোকবাক্য।
……………………………………………………
অতএব অস্ত্রশস্ত্র, মারামারি, কাটাকাটির জায়গা ছেড়ে আজকের দিনের প্রবীণা বিদগ্ধারা পুজো এলে দুর্গার দশভুজের বিভূতির কথাই বলেন বেশি। তাঁরা বলেন– আজকের দিনের সকল রমণীই দশভুজা দুর্গারূপিণী– তাঁরা প্রত্যেকেই এক হাতে অফিস সামলান, অন্য হাতে স্বামীকেও সামলান, আর দু’হাতে পুত্র-কন্যার পালন-পোষণ করেন, সংসারের আবর্তে শ্বশুর-শাশুড়িকেও ফেলে দেন না, এমনকী বাজার করতে গেলেও বিভিন্ন বাজারে অত্যন্ত ভদ্রস্থ মেয়েদেরই এত দেখা যায়, তাতে রান্নাঘরের জায়গাতেও তাঁদের সস্নেহ হস্তস্পর্শ অনুমানযোগ্য হয়ে ওঠে। তাই এই জায়গায় মেয়েদের দশ-প্রহরণধারিণীর মূর্তিকল্প সুস্পষ্ট বটে, কিন্তু এটা কোনওমতেই নারীশক্তি-বিবর্দ্ধিণী কোনও ভাবনা নয়। উওমেন এমপাওয়ারমেন্ট তো নয়ই। ‘এও কি বুঝাতে হয়/ প্রেম যদি নাহি রয়/ হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান।’
আসলে নারীশক্তির বৃদ্ধি-প্রয়াসের কার্যকারিতা আমি যথেষ্ট বুঝি বলেই মহাদেবী দুর্গার অসুরমর্দিনী ভাব কিংবা দশভূজার দশ হাতে কাজ করার সঙ্গে মেয়েদের তুলনা দেওয়াটাকে আমি ঠাকুমা-দিদিমার স্নেহশব্দের উচ্চারণ বলে মনে করি। করিতকর্মা, শিক্ষিত এবং অফিস করা নাতনির জন্য এগুলি তাঁদের সোহাগ-বাক্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেবী দুর্গার এই অসুরদলনী রূপের সঙ্গে মেয়েদের তুলনা অথবা তাঁর দশভুজার স্বরূপে মেয়েদের আদল খোঁজার ব্যাপারটার মধ্যে উপমা অলংকারের সাধারণ ধর্মটিকেই খুঁজে পাই না। বরঞ্চ সপ্তশতী চণ্ডীর মধ্যে সেই যে মহাকাব্যটি, যা স্বয়ং ঋষিদের মুখ থেকে মহাশক্তির উপমানে উৎসারিত হচ্ছে মহাসত্যের মতো, আমি সেই শক্তির উপমানে মেয়েদের দেখতে পেলেই তবে সেটাকে আমি নারীর ক্ষমতায়নের সার্থক বোধ বলে মনে করি।
ঋষিরা বলেছিলেন, এ-জগতের সমস্ত স্ত্রীলোকই তুমি। তুমিই সর্বত্র জুড়ে বসে আছো– স্ক্রিয়ঃ সমস্তা সকলা জগৎসু।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল– দার্শনিক দিক থেকে এবং ব্যাকরণগত ভাবে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহৃত কতগুলি শব্দ এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ যে, সেই শব্দের অবর্তমানে একজন পুরুষের মূল অস্তিত্বই নঞর্থক হয়ে যায়। ভেবে দেখুন, ‘শক্তি’ শব্দটা– শক্তি ছাড়া তো ‘শক্তিমান’-এর কোনও অস্তিত্বই নেই। আরও বড় কথা হল– ‘শক্তি’ কিন্তু বিশেষ্য শব্দ, আর ‘শক্তিমান’ অবশ্যই বিশেষণ। যিনি বিশেষ্যের রূপ, গুণ, ভাবের প্রকাশক হিসেবে একজন বিশেষ্য-পুরুষের অপেক্ষা রাখেন। খেয়াল করে দেখুন, আমরা যদি বলি– দুর্গা-পার্বতী হলেন শক্তি, তাহলে শিব-মহাদেব হলেন শক্তিমান। অর্থাৎ পরমা শক্তি যদি হন দুর্গা-কালী, তাহলে তাঁরই শক্তিতে শক্তিমান হলেন শিব। এটা যদি বৈষ্ণব দার্শনিকতায় দেখি, তাহলে আমায় এত ব্যাখ্যাও করতে হবে না, রসিক-দার্শনিক কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই শক্তি এবং শক্তিমানের বিশেষ্য-বিশ্লেষণ-ভাব পরিষ্কার বলেছেন–
‘রাধা– পূর্ণশক্তি, কৃষ্ণ– পূর্ণশক্তিমান্।
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র-পরমান॥’
.……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………..
অতএব আমাদের দেশে দুর্গা-কালীদের এমপাওয়ারমেন্ট দার্শনিকতার স্বতঃসিদ্ধিতেই সম্পন্ন হয়েছে। চণ্ডীপাঠের সময় মহাদেবীর দম্ভোক্তিটি তাই ভীষণই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি স্ত্রী-শক্তি হিসেবেই বলেছেন– আমি একাই আদি এই সম্পূর্ণ জগতে, আমি ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে দেখাও দেখি– কে আছে আর আমি ছাড়া–
‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা?’