মনে পড়ে যখন ‘চণ্ডালী’ তৈরি হচ্ছে, সেই সময় শাঁওলীদি আমাকে প্রথম নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, সারাদিন শাড়ি পরে থাকতে হবে। আসলে আমার শাড়ি পরার অভ্যেস প্রায় নেই বললেই চলে। সেটা শাঁওলীদি জানতেন বলেই প্রথমেই আমাকে সারাদিন শাড়ি পরে থাকার কথা বলেন। প্রথম প্রথম আমার খুব বিরক্ত লাগত। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারতাম না। পরে বুঝেছিলাম, কস্টিউমের সঙ্গে কীভাবে অভ্যস্ত হতে হয়, এই একটা কাজ উনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই রেডিও-নাটক শোনার ঝোঁক ছিল প্রবল। আর সেই সময় রেডিও নাটকে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল শাঁওলী মিত্রর। সেই শাঁওলী মিত্রর সান্নিধ্য কোনও দিনও পাব– একথা স্বপ্নেও ভাবিনি! কিন্তু জীবনের গতিপথ বড়ই বিচিত্র। থিয়েটারে আসব ভাবিনি, আজ থিয়েটারই করি। শাঁওলী মিত্রর সান্নিধ্য তেমনই এক আশ্চর্য ঘটনা।
২০০০ সালে যেদিন প্রথম ‘পঞ্চম বৈদিক’-এ এসেছিলাম, তখন সময়টা খুব সম্ভবত বিকেল তিনটে। চারটে থেকে ক্লাস। শাঁওলীদি নেবেন সেই ক্লাস। ঠিক চারটে বাজতে ৫-এ শাঁওলীদি ঢুকলেন পঞ্চম বৈদিকের ঘরে। আমি তো প্রবল উত্তেজিত! রেডিওতে শোনা সেই কণ্ঠস্বর…
ঠিক চারটের সময় ক্লাস শুরু হল। আমার মনে পড়ে, সেদিন শাঁওলীদি নিজে কেন থিয়েটারে এসেছিলেন এবং কেন থিয়েটার করেন, তা বিস্তারিতভাবে আমাদের বলেছিলেন। আজ বলতে পারি, শাঁওলীদির ওই এক ঘণ্টার কথা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। সেদিনই স্থির করেছিলাম, আমি থিয়েটারটাই করব! তারপর ক্রমশ দেখেছি নাট্যচর্চাটাই আসলে তাঁর জীবনচর্যা।
একটা মজার ঘটনা বলি। একদিন আমাদের ক্লাস চলছে, শাঁওলীদি আমাদের ‘ডাকঘর’ পড়াচ্ছেন। আমাকে আর আমাদের ব্যাচের আরেকজনকে ‘ডাকঘর’ পড়তে দিলেন। আমি অমল, আর পল্লবদা দইওয়ালা। সেখানে দইওয়ালার কথা ছিল ‘কেমন ছেলে তুমি? দই কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?’ পল্লবদা বলল, ‘কেমন মেয়ে তুমি? দই কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?’
সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘দুর বাবা! এ পাগল না সিপিএম!’ বলেই আমার মনে হল এই রে! শাঁওলীদি যদি সিপিএম হন! কয়েক সেকেন্ড নীরবতা! তারপরেই শাঁওলীদি হা হা করে হেসে উঠলেন!
আমি নিশ্চিন্ত হলাম! আর একইসঙ্গে মনে হল, যে মহিলাকে সকলে এত অহংকারী বলে, তিনি এমন হা-হা করে হাসতে পারেন!
হ্যাঁ, শাঁওলী মিত্রকে সাধারণভাবে অনেকেই, থিয়েটারের মানুষজন, অহংকারী বলেই মনে করতেন! কিন্তু আমি জানি, আমি দেখেছি, তাঁর মতো এমন সহজ স্বচ্ছ মানুষ প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে! জানি না, আমার কথাটা আপনাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না! কিন্তু তাঁর আশপাশে থাকা বা স্বল্প পরিচিত অনেক মানুষের কাছেই জানতে পারবেন যে, তিনি কেমন ছিলেন! আসলে নাট্যচর্চার সঙ্গে বিন্দুমাত্র শঠতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না! কোথাও এমন কিছু দেখলেই তিনি সেখান থেকে সরে যেতেন। হয়তো সে কারণেই তাঁকে অহংকারী বলেন সকলে। আর তাঁর বাবা শম্ভু মিত্রর সঙ্গেও তো একই ঘটনা বারবার ঘটেছে– সে তো এখন সকলেরই জানা। আসলে এই থিয়েটারের পরিবারটা হয়তো আমাদের চারপাশের চেনা-পরিচিত মানুষদের মতো ছিল না। তাই বোধহয় সকলেই এঁদের ভুল বুঝতেন। আজ আমার সেকথাই মনে হয় বারবার।
মনে পড়ে যখন ‘চণ্ডালী’ তৈরি হচ্ছে, সেই সময় তিনি আমাকে প্রথম নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, সারাদিন শাড়ি পরে থাকতে হবে। আসলে আমার শাড়ি পরার অভ্যেস প্রায় নেই বললেই চলে। সেটা শাঁওলীদি জানতেন বলেই প্রথমেই আমাকে সারাদিন শাড়ি পরে থাকার কথা বলেন। প্রথম প্রথম আমার খুব বিরক্ত লাগত। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারতাম না। পরে বুঝেছিলাম, কস্টিউমের সঙ্গে কীভাবে অভ্যস্ত হতে হয়, এই একটা কাজ উনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। মনে পড়ে, ‘রাজনৈতিক হত্যা’র কথাও। আমাকে হাতে ধরে মেকআপ শিখিয়েছিলেন শাঁওলীদি। বলেছিলেন, আসলে মেকআপের সময় থেকেই একজন শিল্পীর সঙ্গে চরিত্রের কথোপকথন শুরু হয়ে যায়। তখন হয়তো আমি তেমন করে এসব কথা বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ, এত বছর পরে বুঝি যে, উনি আমাকে কেমন করে একটু একটু করে তৈরি করছিলেন!
বলতে গেলে তো কত কথাই বলতে হয়। কিন্তু এত কথা বলার অবকাশ তো এখানে নেই। এটুকু বলতে পারি, ২০০৫-এ নির্দেশনার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন শাঁওলীদি, আর আমাকে তিল তিল করে তৈরি করছিলেন। নিজের জায়গাটা তো কেউ ছাড়তে চান না– শাঁওলীদি অনায়াসে তা পারতেন! আমার খুব অবাক লাগত যে, উনি কেমন করে ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করার কাজে লেগে পড়লেন। জানি না, আমি শাঁওলীদির মতো পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করে রেখে যেতে পারব কি না, তবে চেষ্টার ত্রুটি করব না– এ কথা শাঁওলীদিকে বলেছিলাম।
পরিশেষে বলি, একজন শিল্পী কেমন নীরবে চলে গেলেন। শুধু যাওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়ে একবার বিদায় জানালেন, বললেন, ‘আসি তাহলে’।
শহরের অতীত ও ঐতিহ্য নির্মাণের এক বিশেষ মুহূর্ত ছিল বিশ শতকের গোড়ার বছরগুলি। এই সময়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটছে, কলকাতা পুরসভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের গলার জোর বাড়ছে, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে প্রথমবার শহরের রাস্তায় মানুষ মিছিল বের করছেন– ফলে বোঝাই যাচ্ছিল কলকাতার দাবিদার অনেক, শুধু ব্রিটিশ রাজপুরুষদের নয় এ শহর।
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’