রোববার.ইন-এর এবারের পুজোর প্রথম গল্প সৈকত দে-র। প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
বীভৎস গরম, ফ্যান বন্ধ।
বিদ্যুৎ নেই তবুও ইন্টারনেট আছে। কী একটা ছোট্ট ডিভাইস লাগানোর কারণে এই বাসায় ওয়াইফাই বন্ধ হয় না। সে কারণে নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিরুর চোখে পড়ল সিএনএন নিউজ। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ছোট্ট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাসছেন লিওনেল মেসি। জানা গেল, এই বাচ্চার নাম লামিন ইয়ামাল। এই ছেলেটির জন্মদিন গিয়েছে একদিন আগে, সতেরোতে পা দেওয়া ছেলে স্পেনকে ইউরো ফাইনালে নিয়ে গেছে। চৌদ্দো জুলাইয়ের অনলাইন নিউজ।
রুমি এখন কলেজে পড়াচ্ছে, সে গণিতের অধ্যাপক। তাদের কলেজের পাশেই বিশাল বধ্যভূমি। ’৭১-এ প্রচুর মানুষকে মেরে পাকিস্তানিরা এখানে পুঁতে রেখেছিল। কলেজে ঢোকার রাস্তায় বিশাল দুই ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুল ফোটার সময় আকাশ লাল করে দেয়। তারা বোধহয় মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য দেয়। অনেক বছর আগে একবার বেড়াতে গিয়ে নিরু দত্তর মনে হয়েছিল, এই গাছেরা মানুষের ভাষা বোঝে এবং বাংলায় কথা বলে। অবশ্য রুমি গাছের চেয়েও নীরব। আমাদের গল্পের নায়ক বহু চেষ্টা করেও তার মনের নাগাল পায়নি। অবশ্য লুকোচুরি পছন্দ করে না বলে সোজাসুজি জানান দিয়েছে– তোমাকে ভালোবাসি। মানুষের ভাষা আবিষ্কারের পর বহুল ব্যবহৃত বাক্য। হয়তো প্রকৃতিতেও এইভাবে কথা বলার চল আছে।
কেন না, ভাষাই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে কিছু বলেনি রুমি। আজও বলতে চায়নি বা বলতে পারেনি কারণ নিরু দত্তের বলানোর মতো কোনও সামাজিক পরিচয় নেই। সুনির্দিষ্ট আয় না থাকলে এই নারীবাদী বিশ্বেও কোনও নারীর পক্ষে নিবেদন, আত্মনিবেদন বিরল এবং সত্যি বলতে কী, আমাদের গল্পের নায়িকা খুব অন্যরকম কিছু নয়। তিনি পড়াতে ভালোবাসেন ছেলেবেলা থেকে। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন, অধ্যাপক হয়েছেন আর এদিকে আমাদের নায়ক শুধু লিখে গিয়েছে কারণে-অকারণে। কিন্তু সে অর্থে তো তার লেখা কেউ পড়েনি। তাই টাকাপয়সার দেখাও মেলেনি। পরিচয় পর্ব শেষ এবার গল্প প্রবাহের দিকে মনোযোগ দেয়া যাক।
এবার একই দিনে ইউরো আর কোপা আমেরিকার ফাইনাল পড়েছে। নিরু সেইভাবে কখনও খেলা দেখেনি। মানে যাকে বলে নেশা নেই, কিন্তু তার মনে হল যদি স্পেন আর আর্জেন্টিনা জিতে যায় তাহলে ছোট্ট কোলের শিশু আর ফুটবলের যুবরাজের একটা দ্বৈরথ হবে ফাইনালিসিমোয়। শুধু এই লোভেই রাত জেগে খেলা দেখা আর রুমির সঙ্গে টুকটাক কথা বলার চেষ্টা। রুমি দেরি করে ঘুমায়, তার ঘুম আসে না। একটা সম্পর্ক ভাঙার বেদনা উপাসনালয় ভাঙার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়, সে কথা কেবল নিবেদিত পুরোহিত বোঝেন। আর, ভাঙা প্রতিমা। যদিও, নিরু ভাবে, যারা নিষ্ঠুর প্রতাপ ও পরিকল্পনায় ভেঙে ফেলে, কখনও ধরা পড়লে জানা যায়, মানসিক প্রতিবন্ধী বা উন্মাদ তারা মূলত। হত্যাকারী কবেই বা নিহতের মূল্য উপলব্ধি করেছে? এমনকী, প্রতিমা চূর্ণ হলে একটা জনপদের অনেক মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যায়, চারপাশের মানুষদের প্রতি। সকালে কোপা ফাইনাল হল না যথাসময়ে। দর্শকদের নানা রকম গন্ডগোল। শুরু হতে হতে প্রায় দেড় ঘণ্ঠা দেরি।
বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে প্রতিদিন দেখা যে বিড়াল নিরুকে দেখা দিয়ে যায়, তাকে দেখা গেল না। সেদিন সামনের বিল্ডিংয়ের ব্যালকনিতে যে বাচ্চাটা লাল কাঠের ঘোড়ায় খেলে তাকেও দেখা গেল না। খেলা শেষে মেসিদের সেলিব্রেশন দেখে খানিকটা ঘুমিয়ে নেওয়ার পর, ফেসবুকে ঢুকে নিরুর মনে হল, পৃথিবীটা চট করে বদলে গিয়েছে রক্তময় অবাস্তব এক ঘোরগ্রস্থ ডিস্টোপিয়ান সাইফাইতে ।
২.
‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার/ কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’– এই দুটো লাইনের স্লোগান পুরো বাংলাদেশে নমিয়ে আনল ঝড়ের দিন। রেজিমপুত্রদের সকলেই পরের দুটো বাক্য মুছে দিয়ে, ঘৃণা প্রচার শুরু করলেন।
নিরু নিয়মিত ডাইরি লেখে। তার ডায়েরির একটা এন্ট্রি পড়ে নেয়া যাক, ‘বাৎসল্য মানুষের এক মৌলিক অনুভূতি। পনেরো জুলাই থেকে পাঁচ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রের কর্তা যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্য থেকে এই রস উবে গিয়েছিল। হেলিকপ্টার দিয়ে নির্বিচার গুলি বর্ষণ, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে সারা বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করা এবং কোনও মানবিক কথা শুনতে না চাওয়া– মূলত এই তিনটি বিষয়ে পরিষ্কার, যা ঘটেছে সেটি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের ফসল। দেশ আমাদের কাছে মাতৃপ্রতীক, অথচ কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেখলাম, রাষ্ট্র গণমানুষের বিরুদ্ধে চলে গেল। বাংলার লোকসাহিত্যে সৎ মায়ের অনেক নেতিবাচক গল্প আছে। যাকে আমরা মা ভেবেছিলাম, তিনি হয়ে উঠলেন সৎ মা। সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে এক দফার আন্দোলন অবধি ছত্রিশ দিনের এই মহাযাত্রা অন্ততপক্ষে হাজার খানেক মানুষের রাষ্ট্র কর্তৃক নিহত হওয়ার ফলাফল। এখনও কয়েক হাজার মানুষ হাসপাতালে আহত অবস্থায় আছেন। এখনও অনেক মানুষকে তাদের পরিবার খুঁজে পাচ্ছেন না। ‘আয়নাঘর’ শব্দটি শুনলে কবিতার বইয়ের নামের কথা মনে পড়ে বা কাব্যময় উপন্যাস। আমরা দেখেছি এই ঘরে বিরুদ্ধ মতের মানুষদের কত অমানবিকভাবে বন্দি করে রাখত রাষ্ট্র।’
সে ঘুম ভাঙার পর ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি নিরু। বারবার রাস্তায় বেরতে চেয়েছে। মিছিলে থাকতে চেয়েছে। তার মনে পড়ে গিয়েছিল, একটা সময় সে মিছিলেরই সন্তান ছিল। বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়, লং মার্চে তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দরের আন্দোলনে কত কত জেলাতেই না সে ঘুরেছে! এবার একটা দিনের জন্য সে বেরতে পারল না। তার মা-বাবা-বোন সবাই খুব প্যানিকড হয়েছিল। যেন বের হলেই মেরে ফেলবে রাষ্ট্রের পুলিশ। একমাত্র ছেলে, ভয় স্বাভাবিক। মহান বিপ্লবীদের মতো সাহস নেই নিরুর। দু’একটা পোস্ট সে নিজেও মুছে দিয়েছে, ফেসবুকে। কিন্তু সে লিখে গিয়েছে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে, ক্রমাগত। কয়েকজনের রেজিমপ্রিয় বন্ধু তাকে ভয় দেখিয়েছিল, ফোন করে। অস্বস্তিতে ঘুম মুছে গিয়েছিলো ২১ দিন। অবসাদে চোখ বন্ধ হয়ে আসার নাম ঘুম নয়। অনেক দিন আগে বলেছিল তার এক ছোট বোন। মনে পড়লো নাম– সুহি- আহা! সে এখন কত দূরে! এক বইপড়ুয়া অনুজ বন্ধুর একটি ইনবক্স চিরকুট তাকে সাহস দেয়, ‘দাদা, আপনি একদম ভাববেন না। কথা দিচ্ছি, আমি আঠারোর ছাত্র আন্দোলনে পথে ছিলাম। এইবার আপনার জন্য হলেও পথে থাকব, যদি আপনার কিছু হয়। এটা এমনি এমনি বলছি না ভাই। আল্লাহর কসম, আমি আমার বন্ধুরা মিলে আপনার জন্য পথে থাকব।’ জ্যাক ডওসনের সঙ্গে কোনও দিন দীর্ঘ আলাপ হয়নি। কিন্তু, আঠারোর সন্ধ্যায় নেট বিলুপ্তির আগে এই ম্যাসেজ তাকে সাহস দেয়।
নিরুদের বাসার নিচে রাতের তিনটার দিকে এক ভদ্রলোক অফিস থেকে ফেরেন। তার কালো গাড়ি হর্ন দেয় বাসভবনের গেট খোলার জন্য। অথচ এই হর্ন ২১ দিন তাকে আতঙ্কিত করেছিল। ফেসবুকে ভেসে ওঠা ছিন্ন ভিন্ন শরীর আর ক্ষমতাসীনদের ঔদ্ধত্য তার দিনগুলি ভরিয়ে দিয়েছিল অস্বাভাবিক এক সন্ত্রাসে। শিশু শরীরে বুলেটের দাগ সহ্য করতে পারেনি। আর কিছুদিন যদি এভাবে কাটাতে হত সম্ভবত কোনও মানসিক হাসপাতালে যেতে হত তাকে। বাবার কোলে বেঘোরে মরে যাওয়া রিয়া গোপ কিংবা জল বিতরণ করতে থাকা মীর মুগ্ধের নিহত হওয়া সে একেবারেই নিতে পারেনি। নিরুর মনে বেশিরভাগটাই ফেমিনিন। ৪৩ বছর বয়সে এখনও সস্তা সিনেমা দেখে কাঁদার মতো মন। এই একুশ দিনে রুমির সঙ্গে যোগাযোগটা অনেক কমে গিয়েছে কেননা রুমি আন্দোলনকে ঠিক মনে করেনি। তার মনের তারটা পুরনো রেজিমের মুক্তিযুদ্ধের বাণিজ্যিক চেতনায় বাধা, আরও যে নানারকম বয়ান হতে পারে– এতে সে বিশ্বাস করে না। ফলে, আমাদের নিরু দিনপঞ্জিকেই আঁকড়ে ধরেছে একমাত্র আশ্রয়ের মতো– ‘পদার্থবিজ্ঞানে আছে, নবম শ্রেণিতে পড়েছিলাম– স্থিতিস্থাপকতা অধ্যায়। পীড়নের ফলে বিকৃতি ঘটে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সামগ্রিক স্বাধীনতা এবং সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্বের স্বপ্ন দেখেন। আমরাও দেখেছি। পুরনো স্বৈরমূলক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ অত্যন্ত জরুরি ইতিহাসে, দেশে দেশে কালে কালে। যখন রাষ্ট্র তার সকল শক্তি নিয়ে দমনে অবতীর্ণ হয় শিল্পী সমাজ সর্বসাধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আমরা এই ৩৬ দিনের বিদ্রোহের ইতিহাসের নাম দিতে পারি জুলাই বিদ্রোহ। জেন জি’র সর্বাত্মক অধিকারের সংগ্রাম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় গত অনেকগুলো বছর আমরা কেউই প্রাণ খুলে কথা বলতে পারিনি। এমনকী, গত দিনগুলোতেও রাতের বেলা আতঙ্কে কেটেছে। রেজিমের পতন হওয়ার আগে বাসার নিচে এমনকী, কোন গাড়ি হর্ন দিলেও ভয় হত, সাদা পোশাকের পুলিশের ভয়।’
৩.
দাঁড়িঅলা চুলবিরল এক মানুষ ঝুঁকে বসে আছেন চেয়ারে। দুই হাতে ঢাকা মুখ, তীব্র এক ক্ষোভে, বেদনায় সারা শরীর যেন কাঁপছে। নীল জামা প্যান্ট পরা মানুষের ছবিটির নাম, ‘অ্যাট ইটারনিটিজ গেইট’। একই নামের এক চলচ্চিত্রে ভ্যান গগের চরিত্রে কী অসামান্য অভিনয় করেছেন উইলেম ডেফো! নিরুর মনে পড়ে, আধো শোয়া হয়ে ডেইলি আর্ট ম্যাগাজিনের নিত্যদিনের বুলেটিনে ‘ইলেভেন স্যাডেস্ট পেইন্টিং ইন দ্য হিস্ট্রি অফ আর্ট’ নিবন্ধ পড়তে পড়তে। ভ্যান গগের নিজের জীবন ব্যক্ত হয়ে আছে অব্যক্ত বেদনার এই ছবিতে। চিত্রকলার ইতিহাসের সবচেয়ে বিপন্নতার ছবি বলা হয় । তার পরে দেখে, সাদা নীল পোশাকের ধ্বস্ত নারীটির ছবির নাম: ল্যে দুল্যেউর বা দুঃখ। পল সেজানের এই ছবিতে খোদ বিপন্নতার দেবতাই অবসন্ন, উপস্থিত। অ্যান্ড্রু ওয়েইথের ক্রিস্টিনাস ওয়ার্ল্ডে আমরা দেখতে পাই, প্রান্তরের ঘাসে বসে থাকা এক তরুণীকে, পেছন দিক থেকে। দূরে আকাশ ও ঘরবাড়ি, সে অত্যন্ত একা। রোকোকো চিত্রকলার বিস্ময়কর এক প্রতিনিধি লুই জঁ ফ্রাসোয়া ল্যাগ্রিনের লা মেলানকোলি– গ্রিক দেবীদের মতো সুন্দর, স্বাস্থ্যবতী এক নারী, গালে হাত বসে আছেন। পাবলো পিকাসোর নীল দশা বা ব্লু পিরিয়ডের ব্লু গিটারিস্টের আঁকড়ে ধরে রাখা গিটারকে আমরা কেউই ভুলিনি। নিজে নিজেই নিরু মাথা নাড়ে। ভোলা সম্ভব নয়। চিত্রকর অ্যাডগার দেগা বান্ধবী ইলিনকে এঁকেছেন পানশালার পটভূমিতে। এক গ্লাস আঁবসাৎ পানীয় নিয়ে বসে আছেন তিনি, চুপচাপ। পাশের পাইপ মুখে মানুষটি কতটাই না দূরবর্তী তার! এডওয়ার্ড মুঙ্খের ‘দ্য স্ক্রিম’ ছবির প্রভাব পড়েছিল এমনকী, রবীন্দ্রনাথেও। রবীন্দ্র চিত্রাবলিতে হাজার দুয়েক ছবির ভিড়ে এমন কয়েকটা ছবি চোখে না পড়ে পারেনি। তারই এক ছবি ‘মেলানকোলি’। সমুদ্রের দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকা এক দরিদ্র মানুষ। যেন, সমুদ্র দেখার মন-ও আর অবশিষ্ট নেই। এই ছবি একাধিকবার এঁকেছিলেন মুঙ্খ। হয়তো নিজের বিপন্নতাকে ভুলতে চাইছিলেন তিনি। এডওয়ার্ড হপারের অটোম্যাট ছবিতে একটি মাত্র হাতমোজা পরা কেন মেয়েটি– চুপচাপ বসে আছে ঘন রাতে, আরেকটি হাতে ধরেছে নীল কাপ। জানালার বাইরে সারি সারি আলো, যে কোনও মহানগরের রাস্তায় যেমন। সিনেমা হলের বেরনোর দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটি স্বর্ণকেশী, নীল জামা পরনে, মন নেই চলমান চিত্রমালায়। কারও জন্য অপেক্ষারত।’ ‘নিউইয়র্ক মুভি’ ছবির নাম, হপারেরই আঁকা। ফ্রিদা কাহলো, বিশ্ব চিত্রকলার ইতিহাসের ক্ষতবিক্ষত চিত্রকরের ক্ষতবহুল হরিণী, যার শরীর জুড়ে তীর গেঁথে আছে! ১১ নম্বর ছবি পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে অব্দি পৌঁছানোর আগেই ঘুমে চোখ বুজে এল। নীল জামা স্বর্ণকেশীর সঙ্গে সিনেমা দেখতে ঢুকেই হপারের সঙ্গে দেখা। ‘ও দুষ্টু, তুমি ভেতরেই ছিলে, আর আমি ভেবে মরি!’ মেয়েটির স্বর কানে রিনিঝিনি এক শব্দ। শরীরে আলতো ধাক্কা, চার ছুঁই ছুঁই অত্রি, ভাগনি ডাকছে খেলতে। লেগো সেট আর খেলা খেলা রান্না।
রোদ মরে এসেছে। কখন সময় কেটে যায়! আজ এক মাস ছয় দিন। রুমি যখন তাকে ১২ অগাস্ট ‘ডাবল ফেস’ বলেছিল তারপর আর যোগাযোগ করেনি। ঘৃণাকে কোনও কিছু দিয়ে এনকাউন্টার করা যায় না। এক রুমি বলেছিলেন– ক্ষত হল সেই স্থান যা দিয়ে আলো প্রবেশ করে। এই রুমি সে রুমি নয়। এখনকার রুমি ক্ষত তৈরিতে পারঙ্গম। রবীন্দ্রপাঠ, শঙ্খপ্রেম আর বুদ্ধের প্রতি নিবেদন তাকে বদলাতে পারেনি। আহত নিরু নিজের অবস্থান বিশদে বোঝালেও, ভুল ব্যবহারটির জন্য অনুতপ্ত হয়নি সে। বহুতল থেকে ফেলা গরম ভাত মাড় ফেললে কুকুর ছানার যে দশা ঘটে, নিজের আত্মার অনেকটা গভীর অবধি দগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু, ৬ আগস্ট প্রকাশ্য সমাবেশে নিরু বলেছিল– এই নতুন সরকার কি পাহাড়ে সেনা শাসন প্রত্যাহার করবে? ৮ তারিখ আরেক সাংস্কৃতিক সমাবেশে বলেছিল– কেবল আওয়ামী রাজনীতি করার জন্য কারও গায়ে হাত তোলা যাবে না। একটি সহিংস রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে আরেকটি সহিংসতার জন্ম দেওয়া যাবে না। তবু, নিজের ভালোবাসার নারীর– আর ভাবতে ভালো লাগছে না। নিজেদের আবাসিক এলাকায় টহল দিয়ে এল। পাহাড়ে অশান্তির টুকিটাকি খবর আসছে। মাজার ভাঙা হচ্ছে। মন্দির বা প্রতিমা ভাঙচুর নতুন কিছু নয়। সে তো তিয়াত্তর থেকে চলমান।
রাতে মাংস ভাত খেয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতে তোফাজ্জলের মুখ দেখল প্রথম। মানুষটিকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। পিটিয়ে মারার আগে খেতে দেওয়া হয়েছিল ভাত। তার ভাত খাওয়ার দৃশ্য ফেসবুকে মোটামুটি ভাইরাল। তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল খাবারের মান কেমন– তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, খাবারের মান ভালো। চোর সন্দেহে তাকে পিটিয়ে মারা হয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র গণপিটুনিতে অংশ নিয়েছিল। তোফাজ্জল নামের মানুষটি প্রেমে সফল হতে না পেরে, অভাবে, দারিদ্রে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। তিনি যখন ছোট ছোট গ্রাসে ভাত খাচ্ছিলেন, ঢেলে নিচ্ছিলেন ডাল, একটি বারের জন্য বুঝতে পারেননি, এই তার শেষ খাওয়া। আত্মীয়ের কাছে স্নেহবঞ্চিত মানুষটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিজের মতো ঘুরে ফিরে থাকতেন। তাকে হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগের দু’টি সেলফি চোখে পড়ে। হাসিমুখ তোফাজ্জল, তার চোখ-সুদ্ধ হাসে। দুপুরে দেখা ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখের, বিবর্ণতার ১১টি ছবি। তার মনে হয় গণপিটুনিতে মারা যাওয়া মানুষের ছবি কোনও দিন কোনও চিত্রকরের পক্ষে আঁকা সম্ভব হবে না। এমন ঘটনার বহুস্তরীয় অভিঘাত রং তুলিতে ধরা প্রায় অসম্ভব। রাত বাড়ে। ফেসবুক স্ক্রলে তোফাজ্জলের আরও আরও ছবি আসে। প্রায় দেড় মাস জুড়ে শোনা ‘ইনক্লুসিভ’ শব্দটা বারবার ঘুরতে থাকে মাথায়। নিজেকে হারিয়ে ফেলা মানুষটির কোন মরণোত্তর মর্যাদাও থাকবে না। রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয় তার ভার বহন করা। সমূহ প্রেম আর বেদনা নিয়ে একদিন মাটির সাথে মিশে যাবেন তিনি । একবিংশে শোকের স্মৃতি বিন্দু পরিমাণ। কেউ মনে রাখবে না তাকে। হালকা হওয়ার জন্য বাথরুমে যায় নিরু । আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের খানিকটা প্রিভিলেজড অবস্থার জন্য সেল্ফগিল্ট অনুভব করে।
আর কী আশ্চর্য, প্রথমবারের মতো নিজেকে দ্বিমুখী প্রাণী মনে হয়। কেন না, এই হত্যাকাণ্ডটি প্রতিরোধ করতে পারেনি সে। নিতে পারেনি কোনও ভূমিকা। শুধু মুখে বড় বড় কথা। রুমি ঠিক বলেছিল। আমার তীব্র ব্যথা ঘটেছিল। তবু ভালোবাসি। বুনুয়েলের নাজারিন– ইউ আর আগলি বাট আই লাভ ইউ…
অপমানে আর গ্লানিতে তার চোখ জলে ভরে আসে। বাথরুমের মেঝেতে থেবড়ে বসে কাঁদতে থাকে একা একা। সবাই তখন ঘুম।
রাত বাড়ছে ।
আজ যখন আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্বকে নতুন চোখে দেখে কমিউনিস্ট ইতিহাস রচনার কথা ভাবি, তখন একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নারীবাদী ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের মেয়েদের এই বিপ্লবী কমরেডশিপের সম্ভাবনার, নারীবাদী বন্ধুত্বের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে।