পুজোর পঞ্চম গল্প সৌকর্য ঘোষালের। সঙ্গের অলংকরণগুলিও তাঁর।
দাঁত মাজার সময় আয়নাটা কথা বলে উঠল।
–চোখে ছানি-টানি পড়ল নাকি? তোকে এর’ম আবছা দেখায় কেন?
ঋৎচিৎ তাড়াতাড়ি ওর বাঁ-হাতের তালু দিয়ে আয়নার কাচে জমে থাকা বাষ্পের স্তরটা মুছে দিল। প্রথমে জিগজ্যাগ, তারপর লম্বালম্বি। সযত্নে।
–এই তো এবার পষ্ট!
বলে উঠল আয়না।
আয়নাটা অনেক সিনিয়র বলে ঋৎচিৎকে তুই-তুকারি করে। সেই ঠাকুমার আমলের জিনিস। আগে ঠাকুমার ঘরে থাকত। পরে ঋৎচিৎ-এর বাবা ওটা বাথরুমের বেসিনের ওপর টাঙিয়ে দেয়। এই বাথরুমটা আগে ওর বাবা মা-ই ব্যবহার করত। কোভিডের বছর দু’জন চলে গেল ঋৎচিৎকে একা ফেলে, তারপর থেকেই ঋৎচিৎ ব্যবহার করে বাথরুমটা। ঋৎচিৎ-এর ঘর লাগোয়া বাথরুম যে খুব খারাপ, এমন নয়। কিন্তু ওখানে কেউ কথা বলে না ওর সঙ্গে। অবশ্য এই আয়নাটাই যে শুধু ওর সঙ্গে কথা বলে, এমনটাও নয়। ডাইনিং টেবিলের চারটে চেয়ারের মধ্যে দুটো চেয়ার বলে। ওর বেডরুমের সিলিং ফ্যানটা বলে। হলঘরের দেওয়াল ঘড়িটা, একটা কাচের শো কেস আছে– যেটার মধ্যে মা ক্রকারি রাখত সেটা, বারান্দার রেলিং, ওর পাশবালিশ– সবাই বলে। নিয়মিত। যেমন আর পাঁচটা বাড়ির লোকজন বলে পরিবারের সঙ্গে। সেরকমই।
সত্যি কথা বলতে কী, এই কথা বলাবলির ব্যাপারটা কিন্তু আগে ছিল না। আগে যে খুব একটা সময়ও ছিল, তাও নয়। টেলিভিশনে যেই মেগাটায় লিড করত ও, সেটা পুরো শুষে নিত ওকে। ছুটি দিত একদিন। প্রতি মাসের দ্বিতীয় রবিবার। সেদিনটা ও মোটামুটি বিছানাতেই কাটাত। দুপুর অবধি একা। দুপুরের পর শ্বেতা এলে দু’জনে। কখনও কখনও ইচ্ছে হলে ঢুঁ মারত সন্ধেবেলা, পাবে বা সিনেমা হলে। ব্যস! পরদিন থেকে আবার মিটার চালু– ক্লোজশট। মিডশট। লংশট। ডায়মন্ড। থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর। কোভিডে মেগাটা বন্ধ হয়ে গেল, ঋৎচিৎ ঠিক করল বোনের দাদা, গৃহিনীর বর, মায়ের সন্তান, টিআরপি-র পুতুল অনেক হয়েছে। এবার অভিনেতা হবে। বার্ডম্যানের মাইকেল কিটন-এর মতো। তার জন্য ওকে একা থাকা অভ্যাস করতে হবে আগে। ডুবে যেতে হবে নিজের মানসে।
এসবের তালেগোলে প্রথমেই শ্বেতার সঙ্গে প্রেমটা ভাঙল। এরপর করোনা মাকে নিয়ে নিল, তারপর বাবাও গেল। সোশাল ডিস্টেনসিং করতে খুব একটা তাই কষ্ট পোহাতে হয়নি ওকে। কোনও এক দুপুরবেলা ফাঁকা ফ্ল্যাটে হাউহাউ করে কাঁদছিল ও বালিশ জড়িয়ে। হঠাৎ কানের কাছে কেউ একটা ফিসফিস করল–
–আস্তে…
চমকে উঠল ঋৎচিৎ! ভূতে ওর মোটে বিশ্বাস নেই, তাহলে কি মনের ভুল?
পাশবালিশ আবার বলল,
–কী হল? থামলে কেন?
সেই থেকে ঋৎচিৎ শুনতে পায় জড়ের ডাক। একদিন তো ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার বলে উঠল,
–দু’দিন চান করিসনি ঘামের গন্ধ বেরচ্ছে, সর!
ঋৎচিৎ একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গেল। বেখেয়ালে ছাইটা পড়ল রেলিঙের ওপর। রেলিঙটা এমনি একটা ‘উফ্ফ্’ করে বলে উঠল–
–ছ্যাঁকা দিচ্ছিস কেন?
ঋৎচিৎ বিরক্ত হল। একে ওর মন ভালো নেই!
রেলিং আবার ফুট কাটল,
–তা বলে মুখটা অমন বাংলার পাঁচের মতো করে দাঁড়িয়ে থাকিস না। চানটা করে আয়, অনেক বেলা হল।
সিগারেটর শেষ টানটা দিতেই ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং। ঋৎচিৎ দেখল ঘড়িতে ঠিক পাঁচটাই বাজছে। অবাক কাণ্ড! তবে আরও অবাক করে ঘড়িটা নির্লজ্জ্বর মতো খ্যাঁক খ্যাঁক হেসে উঠল,
–কী রে? কী ভাবছিস? ইংরেজির পাঁচ, বাংলার পাঁচের চেয়ে দেখতে ভালো কি না?
ঋৎচিৎ রাগের চোটে বলে ফেলল,
–ব্যাড জোক!
ও কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? হিথ লেজারের মতো মরে যাবে না তো? ওর কী করা উচিত এখন? গুগল করল। সার্চ ইঞ্জিনের কার্সার দপদপ করছিল মাথার মতোই। টাইপ করল। WHY AM I HEARING VOICES? এক গাদা সাজেশন চলে এল– MENTAL ILLNESS, BIPOLAR DISORDER, PSYCHOSIS, SCHIZOPHRENIA, CONSULT A DOCTOR। সর্বনাশ! তার মানে ও সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছে! আবার টাইপ করল। BEST PSYCHIATRIST NEAR ME. আবার অনেকগুলো সাজেশন। ডাক্তারবাবুদের নাম, অ্যাড্রেস, ফোন নম্বর। এসব পরিস্থিতিতে শান্ত মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া একটা উত্তাল ঝামেলার কাজ। তার মধ্যে শালা অপশনের বন্যা। খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো একটা অপশনে ক্লিক করল ও। ডাক্তারের নাম আদিত্য মিত্র। অ্যাপয়েনমেন্ট হল পরশু। কেন যে আদিত্যকেই ফোনটা করল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। কোনও রিসার্চ করেনি। যুক্তি দিয়ে মেপে দেখেনি রেপুটেশন। ইনপিন সেফ্টিপিনও যে করেছে এমন নয়। জাস্ট করে দিল। ইন্টিউশনে। যার সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক নেই।
দুই
সেদিন বিকেল বেলা ডক্টর আদিত্য মিত্রের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে ঋৎচিৎ প্রথমেই গেল ওষুধের দোকানে। দোকানের ছেলেটা কী অবলীলায় প্রেসক্রিপশনের কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাংগুলো পড়ে নিয়ে ট্যাবলেট ক’টা খামে ভরে বিল কেটে দিল। মানিব্যাগ থেকে যে নোটটা ও বের করল, সে হঠাৎ বিলাপ করে উঠল,
–বিদায় বন্ধু! আর কখনও দেখা হবে কি না জানি না। সাবধানে থেকো।
এই সেন্টিমেন্টাল ব্ল্যাকমেলগুলোয় ঋৎচিতের গা রি-রি করে। তাই পাত্তা দিল না। নোটটা দোকানির হাতে চালান করে দাম মিটিয়ে বেড়িয়ে পড়ল দোকান থেকে। রাস্তার এক ধার ধরেই হাঁটছিল সাবধানে। ফুটপাতে তো মানুষ এখন যায় কেনাকাটা করতে। অফিসটাইমের ফিরতি গাড়ি আর দু’চাকারা অশ্লীল গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছে ওকে, সিগনালের লালের ভয়ে।
সিগনাল হলুদ হলে আরও বোঝা যায়– কে কতটা স্বার্থপর। চালকরা সময় নষ্ট করে না, কথা বলে না, শুধু বিবিধ গাড়ি একে-অপরকে খিস্তায় ব্র্যান্ড মাফিক প্যাঁ পোঁ, পিঁপ ডাক তুলে। এত কিছুর মধ্যেও ঋৎচিৎ-এর কানে একটা কথা ভেসে এল। ট্রাফিকের কোলাহলে স্পষ্ট নয়, তবে একটা আর্তনাদ, কে ডাকল? ওর মনে হল পাতালের ভেতর থেকে একটা চিৎকার ছুটে আসছে ওর দিকে। ও নেমে পড়ল রাস্তায়। মাঝামাঝি আসতেই স্পষ্ট হল ডাকটা। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও। কান পাতল পথের উপর। এবার পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।
–আমার লাগছে। এত দিন ধরে বলছি কেউ শুনতে আসেনি জানো? আমার ওপর দিয়ে অনর্গল চলে যায় দু’চাকা, চারচাকা, ছয়, বারো কত কী! আমারও যে সহ্যের সীমা আছে একটা সে কথা কেউ ভাবে না। কত চেঁচিয়েছি, কত কেঁদেছি, তবু মানুষ শুধু থুতু ছিটিয়ে গেছে। কেউ কেউ কফ্। কেউ গুটকার বমি। আজ কত হাজার বছর পর এই প্রথম কেউ বসল নতজানু হয়ে।
এর পরেও হয়তো আরও কিছু কথা ছিল পথের কিন্তু কেমন একটা ফাটা রেকর্ডের মতো ঘরঘর করে উঠল। চারদিকের কোলাহল তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যেন ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে এক দানব। তার গলায় ঘণ্টি। জানান দিচ্ছে টুংটুংটুং। এবার কেউ কলার ধরে টেনে তুলল ঋৎচিৎকে। পুলিশ।
–ওঠ শালা ওঠ্! নাটক হচ্ছে মাঝরাস্তায়?
ও দেখল ওর ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা আস্ত ট্রাম। ওকে আবার ডাকল টুং টুং। রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে। ফুটপাথের লোকেরা ওরই প্রাণের আতঙ্কে সবাই চেঁচাচ্ছিল এতক্ষণ। পুলিশ ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে তুলে দিল গাড়িতে। ঋৎচিৎ-এর কিন্তু লজ্জা লাগাল না। বরং আফসোস হল। কী যেন আরও বলতে চাইছিল পথটা। ট্রামের ঘরঘরে মিলিয়ে গেল শোনার আগেই। কেন যে শালা ট্রাম চলে এই পোড়া শহরে? কবিকে খুন করার অপরাধে কবেই তো তার জেল হওয়ার কথা ছিল। আজ একটু হলেই আর একটা হত। ঋৎচিৎ ভাবলও– ও কি তাহলে অত বড় প্রতিভা? জীবনানন্দও কি শুনতে পেতেন জড়ের ডাক?
থানার ভেতর ঋৎচিৎ অনেকক্ষণ বসেছিল। এক কোনায়। দু’-ঘণ্টা পর বড়বাবু ডাকল মোটাসোটা লোকটা ইউনিফর্ম পরে মস্ত রিভলভিং চেয়ারে একটা মস্ত টেবিলের পিছনে বসে। ঘরে আরও জনা চারেক মেজো সেজো পুলিশ। বড়বাবু হাতের পাতাটুকু দিয়ে ইশারা করল ঋৎচিৎকে বসার জন্য।
–আপনাকে তো দেখে মনে হয় ভদ্রলোক। কী করছিলেন রাস্তায় শুয়ে শুয়ে? আর একটু হলেই…
ঋৎচিৎ প্রতিবাদ করল,
–আমি শুইনি স্যর।
–তাহলে?
–আমি শুনছিলাম।
বড়বাবু এবার টেবিলে ভর দিয়ে এগিয়ে এল। চোখমুখ কুঁচকে অবাক হয়ে বলল,
–শুনছিলেন?
ঋৎচিৎ বুঝতে পারছে ও যেটা বলবে, সেটা বিশ্বাস করবে না কেউ। তাও মন শক্ত করল। ঢোঁক গিলল। তারপর বলল,
–হ্যাঁ স্যর, রাস্তা কথা বলছিল আমার সঙ্গে।
ঘরে বাকি পুলিশদের মুখে এবার হাসি ফুটতে শুরু করেছে। আজ সন্ধের এন্টারটেনমেন্টটা পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে। বড়বাবু চেয়ারের ব্যাকরেস্টে ফিরে গেছেন। স্মিত হাসিতে ফোলা গালদুটো আরও চকচক করছে। দুলতে দুলতে জিজ্ঞেস করল,
– ইন্টারেস্টিং! তা কী বলছিল রাস্তা?
–বলছিল এত গাড়ি ঘোড়া যায়, ওর ব্যথা লাগে। একটু কম গেলে ভালো হয়। তারপর লোকে থুতু ফেলে।
খুব কনভিনসিংলি ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করল ঋৎচিৎ। বড়বাবুর শান্ত প্রশ্ন,
–আপনি থাকেন কোথায়?
–সাদার্ন অ্যাভিনিউ।
– বাড়িতে আর কে আছেন?
–আমি একাই থাকি।
–কী করেন?
–অভিনয় করি। মানে করতাম।
–সিরিয়াল?
গায়ে লাগল ঋৎচিৎ-এর। এমন একটা টোনে সিরিয়াল কথাটা উচ্চারণ করলেন বড়বাবু, যেন মুজরো। তাও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন,
–আপনি ওখানে কী করছিলেন তাহলে?
–আমি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম।
পকেট থেকে প্রেসক্রিপশনটা বের করে দেখাল ঋৎচিৎ। কাগজটা হাতে নিয়ে বড়বাবু ভুরুদুটো কপালে তুলতেই ঋৎচিৎ লক্ষ করল কতগুলো ভাঁজ পড়ল ওঁর কপালে। টেবিল ল্যাম্পের আলোটা সাদা কাগজে পড়তেই মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওঁর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বড়বাবু একটা অমায়িক প্রশ্ন রাখলেন–
–কালকে যদি আপনি কোনও মহিলার বুকে গিয়ে কান পাতেন তখন কী হবে? আপনি বলবেন আপনার কিছু করার ছিল না? স্তনদুটো আপনাকে ডেকেছিল? এ তো অসামাজিক রোগ মশাই!
হাসির রোল উঠল গোটা ঘরে। একজন এস.আই ফুট কাটল–
–কানকাটা রোগ স্যর।
বড়বাবু কথাটা প্রায় কানে না তুলে একটা অনুরোধ করল,
–শুনুন, আপনি একটা কাজ করুন। যতদিন ট্রিটমেন্ট চলছে বাড়ি থেকে বেশি বেরনোর দরকার নেই। ভুলভাল কিছু একটা হয়ে গেলে…
ঋৎচিৎ থামাল,
–আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না স্যর। ব্যাপারটা আমার হাতে নেই। মানে কথাগুলো নিজের থেকে আমার কানে চলে আসে। সে আমি যেখানেই থাকি।
বড়বাবুও সায় দিল–
–আমি বুঝতে পারছি স্যর! আমার ডান্ডাটাও আপন থেকে লোকের পোঁদে ঢুকে যায়। আমার হাতে থাকে না।
হাসির যে লহরিটা এবার গোটা ঘরে ছেয়ে গেল, তাতে ঋৎচিৎ-এর মনে হল ওকে নগ্ন করে দেখছে সবাই।
রাত অনেকটা হয়ে গেছে। কিন্তু ঋৎচিৎ ঠিক করেছে ও হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরবে। কোনও অটো, উবার, বাস ও চড়বে না। ওর ইচ্ছে করছে না কারও সঙ্গে কথা বলতে এখন। ভালো লাগছে না মানুষের সংসর্গ। যে সিগারেটটা ধরিয়েছিল, টানতেও ভুলে গেছে। আগুন আগুনের নিয়ম মেনে এসে দাঁড়িয়েছে দু’আঙুলে ধরা ফিল্টারের মুখোমুখি। ব্র্যান্ডের লোগোকেও মার্জনা করেনি। ছ্যাঁকা খেল ঋৎচিৎ। টিপ করে ছুড়ল। সিগারেট বাড্ একটা গর্তের নোংরা জলে তলিয়ে গেল। কেউ কি আবার ডাকল ওকে? না, ও কান দেবে না। ব্যাপারটা যেন আজ ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পর থেকে একটু বেশিই বেড়ে গেছে। ডক্টর আদিত্য বলে দিয়েছেন, এই সবকিছুই ওর কল্পনা মাত্র। অভিনয়ের খ্যাপামো ওকে খ্যাপাচ্ছে আসলে। ক্রমাগত। কিন্তু অভিনয় নিয়ে ঋৎচিৎ কি খ্যাপামো করেছে? কিছুই না। ও শুধু চেয়েছিল অভিনেতা হিসেবে সর্বক্ষণ নিজের চারপাশের স্পেসটার সঙ্গে কমিউনিকেট করতে। কখন পকেটে হাত দেবে। কখন গিয়ে চেয়ারের হাতলে আঙুলের তাল তুলবে। কখন হোঁচট খাবে। কখন কোনদিকে দেখবে, সবটা যেন সর্বক্ষণ চেতনার অনাবিল ছন্দ থেকে আপনি উঠে আসে। মাথা দিয়ে, বুদ্ধি খাটিয়ে, আগে থেকে যেন হিসেব না কষে রাখতে হয়। যেমন করে মেঘেরা কোনও হিসেব করে না। কিংবা মহাকাশের গ্যালাক্সি। পরমাণুর ভেতরেও ইলেকট্রন-প্রোটনেরা যেমন বুদ্ধি খাটিয়ে অঙ্ক করে না নিজেদের গতায়ত। তবু ধাক্কা দেয় না কেউ কাউকে। অবরুদ্ধ করে না কারও পথ। ঠিক সেভাবেই অনাবিল, অনায়াস চেতনার স্পন্দনে স্পন্দিত হবে ও। ফন্দি তো অভিনয় নয়। তাকে ‘স্কিল’ বলা যেতে পারে বড়জোড়। তবু সে ফেক ট্রুথ নয়। ঋৎচিৎ আসলে চেয়েছিল শুধু ট্রুথকে ব্যক্ত করতে। তার ছন্দে প্রকাশ করতে চেয়েছিল অভিনয়। ঠিক ওর নামের মতোই।
এখনও ওর কানে আসছে ডাকটা। যেন খুব ব্যথা পেয়েছে কেউ। ঋৎচিৎ-এর চোখ গেল ফুটপাথের পাশে রক্তের দাগের ওপর। তার অদূরেই একটা পাথর। রক্তাক্ত। যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। পাথরটা হাতে তুলে নিতেই গোঙানির মধ্যে সে বলে উঠল–
–এই রক্ত আমার নয়। আমাকে ব্যবহার করে একজনের মাথা ফাটানো হয়েছে একটু আগে। একটা ড্রাইভারের। সে পরকীয়া করছিল মালিকের বউয়ের সঙ্গে । ওই দুটো স্ট্রিট লাইটের অন্ধকার মাখা মধ্যাহ্নে ওরা দু’জন ঘন হচ্ছিল যখন, মালিক চলে আসে কোত্থেকে। তারপর আমাকে কুড়িয়ে পেয়ে বসিয়ে দিল ড্রাইভারের মাথায়। বউটা ভয়ে কেঁদে উঠল। মালিক তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল গাড়ি করে। ওর বউ যাওয়ার সময় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল, হতে পারে সে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা কিন্তু বউয়ের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার অধিকার কেউ দেয়নি তাকে। স্বামী কানেই তুলল না সেসব। ধাক্কা মেরে গাড়িতে তুলল বউটাকে। গাড়ির নম্বর আমার মনে আছে।
কিন্তু সেই ড্রাইভারকে তো ঋৎচিৎ দেখতে পাচ্ছে না। সে কি মরে গেছিল? কারা সরাল বডি? পাথর বোধহয় জানত এসব সম্ভাব্য প্রশ্ন। তাই ঋৎচিৎকে আর করতে হয়নি। তার আগেই সে আবার বলে উঠল,
–একটা পুলিশের গাড়ি টহল দিতে এসে ড্রাইভারকে দেখল পড়ে আছে এই এখানটাই। ওরা ওকে কোথায় যে নিয়ে গেল জানি না। কিন্তু সেই মালিক যে আমায় বসিয়েছিল ড্রাইভারের মাথায়, এমনভাবে ছুড়ে ফেলল আমাকে দরকার ফুরিয়ে যেতেই, আমি ঠোক্কর খেয়ে ছিটকে পড়লাম দশ হাত দূরে। কয়েক মিনিট যন্ত্রণায় অবশ হয়ে গেছিল শরীর। পুলিশের লোক যারা এসেছিল কেউ আমার ডাকে সাড়া দেয়নি জানো? শুধু মানুষটাকে নিয়ে গেল।
ঋৎচিৎ কী করবে এবার? ও তো এই পাথরটাকে ফেলে যেতে পারবে না এখানে। জড়চেতনার গহন থেকে উঠে এসেছে যে আর্তি, তাকে উপেক্ষা করলে তো পাপ হবে। মানুষের দেহ নিয়ে রাষ্ট্রর চিন্তা তো থাকবেই। কুকুর-বিড়াল হলে তাদেরও বরাতে জুটত কোনও অ্যানিমাল লাভার কিন্তু এই পাথরের পাশে কে দাঁড়াবে? যে আমাদের সবার থেকে কত প্রাচীন, কত আগে এসেছে পৃথিবীতে! হয়তো জন্ম নিয়েছে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির উষা লগ্নে! এতটা ঐতিহাসিক ডাক সে এড়াবে কী করে?
পাথর ঋৎচিৎকে সব ডিটেল বলেছিল। গাড়ির নম্বর। গাড়ির মডেল। এগজ্যাক্ট টাইম অফ অকারেন্স। পাথরই একমাত্র সাক্ষী গোটা ঘটনার, যার স্বর ঋৎচিৎ ছাড়া পৌঁছবে না কারও কানে। একটা স্টেশনারি দোকান থেকে কাগজ আর কলম কিনে, ঋৎচিৎ হুবহু লিপিবদ্ধ করল সাক্ষীর জবানবন্দি। তারপর সাক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে আবার পৌঁছে গেল থানায়।
ঢোকা মাত্রই এক হাবিলদার ওকে দেখে হাসল। ঋৎচিৎ হয়তো ভাবত ভদ্রতা, যদি না বাকিরাও সেই হাসিতে রগড় করতে যুক্ত না হত। ও বলল,
–বড়বাবুর সঙ্গে একটু দেখা করার ছিল।
– বড়বাবু নেই। রাউন্ডে বেড়িয়েছে।
একজন উত্তর দিল। আসলে এই সাক্ষী-পাথর কেবল একটা ক্রাইম সিনের সাক্ষী নয়, ঋৎচিৎ-এর আত্মমর্যাদার সাক্ষ্যও বটে। একটু আগে বড়বাবুর ঘরে যারা মশকরা করছিল তারা যে কতটা ভুল, প্রমাণ করবে এই পাথর। এর বয়ান মিলিয়ে খোঁজ নিলেই দেখা যাবে ঘটনাটা আসলে সত্যি। এর গায়ে লেগে থাকা রক্ত মিলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে ভিক্টিমের পরিচয়। তারপর পরকীয়ার ঘটনায় মালিক আর ওঁর বউকে জেরা করলেই বেরিয়ে আসবে সত্য। অনায়াসে। আর এসব কিছুর পরেই দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ হয়ে যাবে ঋৎচিৎ-এর দাবি। ও সততই জড়ের ডাক শুনতে পায়। থানার ভেতর সবাই যে যার কাজে গুলে রয়েছে। এস.আই টেবিলে বসে ঢুলছিল। কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে ঋৎচিৎ ডাকল,
–শুনছেন? স্যর?
পুলিশের ঘুম ভাঙল না ঋৎচিৎ-এর এটিকেটে। তাই এবার একটু জোরে ডাকল,
–দাদা শুনছেন? একটা কথা ছিল।
হাঁইহাঁই করে পুলিশটা ঘুম ভেঙে উঠল।
–কী হয়েছে কী?
এই কাগজে একটা পাথরের বয়ান আছে। ওকে কাজে লাগিয়ে একজন একটা মার্ডার করার চেষ্টা করে স্যর। পাথরটাকে আমি সাক্ষী হিসেবে নিয়ে এসেছি।
তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন এস.আই। কাঁচা ঘুমের বারোটা বাজিয়ে এই মশকরাটা ঠিক নিতে পারলেন না। টেবিলে চাপড় মেরে চেঁচিয়ে উঠলেন,
–ইয়ার্কি হচ্ছে? সেই সন্ধে থেকে আপনাকে দেখছি। আটভাট বকে যাচ্ছেন। এটাকে বের কর তো এখান থেকে।
হাবিলদার একটু দূরে দাঁড়িয়ে খেলাটা দেখছিল এতক্ষণ। এগিয়ে এল,
–কী হয়েছে স্যর?
–পাগলাচোদা নাকি পাথরের বয়ান লিখে এনেছে। এ তো গণেশের দুধ খাওয়ার থেকেও ঝামেলা লাগাল দেখছি!
ঋৎচিৎ এসআই-কে আর একবার রিকোয়েস্ট করল।
–আপনি একবার অন্তত পড়ুন লেখাটা–
–চোপ্ গান্ডু! আর একটা কথা বললে গাঁজা কেসে পুরে দেব বাঁড়া–
হাবিলদার বলল,
–দাদা আপনি চলুন। এখন এখানে এসব হবে না।
প্রায় টেনে নিয়ে ঋৎচিৎকে গেটের কাছে নিয়ে এল হাবিলদার। ঋৎচিৎ খুব উতলা হয়ে উঠল,
–আপনি বুঝতে পারছেন না। বড়বাবুর কাছে এই লেখাটা পৌঁছানো খুব দরকার। উনি আসবেন কখন?
–বড়বাবু এখন আসবেন না। কাগজটা আপনি আমায় দিন।
–আপনি বুঝবেন না। এটা স্টেট ইন্টেলিজেন্সের ব্যাপার।
–এরপর কিন্তু আপনাকে সিরিয়াসলি লকাপে ভরে দেব, আপনি দেখে নিন কী করবেন। কাগজটা রেখে বাড়ি যাবেন না লকাপে যাবেন?
ঋৎচিৎ অগত্যা পাথরটা দিয়ে চাপা দিয়ে কাগজটা একটা টেবিলের ওপর রেখে চলে গেল।
খেতে খেতে ফোন ঘাঁটা ঋৎচিৎ-এর একটা স্বভাব হয়ে গেছে। ও জানে এটা আনহেলদি, কিন্তু হেলথ ব্যাপারটা নিয়ে বহুদিন হল ও আর মাথা ঘামায় না। ওর মাঝে মাঝেই মনে হয় ওর শরীর মাথা সবটাই খুব স্থূল। ও যেন একটা আপাদমস্তক বডি অফ মাইন্ড। এই চামড়া। এই রোম। মাংস। মেদ। হাড়গোড়। মল। মূত্র। সবকিছুই ফিনফিনে একটা আস্তরণ। দুধের সরের মতো ঠুনকো। যে জিনিসটা ভীষণ উত্তাপে ফুটে চলেছে ওর ভেতর, তা হল একটা মনন। বেশিরভাগ সময়ই আজকাল উথলে ওঠে। উপচে পড়ে। সেদিন পড়ে গিয়ে হাঁটুটা ছড়ে গেছিল। ব্যান্ডেড লাগাতে গিয়ে মনে হয় যে গোলাপি মাংসটা দেখা যাচ্ছে ক্ষতস্থানের ভেতর সে বলছে,
–দু’মিনিট দাঁড়া একটু হাওয়া খেয়ে নিই।
এসব ভাবতে ভাবতেই কয়েক মাইল আঙুল চালিয়ে ফেলেছে ও ফোনের স্ক্রিনে। একটা ভিডিও দেখে দাঁড়াল। খবরের ক্লিপ। আজ রাতের ঘটনা। সাদার্ন অ্যাভিনিউর রাস্তা থেকে এক ড্রাইভারকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। ড্রাইভারের মালিক বাইট দিচ্ছেন। বলছেন, আজ ড্রাইভার কাজে আসেনি সকাল থেকে। অনেকবার ফোন করেও তাকে ফোনে পায়নি। এই মিথ্যেগুলো যে কোনও খুনিই বলবে ঋৎচিৎ জানে, কিন্তু ওর চোখ আটকে গেল স্ক্রিনের তলায়। ভদ্রলোকের নাম রাকেশ দুবে। পেশায় ব্যবসাদার। ব্যবসাদার? তাহলে যে পাথরটা বলেছিল মালিক গোয়েন্দা? ও তো বয়ানেও তাই লিখল। কোনও ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? টেবিল থেকে ঋৎচিৎ উঠে গিয়ে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সিলিং ফ্যানটা মাথার ওপর গোঁ গোঁ করে ঘুরছে আর বলছে…
পালা ঋৎচিৎ। পালা। তুই অজান্তেই জড়িয়ে গেছিস এই কেসে। কেউ বিশ্বাস করবে না তোকে। শুধু দুয়ে দুয়ে চার করবে। যে পাথর দিয়ে খুন হয়েছে, তার গায়ে লেগে থাকা রক্ত পরীক্ষা হবে প্রথমে। তারপর তোর ফিংগার প্রিন্ট। কোর্টে প্রোডিউস করা হবে বড়বাবুর বয়ান। ডক্টর আদিত্য মিত্রর প্রেসক্রিপশন। ব্যস। এরপর আর তলিয়েই দেখা হবে না আর কার ফিঙ্গার প্রিন্ট রয়েছে পাথরে। ব্যবসাদার আর তার বউকে জেরা করবে না কেউ, কারণ তুই নিজে লিখে এসেছিস কাগজে– খুনি একজন সরকারি গোয়েন্দা। মানুষের কোর্টে পাথরের বয়ান আসলে পাগলের প্রলাপ। বয়ানের লেখকই আসলে খুনি। ওপেন অ্যান্ড শাট কেস্।
ঋৎচিৎ-এর গলা এবার শুকিয়ে আসছে, সিলিং ফ্যান শেষবারের জন্য বলল,
–বড়বাবু কিন্তু আজ তোর প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারের নামটা পড়েছে। আদিত্য ধরের চেম্বারে গিয়ে খোঁজ করলে তোর ঠিকানা পেতে দু’মিনিটও লাগবে না।
কারেন্ট খাওয়ার মতো ছিটকে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। হাতের কাছে জামাকাপড় যা পেল নিজের পিঠের স্যাকে ভরে নিল ঋৎচিৎ। ফোন? না, ফোন নেওয়া যাবে না। সুইচ অফ করে দিল। বাড়ির মেন সুইচ বন্ধ করে অন্ধকার করে দিল। তারপর জুতো পরে বাইরে থেকে যেন দরজা টেনে দিল, দড়াম্।
এটিএম থেকে একবারে পঞ্চাশ হাজারের বেশি তোলা যায় না ওর কার্ডে। তাই-ই তুলল। তারপর একটা হলুদ ট্যাক্সিতে উঠে বলল…
–হাওড়া স্টেশন।
তিন
ছোট থেকেই ঋৎচিৎ-এর মায়াবতী আসার শখ ছিল। সুযোগ হয়নি কোনও দিন। হবেই বা কী করে? মায়ের হাঁপানির জন্য ফ্যামিলি ট্রিপে পাহাড় ছিল নিষিদ্ধ। যখন ও বড় হল রোজগার করতে শুরু করল তখন আর মায়াবতীর কথা মনে পড়েনি। মনে পড়েনি কারণ মায়াবতী বোরিং। বিবেকানন্দ প্রথম এখানে অদ্বৈত আশ্রম তৈরি করেছিল বাবার কাছ থেকে শুনেছিল ছোটবেলায়। কিন্তু কলেজে ঢোকার পর থেকেই এমনভাবে ওর জীবনে ঢুকে পড়ল মার্কস্, ফ্রয়েড, রোমিলা থাপার যে, ধারণার অভিমুখটাই পাল্টে গেল। ও তখন লালপাহাড়ির দেশে যেত টাটকা মহুয়ার খোঁজে। বন্ধুরা গলা ছেড়ে গাইত ‘ধরা পড়ে যায় দেহটাই শুধু, ধরা পড়বে না মন’ আর সুমনকে ভাবত ভারতের ভিক্টর জারা। প্রথম প্রেমের পর কাসাউল গেছিল প্রেমিকার সঙ্গে খাঁটি মালানা তুলতে। কিন্তু যেবার ঋষিকেশ গেল অ্যাসিড করে লেনন শুনবে বলে, ঠিক করেছিল নিজেকে বোঝাবে GIVE PEACE A CHANCE, সেখানেই গুলিয়ে গেল সবটা। হোটেলের বারান্দায় বসে একটা বাঁকা চাঁদ আর ক’টা পেঁজা পেঁজা মেঘের বদলে ও আকাশময় চাক্ষুষ করেছিল শিবের আবক্ষ। ললাটে আড়াআড়ি ভস্ম তিলক আর জটাজালের কোলে অপূর্ব চন্দ্রিল। তারপর থেকেই দন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ব্যাপারটার সঙ্গে খটাখটি লেগে গেল চেতনার। শেষমেশ বস্তুর ভেতর থেকে হঠাৎ অবস্তু কথা বলে উঠল একদিন। ব্যস সব শিক্ষা, অহংকার, তর্ক আফিমের নেশার মতো উবে গেল। রাতারাতি। এক জড়বস্তুর ডাক সপাটে চড় মেরে ওকে বলল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যাপকতার সামনে ওর যুক্তিবোধ নিতান্ত বালখিল্য। ম্যাগনাম ইউনিভার্সে একরত্তি পরজীবী ফুটকি। এসব ভাবতে ভাবতেই বমি পেল ঋৎচিৎ-এর। বেশি সময় দিল না। কাঠের মেঝে বাঁচাতে ধপধপ করে ছুটে গিয়ে বারান্দা থেকে হড়হড় করে উল্টে দিল এতকালের বদহজম। ছোটবেলায় বাসে উঠলেই বমি হত। সে বমির স্বাদ ও জানে। ঝাল ঝাল টক টক। কিন্তু এ বমিটা তিতকুটে। আঁশটে গন্ধওলা। বমি ফুরিয়ে যেতেই ঋৎচিৎ মুখ তুলে তাকাল। ঝুলন্ত বারান্দার নীচ থেকেই নেমে গেছে গভীর খাদ। তারপর দূরে। অনেক দূরে যেখানে ব্লার হয়েছে দিগন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আর বরফ চূড়া। আদিম। নিশ্চল। শান্ত। ওর দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। বইতে পড়েছে এমন উচ্চতাকেই শিব বলে। কিন্তু যেহেতু এল.এস.ডি নেই এখন জিভে, তাই ওর শিব মনে হল না। মনে হল এ চূড়া আসলে এক নারী। ওর রাজযোটক প্রেমিকা। এযাবৎ কাল ধরে যেন সে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল ওর জন্য। এই ব্রহ্মমুহূর্তে শুভদৃষ্টি বিনিময় করবে বলে। ঋৎচিৎ ভাবল শ্রীমৎ অনির্বাণ কি এরই নাম দিয়েছিল হৈমবতী? ওর শরীরটা এখন বেটার। অনেক হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে উড়তে পারবে। ভেসে গিয়ে বাহুডোরে জড়িয়ে ধরতে পারবে হৈমবতীকে।
আজ ছ’মাস হল ঋৎচিৎ মায়াবতীতেই পড়ে আছে। যেখানে ও থাকে সেটা কোনও হোটেল বা হোম স্টে নয়। একটা কাঠের গুদাম। এককালীন তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে এই গুদামের এক কোনায় জায়গা করে নিয়েছে ও। গুদামের মালিককে কথা দিয়েছে ছ’মাস শেষে আরও দেবে। এর মধ্যে অল্প অল্প করে এটিএম থেকে টাকাও তুলেছে দু’বার। নীচের হাট থেকে কিনে এনেছে কম্বল, টুপি আর সোয়েটার। প্রথমবার টাকা তোলার পর সারারাত ঘুম আসেনি ভয়ে। ভেবেছিল লিঙ্ক ট্রেস করে পুলিশ আসবে। ক’দিন পর যখন বুঝেছিল রাষ্ট্র ওকে অতটাও পাত্তা দেয় না, ভয় ভেঙেছিল। ওকে এখন দেখতে অনেকটা পাগলের মতো হয়ে গেছে। মাথা ভর্তি চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি। দু’বেলা বিভিন্ন আশ্রমে গিয়ে ভোগ খেয়ে আসে বিনা পয়সায়। আর বাকি সময়টা এই গুদামের পিছন দিকে যে ঝুল বারান্দাটা রয়েছে, সেখানে বসে বসে তাকিয়ে থাকে হৈমবতীর দিকে। ওর শোনার ব্যাপারটা এখন অনেকটাই ডেভেলপ করে গেছে। সেদিন রাত্তিরে চাঁদের আলোয় হৈমবতীর আবছায়া মুখ দেখতে দেখতে হঠাৎ লক্ষ করল একটা তারা খসে পড়ছে। আকাশের আঁধারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে সে মিটমিট করে বলে গেল,
–নিজের খোলস ছেড়ে বেরও এবার। বলি, চেতনার অমৃত যা পৌঁছেছে তোমার কানে, তা কি একাই আত্মসাৎ করে নেবে? তুমি কী ভাবো এসব তোমার বিনোদনের জন্য ঘটছে? আমাদের কথা ছড়িয়ে দাও জগতে, ভাগ করে নাও পাঁচজনের সঙ্গে। পারলে একটু পাশে দাঁড়াও মানুষের, গাছের, প্রাণীর আর জড়পদার্থের।
এর পরদিন থেকেই ঋৎচিৎ একটু একটু করে বেরতে লাগল ওর তৈরি গুহা থেকে। কাঠগুদামের বাঁদিকে যে রাস্তা আদিবাসী গ্রামের দিকে নেমে গেছে, সেটা ধরে একটু হেঁটে গেলেই একধারে এক প্রকাণ্ড গাছ। তিনমানুষ মিলে হাত ধরাধরি করে জড়িয়ে ধরা যায়। তার তলায় বসে অপেক্ষা করত ও। পথচলতি মানুষ পিঠে পাতা আর কাঠ নিয়ে ফিরত যখন, জঙ্গল থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানিয়ে যেত। একদিন এক বছর আটেকের আদিবাসী মেয়ে ফুল নিয়ে এল ওর জন্য। ঠান্ডায় নাকের সর্দি গড়িয়ে পড়ছে। তার মধ্যেই রিনরিন করে বলল,
–তুমি তো ঠাকুর পুজো করো, তাই এই ফুলগুলো এনেছি তোমার ঠাকুরের জন্য।
ঋৎচিৎ ঠাকুর পুজো করে না। কিন্তু মেয়েটার মন ভাঙবে না বলে হেসে হাত বাড়াল। মেয়েটার সর্দির একটা ফোঁটা তখন মুক্তোর মতো টলমল করছে নাকের ডগায়। পাছে সেটা ঝরে পড়ে তাই তার আগেই একহাতে সব ফুলগুলো ধরে আরেক হাত দিয়ে মুছে নিল। তারপর নিজের ময়লা জামায় হাতখানা ঘষে আবার দু’হাত ভরে এগিয়ে দিল অর্ঘ্য। ঋৎচিৎ-এর মজা লাগল পুরো দৃশ্যটায়। ও কপট আফসোস দেখিয়ে বলল,
–এই যাঃ। তোমার হাত তো নোংরা হয়ে গেল। এই ফুল আমি ঠাকুরকে দিই কী করে?
মেয়েটা খুব সহজ সমাধান দিল।
–এক কাজ কর। তুমি মাঝখান থেকে ক’টা ফুল তুলে নাও।
ঋৎচিৎ হাসল। মেয়েটার কথা শুনতে ভালো লাগছে ওর। তাই ও আবার আপত্তি করল।
–তা কী করে হয়? তোমার হাত যদি নোংরা হয়, তাহলে ফুলগুলো তো নোংরা হয়ে গেছে।
মেয়েটা প্রতিবাদ করল।
–না না। আমার মা বলেছে ফুল সবচেয়ে শুদ্ধ হয়। তাই আমার হাতে যে ফুলগুলো লেগে আছে, সেটা মনে করো ফুল দিয়ে বানানো একটা ঝুড়ি। তুমি সেই ফুলের ঝুড়ির ভেতর থেকে শুদ্ধ ফুলগুলো তুলে নাও।
ঋৎচিৎ আর কথা খুঁজে পেল না। এই জ্ঞানের সারল্যর কাছে ওর যুক্তি মাত খেল। ও তুলে নিল ক’টা ফুল তারপর বলল,
–তোমার নাম কী?
মেয়েটা বলল পবিত্রা। তারপর কয়েক সেকেন্ড ঋৎচিৎ-এর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থেকে আবার হাঁটা দিল যে পথ বেয়ে এসেছিল, সেই দিকেই। খালি যাওয়ার আগে রেখে গেল একটা অনুরোধ,
–তুমি তোমার ঠাকুরকে একটু বোলো আমাদের বদ্রী গরুটা হারিয়ে গেছে, সে যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।
পবিত্রা ঋৎচিৎ-এর মনে খুব গভীর ছাপ ফেলল। ওর খালি মনে হচ্ছিল ভারতের একটা প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুও কী অপরিসীম সারল্য আর জ্ঞানের রসায়নে গড়া। তাও কী সহজ তার চাওয়া-পাওয়ার হিসেব। বদ্রী গরুর সন্ধান ঋৎচিৎ-এর কাছে আসেনি। তবু মাঝে মাঝেই পবিত্রা মুঠো ভরে ফুল নিয়ে আসত তার খোঁজ জানার জন্য। আর ওর দেখাদেখি আরও কিছু লোক দিতে লাগল ফুল। ধীরে ধীরে দেবতার জন্মের মতো ঋৎচিৎ-এর গাছতলা হয়ে উঠল লোকাল তীর্থক্ষেত্র। মানুষ ভিড় করতে আরম্ভ করল ঋৎচিৎ-এর কথামৃত শোনার জন্য। ও যা পারত জ্ঞান দিত। ফরেনার ট্যুরিস্ট এলে ছবি তুলত। ওর মন্দ লাগছিল না এসব।
একদিন মেঘ ওকে বলল,
–আমি পোয়াতি হয়েছি জানো? প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছি। মনে হচ্ছে আমার ওয়াটার ব্রেকেজ হবে।
ঋৎচিৎ খুব চিন্তায় পড়ে গেল। ও সতর্ক করল সবাইকে। গ্রামের যে লোকেরা ওকে বিশ্বাস করত অন্ধের মতো, তারা আগেভাগে ফসল তুলে নিল জমি থেকে। বাড়ির ছাউনি মেরামত করে রাখল। মজুত করে রাখল খাদ্য। আর যারা বিশ্বাস করল না তারা ঠাট্টা করল বাকিদের দেখে। ক’দিন পর বর্ষাকালের প্রথম বৃষ্টি মেঘের কথা মতো ঝরে পড়ল না ধরার বুকে, ফেটে পড়ল আছড়ে। লোকাল লোকেরা একে ‘আকাশ ভাঙা বৃষ্টি’ বলে। এই বৃষ্টি ছাঁকনি গলা বালির রোম্যান্টিক বারিষ নয়। দৈত্যাকায়। বিরাট মেঘের পুঁটলি যদি একযোগে ভেঙে পড়ে এক জায়গায় তাহলে যেমন স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে তার ধারা, এ জিনিস সেরকম। বিজ্ঞান বলে ‘ক্লাউড বার্স্ট’। মাঠ ভেসে গেল। বাড়ি উড়ে গেল। প্রাণ হারাল গ্রাম-কে-গ্রাম। হিসেব না করে। গরিবদের অসহনীয় কষ্টে বুক ফেটে গেল ঋৎচিতের। মনে মনে ভাবল এ কী পরিহাস করছে জীবন তার সঙ্গে? এই শুনতে পাওয়ার ক্ষমতাটা আজ অবধি বিপদ ছাড়া শান্তি দিল না ওকে। অভিশাপ বলে তাহলে কি সত্যিই কিছু আছে এ জগতে?
পবিত্রাকে অনেক দিন দেখেনি ও। দুশ্চিন্তা হত কিন্তু মনকে বলত,
–না। তুমি চলে যাও। আমি বিশ্বাস করি না তোমার কথা।
একদিন একটা দরিদ্র লোক ফুল নিয়ে এল ওর কাছে। ফুলটা দেখে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ওর। আপনা থেকেই মুখ ফুটে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল,
–আপনি পবিত্রা বলে একটা মেয়েকে চেনেন, ওই গ্রামে থাকত?
–হ্যাঁ বাবু, আমার মেয়ে হয়। এই বৃষ্টিতে ঘর ভেঙে গেছে আমাদের ওর খুব জ্বর আমাকে বলল এই ফুলগুলো দিয়ে যেতে।
–কেন আপনারা বর্ষার আগে বাড়ির চাল মেরামত করেননি? লোকটা এবার কেঁদে উঠল বলল,
–গ্রামে অনেকেই বেঁধেছিল। আমি জানতাম আপনার ব্যাপারে কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার ছোট মেয়েটা পর্যন্ত করেছিল কিন্তু আমি পারিনি।
আজ এতকাল পর ঋৎচিৎ যেন হঠাৎ প্রচণ্ড টান অনুভব করছে কোনও মানুষের প্রতি। জিজ্ঞেস করল,
–পবিত্রাকে একবার দেখতে যেতে পারি?
গ্রামে ঢুকতেই অনেকে ঋৎচিৎকে প্রণাম করল। ঋৎচিৎ সেসব দু’পয়সার সিদ্ধায়ী মোহ কাটিয়ে গিয়ে দাঁড়াল পবিত্রার বাড়ির সামনে। আদিবাসী বস্তির ভাঙা একখানা ঘর। দরজার ভেতরে আলো ঢুকে পড়েছে তাও অন্ধকারের জন্য তা যথেষ্ট নয়। পবিত্রা শুয়ে আছে বিছানার ওপর, ওর মা জলপট্টি করছে। জ্বরের মধ্যেও ওর ফুলের মতো মুখটা নেড়ে, ভাঙা গলায় আধো আধো জিজ্ঞেস করল,
–তোমার ঠাকুর কী বলল, আমার বদ্রী গরুটা কবে আসবে?
ঋৎচিৎ-এর মনে হল এত মধুর কিছু ও জীবনে এর আগে শোনেনি। হৃদয় ভরা ঘটের মতো কোনও দিন এতটা ভরে যায়নি কারও কথায়। এতটা বিশ্বাস, এতটা সততা, এত প্রত্যয় কী করে থাকে কোনও মানুষের গলায়? ঈশ্বরের কণ্ঠ কি এর চাইতেও নলেন? পবিত্রার মুখটা ঝাপসা হয়ে উঠল। অদ্ভুত কাণ্ড! এটুকুতেই আজকাল কান্না পায় ঋৎচিৎ-এর?
পবিত্রার বাবাকে ঋৎচিৎ তিনবারের কিস্তিতে টাকা তুলে দিয়েছে চুপিচুপি। চিকিৎসার জন্য। বাড়ি মেরামতের জন্য। আর একটা হারিয়ে যাওয়া অবিকল বদ্রী গরুর দোসর আনার জন্য। শর্ত একটাই পবিত্রা যেন জানতে না পারে। শেষ টাকাটা নেওয়ার আগে হেমন্ত জিজ্ঞেস করেছিল ঋৎচিৎ আকাশভাঙা বৃষ্টির কথা জানল কী করে? পবিত্রার পিতাকে তো মিথ্যের অপবিত্রতায় ফেরানো যায় না। তাই সত্যিটা বলেছিল। ও শুনতে পায় সেসব যা আর কেউ পায় না।
ঋৎচিৎ-এর এই শুনতে পাওয়ার গল্পটা রটে যেতে বেশি সময় নিল না। গ্রামের লোকেরা তাই ওর নাম দিল ‘শোনাবাবা’। যে বাবা শুনতে পায় ঈশ্বরের সতর্ক বাণী। যে বাণী না শুনলে মানুষের বিপদ সমূহ। আর এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসের মাঝে শোনাবাবার জীবনও চলতে থাকল দরিদ্রদের সঙ্গে নিয়ে। যারা ওকে সমীহ করত তাদের কাছে ও ছিল সিদ্ধপুরুষ। আর যাদের মনে সন্দেহ ছিল তারা বলত অপয়া। ঋৎচিৎ জানত দুটোই কিন্তু কোনওটাই ওকে স্পর্শ করত না খুব। মানুষদের কখনওই খুব একটা ভাল লাগেনি ঋৎচিৎ-এর। হৈমবতীকে পাওয়ার পর ওর আরও বেশি করে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে স্বজাতির সংসর্গের। শুধু পবিত্রার কথা থেকে থেকে থেকে মনে হয়। পবিত্রাকে ওর বিশ্বাস করতে মন চায় না মানব সন্তান বলে। পুরাণের কোনও ঋষি পবিত্রার মতোই কাউকে দেখে হয়তো লিখেছিল দেবশিশুদের কাহিনি। এই তো সেদিন সে তার বদ্রী গরু ফিরে পেয়ে মুঠো ভরা ফুল নিয়ে প্রণাম করতে এসেছিল ঋৎচিৎকে। কিন্তু তাতেও তার খুশি ব্যক্ত করে কুলিয়ে উঠতে পারল না। তাই যাওয়ার আগে ফরেনার ট্যুরিস্টদের কায়দায় চুমু ছুড়ে দিয়ে গেল কচি হাতের মুঠো থেকে। যার অভিঘাত কোনওরকম চ্যারিটির শ্লাঘাতে চিরকালের মতো ধূলিস্যাৎ করার জন্য যথেষ্ট।
এসব মায়া আর প্রাপ্তির ওম একদিন গাছতলায় বসে বসে পোহাচ্ছিল ঋৎচিৎ। হঠাৎ বুকটা আবার কেঁপে উঠল। ডাকল কি কেউ? হ্যাঁ। বাঁদিকের পাহাড়টা। খুব ক্লান্ত স্বরে বলল,
–কুঁজো হয়ে থাকতে থাকতে পিঠে খুব ব্যথা রে। এতগুলো লোকের কথা ভেবে আড়মোড়াটিও ভাঙতে পারিনে। তুই এদিকের গ্রামগুলোকে যদি বলিস, তো আমি একবার পিঠটা একটু টান করে নিই। মিনিট পাঁচেক সোজা হয়ে বসতে পেলেই হয়ে যাবে আমার।
ঋৎচিৎ সে কথাও জানাল গ্রামের লোকদের। শোনাবাবার কথা শুনে অনেকেই চলে গেল অন্যান্য পাহাড়ে। যারা গেল না, তারা চাপা পড়ল ধ্বসে। কাঠের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঋৎচিৎ চাক্ষুষ করেছিল সেই ধ্বংসলীলা। আগে থেকে টিকিট কেটে রাখা ম্যাটিনি শো-এর মতো। তাসের ঘর থেকে একটা কার্ড টেনে নিলে যেমন নিউটনের সূত্র মেনে ধাপে ধাপে শেষ হয়ে যায় শ্রমের ইমারত। ঠিক তেমনই পাহাড়ের কোলে যত্নে বসানো বাড়ি, ঘর, গোয়াল, রাস্তা, ইশকুল সব ভেঙে গেল ভাঁজে ভাঁজে। অজস্র চিৎকার, ক্রন্দনকে টেনে নিল গ্র্যাভিটি, পার্কের স্লিপ যেমন টেনে নেয় শিশুদের উল্লাসে। রেখে গেল কেবল নৈঃশব্দ্য আর ধোঁয়ার মেঘ। ওই ধোঁয়ার কণারা পাক খেয়ে খেয়ে ভাসছিল হাওয়ায়। সন্ধ্যাবেলার ফিরতি বিহঙ্গের মতো। নৈঃশব্দ্য ভেদ করে তারা বলে উঠেছিল…
–আমরা কিন্তু ধুলো নই। আমরা স্বপ্নের অণু পরমাণু। কত মানুষ, কত বছর, কত যুগ ধরে তিলে তিলে বুনেছিল আমাদের। আজ আমরা হয়তো মিলিয়ে যাব। কিন্তু আমরা আবার ফিরে আসব তুমি বলে দিও ওদের।
কাদের বলতে বলল ওরা? যারা তলিয়ে গেছে খাদে? জাত ধর্মের তোয়াক্কা না করে যাদের গণকবর দিয়েছে প্রকৃতি? এ প্রশ্নের উত্তর যদিও দেয়নি ঋৎচিৎ-কে।
শোনাবাবার খবর এবার ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। সে খবর প্রকাশ করার জন্য মৌমাছির মতো ভনভনিয়ে জুটে গেল মানুষ। প্রথমে কয়েক জন লোকাল ভ্লগার। তারপর ট্যুরিস্ট ভ্লগার, টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। আর শোনাবাবাও সেই রাতের খসে পড়া তারার আদেশ মেনে বলে চলল যা আসে মনে। সব গ্রামের সকল লোকেরাই এবার প্রায় দণ্ডবৎ দিল শোনাবাবার স্মরণে। অতি উৎসাহী যুবকরা একটা প্রকাণ্ড ঘণ্টা বাঁধল গাছতলায়। যা প্রহরে প্রহরে ছড়িয়ে দিত মঙ্গল ধ্বনি। পঞ্চায়েতের প্রধান, পার্টির লিডার আসত ভেট নিয়ে। আশীর্বাদ স্বরূপ সেলফি চেয়ে নিয়ে যেত শোনাবাবার হাত মাথায় ধরে। জনতা জনার্দন দাবি করেছিল শোনাবাবার একটা মন্দির হোক। রাজি হয়নি ঋৎচিৎ। ও বুঝিয়েছিল,
–আমার এই গাছতলা যতটা নির্মল ততটা শুদ্ধ কোনও মন্দির তৈরি হবে না। এই আকাশটা যত উঁচু তত বিশাল কোনও ছাদ গড়া যাবে না। এখানে বসে দু’চোখ ভরে আমি যতখানি প্রকৃতি দেখি তা এঁটে উঠবে না কোনও সিংহ দুয়ারের আয়তনে।
ঋৎচিৎ-এর মাঝে মাঝেই খুব অবাক লাগে। নিজের ওপর। কেমন পাক্কা সাধকের মতো কথা বলতে শিখে গেছে ও। কোনও হিসেব কষতে হয় না, কোনও অঙ্ক করতে হয় না চেতনার অনাবিল ছন্দ থেকে কেমন আপনি ওঠে সব। ও কি তবে শেষমেশ শিখেই ফেলল অভিনয়? ধরে ফেলল ট্রুথ-কে? যে চরিত্রটা মানুষ দেখতে চাইছে, সেই চরিত্রটা কি হয়ে উঠতে পারল ও? নাকি চরিত্রটাই ও হয়ে উঠেছে?
চার
বছরের এই সময়টা ঠান্ডা যখন কমে আসে তখন মায়াবতী সবুজ হয়ে আসে ঠিকই তবু হৈমবতী হারায় না ওর সুডৌল শুভ্রতা। তবু আজ ঋৎচিৎ-এর মনটা ভালো নেই। এতদিন ধরে প্রতি মুহূর্তে ও কতবার দেখেছে হৈমবতীকে, কিন্তু এমন পাংশু লাগেনি কোনও দিন আগে। কেমন যেন কালো ছোপ ছোপ পড়েছে ওর চেহারায়। শ্রাবস্তীর কারুকার্য তা মোটেই নয়। আশঙ্কার কালশিটের মতো। আজ অবধি ওরা দু’জন দু’জনকে দেখে গেছে শুধু। কথা বলেনি কোনও দিন। প্রয়োজনও পড়েনি। আজ প্রথমবার যখন হৈমবতীর কণ্ঠ ভেসে এল কানে, গলা ভিজে এল ঋৎচিৎ-এর। মনে হল এই আওয়াজ যেন তার কত জন্মের চেনা। কত আপনার। মাধুর্য মাখা দৃপ্ত সেই স্বর বলে উঠল,
–আমরা আর বেশিদিন নেই এ পৃথিবীতে। তাতে যদিও বা কিছু যায় আসে না। কারণ এলোক, ওলোক এমন সাতলোক ছাড়িয়েও আমি তোমার। কিন্তু তুমি আমিই তো সব নয়। এত যে মানুষ, এত হাসি, এত প্রেম, এত আশা এসবও আর থাকবে না বেশিদিন। অসুরেরা আবার দখল নেবে এ সমস্ত কিছুর। অমরত্বের লোভে, পাতাল খুঁড়ে বের করে আনবে সঞ্চিত শক্তি। তাই আমার শিবকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে অসুরের বিরুদ্ধে।
ঋৎচিৎ স্থির হয়ে গিয়েছিল। জড়ের এত বলিষ্ঠ অথচ নিবিড় ডাক ও শোনেনি কোনও দিন। আর এরপরেও হৈমবতী যা যা বলেছিল ওকে তাতে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল ও শিরদাঁড়া দিয়ে।
গাছতলায় গিয়ে গ্রামের লোকেদের বলল সভা করবে একটা। ঠিক হল নীচের গ্রামে, ইশকুলের মাঠে হবে সভা। প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হল। চোঙ লাগিয়ে দেওয়া হল যত দূর শুনতে পায় মানুষ। শোনাবাবা এই প্রথম ভাষণ দেবে মানুষের উদ্দেশে। শ্রোতা চাই, বিপুল শ্রোতা। যত পারা যায় তত বেশি। প্রেস, মিডিয়া যেখানে যে আছে খবর করা চাই। গোপন রহস্য ফাঁস হবে। ডাক দেওয়া হবে মহাযুদ্ধের। প্রলয় আগত।
সাতদিন ধরে ঋৎচিৎ অজস্রবার কেটেকুটে বক্তৃতার খসড়া তৈরি করল। তারপর প্র্যাকটিস। এক সভা থেকে ছড়িয়ে দিতে ডমরুর ধ্বনি। হৈমবতীকে কথা দিয়েছে ও। দুপুরের রোদের ওম গায়ে মেখে ও বারান্দায় বসে শেষবারের জন্য ঝালিয়ে নিচ্ছিল লেখাটা। হঠাৎ রবিন পাখির মতো একটা ডাক…
–শোনাবাবা, দেখো তোমার সঙ্গে দু’জন দেখা করতে চায়। বলছে চ্যানেল থেকে এসেছে।
ঋৎচিৎ দেখল দু’জন রিপোর্টারকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে পবিত্রা। ও বলল,
–ওপরে পাঠিয়ে দে। তুই আসবি না?
–না, আমি তো তোমার জন্যে ফুল তুলতে যাচ্ছিলাম। তুমি আজ গাছতলায় যাবে না?
–না রে। বক্তৃতাটা প্র্যাকটিস করছি। তুই আসবি তো কাল শুনতে?
–হ্যাঁ আসব তো, কিন্তু এখন কি আমি তোমায় ফুল তুলে এনে দিয়ে যেতে পারি?
–একশোবার পারিস, তোর ফুল না পেলে ঘুম হবে না আমার।
পবিত্রা হেসে চলে গেল। সাংবাদিক দু’জন উঠে এল উপরে। একটা এক্সক্লুসিভ করতে চায় কালকের সভার আগে। ক্যামেরা ম্যান ক্যামেরা সেট করে লেপেল পরিয়ে দিল ঋৎচিৎকে। অ্যাঙ্কর ভদ্রলোক বসলেন উল্টো দিকে। ক্যামেরা রোল হল। প্রথম প্রশ্ন,
–শোনাবাবা, এতদিন আপনাকে কেউ ভাষণ দিতে শোনেনি। এটা কি আপনার প্রথম ভাষণ?
–হ্যাঁ। আমি ভাষণ দেওয়ার লোক নই। কোনও দিন দিতে হবে ভাবিওনি। কিন্তু এখন মনে হল অনেকগুলো কথা বলার আছে নইলে বিপদ আটকানো যাবে না।
–কী বিপদ দেখছেন আপনি?
–আমি দেখি না, আমি শুনি। আমার সঙ্গে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কথা বলে।
–কী বলছে তারা?
জার্নালিস্টের কথার উত্তরটা দেওযার আগে ক্যামেরার লেন্সটা হঠাৎ কথা বলে উঠল,
–সত্যিটা বলিস না।
ঋৎচিৎ অবাক হল। আজ অবধি জড়েরা এমন অসাধু প্রস্তাব দেয়নি কখনও। উল্টে ও জানত ক্যামেরা ডাস্ন্ট লাই। তাহলে ওকে মিথ্যে বলতে বলছে কেন? তাছাড়া ও প্রচারের জন্যই দিচ্ছে ইন্টারভিউ। আজ এখানে একরকম কথা বলবে, কাল পুরো উল্টো কথা বলবে? হয় না কি? জার্নালিস্ট আবার জিজ্ঞেস করল,
–আপনি কি আবার কোনও ডিসাস্টার প্রেডিক্ট করছেন?
–হ্যাঁ! বলতে পারেন।
–তাহলে এত বড় সভা করছেন কেন। মিডিয়াকে বললেই তো হয়।
–না এই ডিসাস্টার কেবল মিডিয়া দিয়ে আটকানো যাবে না। মানুষকে লাগবে।
–ডিসাস্টার আটকাবেন কী করে? মানে আপনি ন্যাচারাল ক্যালামিটি সম্পর্কে মানুষকে অ্যাওয়ার নিশ্চয়ই করতে পারেন কিন্তু,
কথা শেষ হল না। ঋৎচিৎ উত্তরটা দিয়ে দিল,
–ন্যাচারাল নয়। ম্যান মেড ডিসাস্টার।
–ম্যানমেড? একটু যদি খুলে বলেন,
–এই যে অঞ্চলের ওপর আমরা বসে আছি এর তলায় মজুত রয়েছে বিপুল স্ফ্যালেরাইট। সেমিকন্ডাকটর বানানোর কাঁচামাল। সম্ভবত সরকার তার হদিশ পেয়েছে সম্প্রতি। তাই আর ক’দিনের মধ্যেই বড় বড় কোম্পানিরাও আসবে। জমি অধিগ্রহণ হবে।
–আপনি এত শিওর হচ্ছেন কী করে?
–আমি ভুল শুনিনি এখনও পর্যন্ত।
দৃঢ়ভাবে জানাল ঋৎচিৎ। সাংবাদিক জানতে চাইল,
–আপনারা কি সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন?
–কার ক্ষতিপূরণ?
–এই যে বলছেন জমি অধিগ্রহণ হবে মানুষের?
–মানুষের? জমি কি শুধু মানুষের? কতটা জমি মানুষের? কবে থেকে? পৃথিবীতে সবচেয়ে পরে এসেছে মানুষ। গাছের পরে, প্রাণীর পরে, পাখির পরে, পোকামাকড়েরও পরে। সবচেয়ে বড় কথা হল পাহাড়, নদী, ঝরনা এদের অধিকার তো মানুষের বহু আগে থেকে রয়েছে পৃথিবীর ওপর। এদের ক্ষতিপূরণ করার যোগ্যতা মানুষ পাবে কী করে? এ পাহাড়টা একবার আড়মোড়া ভাঙলেই মানুষের ফুটানি শেষ!
জার্নালিস্ট খুব চিন্তায় পড়ে গেল। একটু ভেবে নিয়ে বলল,
–তাহলে আপনি মেসেজটা কী দিতে চাইছেন।
ক্যামেরার লেন্সটা আবার বলে উঠল,
– ঋৎচিৎ সাবধান। কাকে কথাটা বলছিস ভালো করে দেখে নে।
ঋৎচিৎ-এর লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে। ও বলল,
– আপনি কি আগে আমায় ইন্টারভিউ করেছিলেন? যে বার ধস নামল।
–না।
–আচ্ছা! হ্যাঁ, কী জিজ্ঞেস করছিলেন যেন?
–আপনার মেসেজটা কী?
–আমি মানুষকে বলব রুখে দাঁড়াতে। এতদিন প্রকৃতি তাদের আগলে রেখেছে। শুধু দিয়ে গেছে। বদলে কিচ্ছু চায়নি। এখন তাদের টার্ন এসেছে। প্রকৃতিকে আগলানোর।
–তাহলে তো রাষ্ট্র আর জনগণের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যাবে।
–তা যেতে পারে।
সাংবাদিক ঘামছেন। চশমাটা খুলে মুখ মুছল। তারপর বেরেট ক্যাপটা খুলতেই টাকটা বেরিয়ে গেল। এবার ঋৎচিৎ চিনে ফেলেছে। ভদ্রলোক একমুখ দাড়ি রেখেছেন বলে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। গোঁফে কলপও নেই, তাই সবটা সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, এক বিন্দু ভয় লাগল না ঋৎচিৎ-এর। ওর বাঁ পাশের হৈমবতী জেগে আছে সহযোদ্ধার মতো। সাংবাদিক প্রশ্ন করল,
– আপনি কম্যুনিস্ট?
–কম্যুনিজমে মানুষের ওপর প্রকৃতিকে স্থান দেওয়া হয়েছে নাকি?
–আপনি তো সাধকের ভেক ধরে রেভলিউশনের কথা বলছেন।
ঋৎচিৎ হাসল…
–একটা কথা কি জানেন মিস্টার…
–সিং। প্রভাত সিং।
সাংবাদিক বলল, ঋৎচিৎ মুচকি হাসল।
–বেশ। মিস্টার সিং। রেভলিউশনের উর্বর আবেগ থেকে যদি প্রতিহিংসাকে উপড়ে ফেলা যায়, তারপর সেই জায়গায় যদি প্রকৃতিপ্রেম বপন করা হয়, তাহলে আধ্যাত্মিকতার গাছ গজায়। জানেন এটা?
জার্নালিস্ট মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। ঋৎচিৎ বলল,
–তাহলে আমি আপনাকে আর একটা প্রশ্ন করি।
–আপনার আসল পেশা ঠিক কী? সাংবাদিকতা? ব্যবসা? না রাষ্ট্রের টিকটিকি? এই প্রভাত সিং নামটা কি আসল নাকি ওটাও রাকেশ দুবের মতো জাল? আর কলকাতার বউটা? যার জন্য আপনি আপনার ড্রাইভারকে…
দুম্ দুম্ দুম্। কথা শেষ হল না ঋৎচিৎ-এর। জার্নালিস্টের কোর্টের পকেট ফুঁড়ে তিনটে গুলি ঋৎচিৎ-এর পাঁজরে জায়গা করে নিল। ও লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। দৃষ্টি আবছা হয়ে আসছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। ও কি মরে যাচ্ছে? জার্নালিস্টরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে গেল। ও তাকিয়ে রয়েছে হৈমবতীর দিকে। পবিত্রা এসেছে ফুল নিয়ে। ঋৎচিৎকে এ অবস্থায় দেখে প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। তারপর যখন দেখল রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। হাতের ফুলগুলো ঝরে পড়ল ঋৎচিৎ-এর পায়ের ওপর। নীচে গাছতলায় বাঁধা বড় ঘণ্টাটা কোনও এক ভক্ত হয়তো বাজিয়ে দিল। ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং। ঋৎচিৎ দেখতে পাচ্ছে হৈমবতী হাসছে দু’বাহু বাড়িয়ে। ওর মনে হচ্ছে ও ভাসতে পারবে। চাইলেই উড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারবে বাহুডোরে। হলও তাই। খেয়ালের মতো ও ভেসে গিয়ে জড়াল হৈমবতীকে। মাথা রাখল কাঁধে। এত শান্তি আর কান্না একসঙ্গে ধেয়ে আসে নাকি কখনও? ওর তো জানা ছিল না? ও প্রশ্ন করল,
–এ লোক, ও লোক, সাতলোক পেরিয়ে কি তুমি?
প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর দিল হৈমবতী।
–আমি তোমার। আমি তোমার।
অদ্ভূত সুন্দর কমলা আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। মেঘেরা এসে মালা হয়ে গলে গেছে ওদের গলায়। কী ভীষণ প্লাবন উঠেছে অদ্ভুত সংগীতের। গোটা জন্ম থেকে ঋৎচিৎ-এর আর কিছুই মনে পড়ল না। শুধু পড়ল, অনেক ছোটবেলায় বিভূতিভূষণের ‘দেবযান’-এ পড়েছিল স্বর্গের দেবদেবীরা দল বেঁধে কয়্যার গাইতে আসেন এমন তিথিতে।