পুজোর প্রত্যেকটা দিনই তখন আনন্দে কাটত। আর দশমীর দিন মা-দুর্গার বিসর্জনের পর চোখের জল আটকানো যেত না। অনেক বুড়ো মানুষ তো মায়ের বিসর্জন দেখে হাউহাউ করে কাঁদতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘রচনাসংগ্রহ’ থেকে পুনর্মুদ্রিত।
দুর্গাপূজার কথা মনে হলেই এখনও আমার মন গ্রামের পথে চলতে থাকে। ছেলেবেলার প্রথম দিকটা আমরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলাম। কলকাতার খুব কাছেই। জয়নগরের আগের স্টেশন বহড়ু গ্রামে।
আমাদের গ্রামে দুর্গাপূজা হত জমিদারদের বাড়িতে। একটা হত জমিদার ভঞ্জদের বাড়িতে। আর একটা বোস জমিদারদের বাড়িতে। পুজোর ক-টা দিন আমরা প্রায় সবসময়ই দুর্গাপ্রতিমার সামনে ঘোরাঘুরি করতাম। সকালে পুজো দেখতাম। সন্ধেবেলা আরতি হত। তখন মনে হত যেন নিজেদের বাড়ির পুজো। গ্রামের সবাই তাই মনে করত। তখন যেন একই গ্রামের লোকেরা একই পরিবারভুক্ত। কাউকে জ্যাঠা, কাউকে কাকা, কাউকে মামা বলে ডাকতাম। কেউ পিসি, কেউ মাসি, কেউ দিদি। সেই সময় মানুষে মানুষে এইরকম সম্পর্ক ছিল।
সকালে মায়ের ভোগ খেতাম। সন্ধেবেলা কবিগান হত। রাত্তিরে হত যাত্রাপালা। পুজোর প্রত্যেকটা দিনই তখন আনন্দে কাটত। আর দশমীর দিন মা-দুর্গার বিসর্জনের পর চোখের জল আটকানো যেত না। অনেক বুড়ো মানুষ তো মায়ের বিসর্জন দেখে হাউহাউ করে কাঁদতেন। সেসব মধুর দিনগুলো কবে হারিয়ে গেছে।
আমার যখন আট বছর বয়স তখন আমরা কলকাতায় পাকাপাকি চলে এলাম। দেশে থাকতেই বাবা একটা বাড়ি করেছিলেন ভবানীপুরে। সেখানে এসেই উঠলাম। এখানে আমরা আসার পর আর গ্রামে যাইনি। তখন এখানকার পুজোতেই আনন্দ করেছি। এখানে তখন ধনী ব্যবসায়ীদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হত। ঘুরে ঘুরে এবাড়ি-ওবাড়ির প্রতিমা দেখে বেড়াতাম নতুন জামা কাপড় পরে। সে-পুজোতেও আনন্দ করার সুযোগ ছিল।
তারপর শুরু হল বারোয়ারি পুজো। বাড়ি-বাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করে পুজো। একটা দুটো বারোয়ারি পুজো থেকে ক্রমশ বারোয়ারি পুজোর সংখ্যা বাড়তে লাগল। শুরু হল প্রতিযোগিতা। কার প্রতিমা কত ভালো তারই লড়াই। অতএব নানান কায়দায় প্রতিমা গড়া শুরু হল। সাবেকি মূর্তির জায়গায় মাকে আধুনিকা করা হল। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে মায়ের ভোল পালটে গেল। সেই অসুরনাশিনী, সিংহবাহিনী মায়ের রূপ মিলিয়ে গেল।
আগেকার দিনের পুজোর আনন্দ বিদায় নিল। শুরু হল চাঁদার জুলুম। তখন পুজোর নামে মধ্যবিত্তের আনন্দ উধাও। মায়ের আগমনের প্রতীক্ষায় যারা দিন গুনত আনন্দে তাদের মুখে নেমে এল রাশি রাশি নিরানন্দ।
তবু কিছু কিছু বনেদি বারোয়ারি পুজোয় সাবিকে নিয়ম আজও বজায় আছে। সেসব পুজোপ্যান্ডেলে প্রতিমা দেখার জন্যে আজও মানুষ সাগ্রহে হাজির হয়ে ভক্তিভরে প্রণাম জানায়। এই সব বারোয়ারি পুজো আছে বলে এখনও পুরনো দিনগুলো পুরোপুরি মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।
ঋণ রচনাসংগ্রহ, হেমন্ত মুখোপাধ্য়ায়। দে’জ পাবলিশিং। সম্পাদনা শ্রীকুমার চট্টোপাধ্য়ায়
বানান অপরিবর্তিত। শিরোনাম সম্পাদকীয় দফতরের।