এটা ভারি আশ্চর্য, মাত্র সাত-আটশো স্কোয়ার ফুট পাওয়ার জন্য আমরা বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলে চলেছি অহরহ, এদিকে সগ্গোবাসের জমি নিশ্চিত করতে খুচরোয় কাজ সারছি। পুন্যিটা হবে কোত্থেকে শুনি,অ্যাঁ? এই হতচ্ছেদ্দা হাবভাব দিয়েই আমার পুরুত পাকড়াই। গোঁজামিল দিয়ে এক-আধটা পুজো শর্টে নামিয়ে দেবেন যিনি।
সঠিক বাস, ডি.এ. এবং পুরুত– কখনওই টাইমমতো পাবেন না। শিওর! যখনই দরকার বাড়িতে ভক্তি-ঘণ্টা নাড়ার, টিকিটির দেখা মিলবে না কারও। দূর থেকে যদি বা একঝলক দেখতে পেলেন, আহা, সোঁদরবনের বাঘ যেন, পুরো ডোরাকাটা ঝলক দিখলা যা, এই… এই… ভ্যানিশ। হাপিত্যেশ করেও আর দেখা মিলবে না। আপনার সাড়ম্বর নির্ঘণ্টর ঘণ্টা বাজিয়ে ভোঁ-ভোঁ। আসলে পুরুত মানেই ফুরুত!
এমন একটা বাড়িতে বড় হয়েছি, সকাল-সন্ধে আরতির টুংটাং আওয়াজ মিশে আমার শৈশব। আমাদের বাড়িটা ‘ঠাকুরবাড়ি’ বলে এলাকায় পরিচিত, এমনকী, রাস্তার নামও ওই মন্দিরের নামে। ফলে সকাল-বিকেলের দুই ভটচায্যি মশাই আমাদের পরিবারেরই একজন ছিলেন। চান-টান সেরে চেটোয় ‘চন্নমেত্তর’ খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। ফলে ভটচায্যি মশাইকে ফট করে ‘পুরুত’ বলতে আমার চিরকালই কোথায়-কোথায় যেন লাগে। হাজার হোক, ওঁরাই ভগবানের কাছে পৌঁছনোর দ্বাররক্ষী বিশেষ। পাঁচ সিকের পুজোয় যে-নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও শুচির পরাকাষ্ঠা তাঁরা সব সময় দেখিয়েছেন, তাঁদের ‘প্রণামী’ কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়েনি একটুও। চাল-কলা-নৈবেদ্যে কোনওমতে সেরে সটকে পড়েছি আমরা। পুরাকালে রাজসূয় যজ্ঞের পুরোহিত যে-সম্মান ও দক্ষিণা পেতেন, হালের বিশ্বকর্মা পুজোর পুরুত তা জানলে ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’-এ চলে যাবেন নিশ্চিত। এটা ভারি আশ্চর্য, মাত্র সাত-আটশো স্কোয়ার ফুট পাওয়ার জন্য আমরা বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলে চলেছি অহরহ, এদিকে সগ্গোবাসের জমি নিশ্চিত করতে খুচরোয় কাজ সারছি। পুন্যিটা হবে কোত্থেকে শুনি, অ্যাঁ?
এই হতচ্ছেদ্দা হাবভাব দিয়েই আমার পুরুত পাকড়াই। গোঁজামিল দিয়ে এক-আধটা পুজো শর্টে নামিয়ে দেবেন যিনি। দরদাম শেষে ফুল-বেলপাতা ধরিয়ে আমরা ‘নমো’ দিচ্ছি হাসিমুখে। ও পুরুতমশাই, মন্তরগুলো ঠিক আওড়াচ্ছেন তো, না কি ‘ধন্যি মেয়ে’র মতো বিয়ের আসরে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়ছেন? সকলে হেসে গড়িয়ে পড়ে। পুরুত গরুচোরের মতো মুখ করে ঘণ্টা নেড়ে যান। মুখে মন্ত্র হলেও নিশ্চয়ই মনে-মনে গাল পাড়েন। দাঁড়া রে বাচাল পামর, সশ্রম নরকবাসের ব্যবস্থা করছি তোর হতভাগা।
প্রায় কাঠবিড়ালীর মতো হাতের তেলো থেকে ‘সিলিপ’ করে পুরুত বেরিয়ে যান সরস্বতী পুজোর দিনে। ছেলে-মেয়ে ‘স্টার’, ‘জয়েন্ট’, ‘ক্যাট’ পাবে বলে বাড়িতে-বাড়িতে ঢালাও ঘুষপুজো। বাবা গো, সরস্বতীকে চটালে হবে? পরিণতি, অ্যানুয়ালে, রাজহাঁসে প্যাঁক দেবে। ফলে সেদিন পুজোয় পুজো কলকাতা জুড়ে। পুরুত সকাল থেকে মাটিতে পা ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না। স্ট্রেট হাইজ্যাকড টু প্যান্ডেল।
উপলদের বাড়ির গল্প বলি। সকাল-সকাল পুজো শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু পুরুত আসছেন না। সরস্বতী ঠায় দাঁড়িয়ে। পুষ্পাঞ্জলির ফুল হাতে বাকিরাও। মোবাইলে ফোন করে জানা গেল, পুরুতকে কে বা কারা ‘তুলে’ নিয়ে গিয়েছে, তিনি আসতে পারবেন না। পিসি থেকে গার্গী, বউদি, ঝিমলি-তিতলি– প্রত্যেকেই মুষড়ে একশা। বেলা বয়ে যায়। উপোসে পেট চড়চড় করছে, অঞ্জলি না-দিয়ে শ্যাম রাখি না কুল চাখি! ড্রাইভার বিপ্লবকে পাঠানো হল মোবাইল পুরুত খুঁজতে। সে-ও পায় না কাউকে। পিসি গজগজ করতে লাগল, বচ্ছরকার পুজো। উপলের দাদা, প্রবালদা খেপে ব্যোম হয়ে ঘোষণা করল, দূর, ওসব পুরুত-টুরুত ছাড়ো, আমিই আজ পুজো করব। যেমন কথা তেমন কাজ। নামাবলি গায়ে চাপিয়ে প্রবালদা মূর্তির সামনে আসীন। বিড়বিড় করে বহুবিধ মন্ত্র আওড়াতে লাগল। মানে, সেইসব, যা ছোটবেলা থেকে এই দিনটায় আমরা ঝালিয়েছি। মাঝে-মাঝে ফুল চড়ানো, জল ছেটানো ইত্যাদি প্রভৃতি। সবই হল, কিন্তু পিসি তখনও খুঁতখুঁত করছে। এটা কীরকম যেন হচ্ছে! প্রবালদা কনফিডেন্ট, খারাপ কী হচ্ছে, এভাবেই তো হয়! তবুও সকলের ঠিক মন উঠছে না। এমন সময় হঠাৎ পরিত্রতার মতো বিপ্লবের আবির্ভাব এক পুরুতকে বগলদাবা করে। এক বাড়ি থেকে গুটিগুটি বেরচ্ছিলেন, খপ করে ধরা হয়েছে তাঁকে মাঝরাস্তায়। পিসি চেঁচিয়ে উঠল, আরে এই তো, এ সেই তো আমাদের পুরুত! কী আক্কেলটা আপনার বলুন দিকি, সকাল থেকে বাচ্চারা না-খেয়ে…। পুরুতের সাদাসাপটা জবাব, কী করি বলুন তো? এই আপনারা যেমন হাইজ্যাক করলেন, এমনিভাবেই তো সবাই তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আমি আর নিজে-নিজে কোথাও যেতে পারছি কই!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved