ইউরোপের পুব ও পশ্চিম— এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও অঢেল সাদৃশ্য দেখতে পান কুন্দেরা। কারণ পৃথিবীর যে গোলার্ধেই থাকুক, মানুষ মূলত এক ধাতুতে গড়া। সামগ্রিক মানুষের সম্পর্কে কুন্দেরার ধারণাটি দাঁড়িয়ে মৌলিক দু’টি ঝোঁকের ওপর— ব্যক্তিগত স্তরে নিজের ভাবমূর্তি। কুন্দেরার মতে, এখানেই নাকি নিহিত ব্যক্তির চালিকাশক্তি। এবং সামাজিক স্তরে কৌতুক বা ছ্যাবলামি। কৌতুক কী করে? প্রথমত স্বৈরাচারের পর্দা ফাঁস করে দেয়; এ হল কৌতুকের রাজনৈতিক চরিত্র। তার এক আধিভৌতিক চরিত্রও আছে— সে মৃত্যুকে পর্দার মতো আড়াল করে রাখে।
পাশ্চাত্য সংগীত, আমরা প্রত্যেকেই জানি, প্রধানত পলিফনিক। সেখানে একটি মূল মেলোডির চারপাশ ঘিরে একাধিক স্বর বাজতে থাকে। মেলোডিটি যেন এক নর্তকী ও তাকে ঘিরে যে ঐকতানের সৃষ্টি হয়, তা যেন সেই নর্তকীর সজ্জাভরণ। অবশ্য হারমনি এসেছে তারও বহু পরে। পলিফনি কিন্তু হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতেও আছে। গায়ক-কণ্ঠের চারপাশে সেখানে তানপুরায় একাধিক স্বরের পলিফনিক আবহ তৈরি হয়।
সংগীতে পলিফনির প্রয়োগ সুপ্রাচীন। পলিফনির ধারণাকে প্রথম সাহিত্যের অঙ্গনে নিয়ে এলেন রুশ সাহিত্য-তাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিন। দস্তয়েভস্কির গদ্য আলোচনার প্রসঙ্গে ধারণাটি উঠে এল। দস্তয়েভস্কির লেখাতে বাখতিন খুঁজে পেলেন স্বতন্ত্র ও বিযুক্ত কণ্ঠস্বরের একাধিকত্ব। আখ্যানে শুধু আখ্যানকারের স্বর না, পাশাপাশি শুনতে পাওয়া যায় চরিত্রদেরও স্বতন্ত্র বহুস্বর। উপন্যাসে কথকের কথার বাইরে স্থানে-স্থানে চরিত্ররা কথা বলে, কথাকারের দৃষ্টিকোণের ওপর প্রক্ষিপ্ত হয় চরিত্রদের দৃষ্টিকোণ।
মিলান কুন্দেরার আখ্যানগুলি বিন্যস্ত এই ‘পলিফনি’ ও ‘ভেরিয়েশন’-কে অবলম্বন করে। পলিফনির মতো ভেরিয়েশনও ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সংগীতের পরিভাষা। কিন্তু আজ আমরা কথা বলব বহুস্বর নিয়ে।
বহুস্বরের যে বাখতিনীয় বয়ান— তার থেকেও আশৈশব সংগীতের আবহে লালিত কুন্দেরার বোধহয় বেশি প্রিয় এর সাংগীতিক অনুষঙ্গটি। ধ্রুপদী সংগীতের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে আসে কুন্দেরার উপন্যাসে, উপন্যাসের তত্ত্ব বিষয়ক বিচিন্তনে। তাঁর ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’-এর ‘দ্য ডিপ্রিশিয়েটেড লিগ্যাসি অফ সেরভান্তেস’-এ অনেকটা বাখতিনের সুরে সুর মিলিয়ে তিনি বলছেন— তাঁর আখ্যান কোনও বিমূর্ত পরম সত্যের ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। সেখানে থাকে পরস্পর বিরোধী বহুসত্যের অবতারণা। আখ্যানের এই বহুস্বরিক বিশ্বে একমাত্র নিশ্চিতি নিয়ে আসে অনিশ্চয়তা। আর থাকে সমান্তরাল একাধিক কাহিনির অন্তর্বয়ন। লেখক যার নাম রেখেছেন ‘বহুস্বরিক আখ্যান’, যার বিপরীতে রয়েছে সরলরৈখিক ‘ধারাবাহিক’ আখ্যান।
‘দ্য টেস্টামেন্টস বিট্রেড’-এ হেরমান ব্রক-এর ‘দ্য স্লিপওয়াকার্স’ ট্রিলজির আলোচনা প্রসঙ্গে কুন্দেরা বলছেন— উপন্যাসটি যেন এক ‘বহুস্বরের নদী’। পাঁচটি আঙ্গিকে বিধৃত সমান্তরাল পাঁচটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর রচনার মধ্য দিয়ে বহমান— রিপোর্ট, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের আঙ্গিকে।
অতএব তিনটি অর্থে কুন্দেরা ‘বহুস্বর’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ১) একাধিক দৃষ্টিকোণের মধ্যে সংঘাত, ২) একাধিক কাহিনির অন্তর্বয়ন ৩) একাধিক আঙ্গিকের মিশ্রণ।
‘লাফেবল লাভস’-এর ক্ষুদ্র আখ্যানগুলি বা ‘দ্য জোকস’ উপন্যাসের মতো প্রারম্ভিক পর্বের রচনাগুলিতে বাখতিন-কথিত বহুস্বরের উপস্থিতি। বিভিন্ন কথক বা চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি আখ্যান বিবৃত হচ্ছে। বাখতিনীয় বহুস্বরের এমন সুস্পষ্ট প্রয়োগ থেকে এর পরবর্তীতে লেখক অবশ্য বিরত থাকবেন। তবে ফরাসিতে লেখা তুলনায় সংক্ষিপ্ত উপন্যাস ‘দ্য আইডেন্টিটি’ বাদ দিলে পরবর্তী আখ্যানগুলিতে কুন্দেরা প্রধানত ব্যবহার করেছেন ‘বহুস্বরিক আখ্যান’-এর আঙ্গিক, যেখানে ঘটে একাধিক কাহিনির অন্তর্বয়ন ও একাধিক আঙ্গিকের মিশ্রণ।
একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, ‘দ্য জোক’ ও ‘দ্য লাফেবল লাভস’-এ যেন বীজাকারে ধরা আছে কুন্দেরার সমগ্র সাহিত্যসার।
‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’-এ আবার আমরা দেখি মুখ্য চরিত্র ইয়েরোমিল-এর (Jaromil) সমান্তরালবর্তী অন্যান্য চরিত্রের কার্যকলাপ ও আচরণ। কাহিনির এক জায়গায় ইয়েরোমিলকে দেখা যায় তার প্রথম কবিতা মকশো করতে, এবং তার অনতিবিলম্বেই তার মাকে দেখা যাবে একটি চিঠির গদ্যে শান দিতে। চিঠিটি ছিল তার প্রেমিককে প্রত্যাখ্যানের, হৃদয়ের দুঃখ ঢেলে লেখা। তার অব্যবহিত পরেই ইয়েরোমিলকেও দেখা যাবে নিজের ব্যর্থ প্রেমকে কবিতার ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে । এইরকম অসংখ্য সমান্তরালের মধ্যে বিধৃত এই দুই চরিত্রের কার্যকলাপ ও আচরণ। এই সমান্তরালের মধ্য দিয়ে কবিতা থেকে রাজনীতি— প্রতিটি ক্ষেত্রে তার কার্যকলাপের গভীরে ডুব দিয়ে কুন্দেরা স্পষ্ট করে তুলেছেন ইয়েরোমিলের ধাতুগত আত্মরতিকে। ইয়েরোমিলের কাব্যময় অন্তর্যাপন প্রক্ষিপ্ত হয়েছে তার রাজনৈতিক বহির্ভুবনের ওপর।
‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এও এই এক সমান্তরাল আখ্যানের খেলা। কথকের হাতে ধরা স্ক্যালপেল। সে নিজেই ব্যবচ্ছেদ করছে উপন্যাসটিকে, জানাচ্ছে, আখ্যানের গভীরে নিহিত ঐক্য ও সংহতির কথা। চরিত্রদের অন্তর ও বহির্জীবন বা ইউরোপের পুব ও পশ্চিমের মধ্যে যে আপাত বিরোধের কথা আখ্যানে আছে, ‘হাসি ও বিস্মৃতি বিষয়ক বইয়ের সামগ্রিক নির্মাণ-কলার সাপেক্ষে সেসব, বস্তুত, বাহ্য ব্যাপার। এইসব ব্যবধানের থেকেও কথকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের এই অন্তর্নিহিত গভীর ঐক্যটি। কুন্দেরা এখানেও অধ্যায়ের পর্যায়ানুবৃত্তির খেলা খেলেন। কোনও অধ্যায়ে মুখ্যচরিত্রের অন্তর্জীবন, কোনও অধ্যায়ে তার বহির্জগত নিজেকে মেলে ধরে। কোনও অধ্যায়ে পূর্ব, কোনও অধ্যায়ে পশ্চিম ইউরোপ উঁকি মারে। কোনও অধ্যায়ে কুন্দেরার আত্মজীবন বিবৃত হয়, কোনও অধ্যায়ে নিছকই কল্পকথা ডানা মেলে। বিচিত্র সব বিষয়ভিত্তিক অধ্যায়গুলি ঘুরপাক খেতে থাকে প্রধান বিষয় ‘বিস্মরণ’-কে কেন্দ্র করে।
এই উপন্যাসের এক চরিত্র, জনৈকা চেক মেয়ে, তামিনা, প্যারিসে নির্বাসিত। এই নির্বাসন যেন এক বিশ্বের উপমা, যে বিশ্বে ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে। লাল রাশিয়ার বোহেমিয়া অভিযানকে ভুলিয়ে দিয়েছিল আলেন্দের হত্যা, আলেন্দের হত্যাকে ভুলিয়ে দিল বাংলাদেশের গণহত্যা, বাংলাদেশের গণহত্যাকে ভুলিয়ে দেয় সাইনাইয়ের যুদ্ধ— এভাবে ভুলতে ভুলতে মানুষ একদিন পৌঁছে যাবে এক সর্বাত্মক বিস্মরণে। এবং ধাপে-ধাপে কুন্দেরা পৌঁছে যান বিশেষ থেকে বিশ্বজনীনে। কাহিনির এক চরিত্র ‘মিরেক ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করছে ঠিক কমিউনিস্ট পার্টির মতো, সমস্ত পার্টির মতো, একেবারে মানুষের মতো’— বিশেষ থেকে বিশ্বজনীনে উত্তরণের আরেক উদাহরণ।
মানুষ যে শুধু ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে তা তো নয়, ভুলে যাচ্ছে সমষ্টির সঙ্গে সংযোগ, রতিসুখ বা রতিকলার মতো সর্বজনীন অথচ অন্তরঙ্গ সব অনুভূতি ও মূল্যবোধ।
ইউরোপের পুব ও পশ্চিম— এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও অঢেল সাদৃশ্য দেখতে পান কুন্দেরা। কারণ পৃথিবীর যে গোলার্ধেই থাকুক, মানুষ মূলত এক ধাতুতে গড়া। সামগ্রিক মানুষের সম্পর্কে কুন্দেরার ধারণাটি দাঁড়িয়ে মৌলিক দু’টি ঝোঁকের ওপর— ব্যক্তিগত স্তরে নিজের ভাবমূর্তি। কুন্দেরার মতে, এখানেই নাকি নিহিত ব্যক্তির চালিকাশক্তি। এবং সামাজিক স্তরে কৌতুক বা ছ্যাবলামি। কৌতুক কী করে? প্রথমত স্বৈরাচারের পর্দা ফাঁস করে দেয়; এ হল কৌতুকের রাজনৈতিক চরিত্র। তার এক আধিভৌতিক চরিত্রও আছে— সে মৃত্যুকে পর্দার মতো আড়াল করে রাখে।
পরিশেষে, আমরা এই প্রশ্ন করতেই পারি; এই যে কুন্দেরার আখ্যানে বহুস্বরের এত রকম ফের, প্রতিটি বহুস্বরের চরিত্র ও উদ্দেশ্য কি অভিন্ন? আমাদের উত্তর— দ্বন্দ্বের স্থান ও অভিমুখ ভেদে বহুস্বরের চরিত্র ভিন্নতা পায়। ‘দ্য জোক’-এ যেমন, বিভিন্ন স্বর পরস্পরের পরিপূরক ও স্ব-বিরোধী হয়ে উঠে একটা স্থির-অনিশ্চিত সত্যকে বলার চেষ্টা করে, তেমন, ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’-এ বিভিন্ন স্বরের অন্তর্নিহিত সাদৃশ্য আমাদের চমৎকৃত করে। ইয়েরোমিলের গল্পের সমান্তরালবর্তী হয়ে ওঠে র্যাঁবো বা অন্য কোনও মহান কবির জীবন।
অমিত স্বৈরাচারের দানবিক চেহারা স্বচক্ষে দেখা কুন্দেরার কাছে একরৈখিক বয়ান, আসলে, এক বিভীষিকা। তাই তিনি আখ্যানে উদযাপন করেন বহুস্বরের।