৯.
শুকনো জ্ঞানের কথা শুনতে কারও ভালো লাগে না। গলা শুকিয়ে ওঠে, এদিক-ওদিক চায়, সুযোগ পেলে আস্তে করে সরে পড়ে। যিশুখ্রিস্টের জন্মাতে যখন প্রায় ৬০০ বছর বাকি, তখন তো পৃথিবীর কত কিছুই আলাদা, শুদ্ধ, সরল। অথচ তখনও সাধারণের মধ্যে নীরস ধর্মকথা শোনায় একই রকম অনীহা। অগত্যা গৌতম বুদ্ধ গল্পের দ্বারস্থ হলেন। তারপর থেকে সব যুগের মহাপুরুষই– একেবারে হাল আমলের শ্রীরামকৃষ্ণদেব অবধি, বুদ্ধের দেখানো পথ ধরে ভক্তদের ছোট ছোট গল্প শুনিয়েছেন। গল্পের মিষ্টি আবরণ দিয়ে যদি অবুঝ মানুষকে কিছু তত্ত্বকথা, কোনও উপদেশ গলাধঃকরণ করিয়ে দেওয়া যায়।
জাতক কাহিনির উপযোগিতা এখানেই। বৌদ্ধরা বলেন, নানা পারমিতা প্রচার করার জন্যই জাতক কাহিনির অবতারণা। ‘পারমিতা’ মানে কিছু চিরন্তন গুণ। যেমন, দান, শীল, সংযম, বীর্য, ধ্যানশক্তি, প্রজ্ঞা। যুগ যুগ ধরে মানুষ এইসব গল্প পড়ে বা শুনে তার নিজের রুচি, প্রয়োজন, সাধ্য অনুসারে কোনও না কোনও গুণ আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করে।
আফসোসের কথা, যুগ যুগ ধরে নেতা, নেত্রী, রাষ্ট্রপ্রধানরা বোধিসত্ত্বের অন্তত একটি পারমিতা নিখুঁতভাবে পালন করে আসছেন।
একটু বুঝিয়ে বলি। নেতা-নেত্রীদের সম্পর্কে বরাবরের অভিযোগ, তাঁরা সমুখের কোনও সংকটকে সমাধানের অসাধ্য বুঝলে সাধারণের নজর অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে নানা কসরতের আয়োজন করেন। খাবারের অভাব ঘটলে ধর্মীয় আবেগ উসকে দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করেন, নিজের অকৃতকার্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠলে প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন। কে জানত, অত সহস্র বছর আগে বোধিসত্ত্ব স্বয়ং অমন এক ‘প্রজ্ঞা’-র পরিচয় রেখে গেছেন?
সে জাতকে বোধিসত্ত্ব বানর জন্ম নেন– যে সে বানর নয়, হিমবন্ত প্রদেশে এক বিশাল বানর পালের দলপতি। তাদের এলাকার কাছেই যে গ্রাম, তার মাঝখানে ছিল বিশাল এক গাব গাছ। তার পাকা ফল বানরদের খুব প্রিয়। কিন্তু ফল পাকলেই যে তারা নির্বিঘ্নে খেতে পায়, তা নয়। গ্রামের লোকেরা খুব সতর্ক। গাছে বানর দেখতে পেলেই তারা তাড়া করে, অস্ত্র নিয়ে মারতে যায়। শুধু তারা বাণিজ্যে বেরলে, বানরদের মওকা। তখন নিশ্চিন্তে ফাঁকা গ্রামে গোটা গাছ সাবাড় করে। বানররা তাই প্রায়শই খবর নেয়, গাব পাকলো কি না, গ্রামের লোক বাণিজ্যে বেরলো কি না।
সেবার খবর এল, ফল পেকে রসে টসটস করছে বটে, কিন্তু গ্রামবাসীদের এখনই ঘর ছাড়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন অপেক্ষা করার পর বানরদের পক্ষে আর লোভ সংবরণ করে থাকা সম্ভব হল না। তারা তাদের দলপতিকে জানাল, আমরা গভীর রাতে যাই, গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে থাকবে, কিছু বুঝতেও পারবে না।
বোধিসত্ত্ব তাদের বারবার নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। ‘চুরি করা মহাপাপ’ জাতীয় জ্ঞান দিয়ে এক্ষেত্রে লাভ নেই। তিনি বোঝাতে চেষ্টা করলেন, এমন অভিযানের বিপদের কথা। কিন্তু লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়—সেকালেও।
সুতরাং বানরের দল মাঝরাতে গাব খেতে এল। অত জনের মিলিত বাঁদরামিতে কিছু শব্দ হবেই। গ্রামের একজন বাইরে এসেছিল। তার আর বুঝতে ভুল হল না, তাদের সাধের গাব গাছে বানর পড়েছে। তার চিৎকারে গ্রামসুদ্ধ মানুষ লাঠি-সোঁটা, তির-ধনুক নিয়ে এসে গাছ ঘিরে ফেলল। রাতের আঁধারে ভালো ঠাওর না হলেও, বাছাধনরা পালাবে কোথায়? সকালবেলা উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
দোষ তো বানরদেরই ষোলো আনা। কিন্তু এখন সে ভাবলে তো চলবে না, নিজের দলবলকে বাঁচাতে হবে। বোধিসত্ত্বর ভাগনে সেনককে দিয়ে এই পরিস্থিতিতে যা করানো হল, তা ওই নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চিরচেনা কেরামতি।
এক বুড়ি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে ঘুমোচ্ছিল। সেনক চুপিসারে সেই জ্বলন্ত কাঠটি তুলে নিয়ে কয়েকটা খড়ের চালে আগুন লাগিয়ে দিল। হাওয়ার তেজে আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল এক চালা থেকে আর এক চালায়। গ্রামবাসীরা গাবতলা ছেড়ে পড়িমড়ি করে দৌড়ল আগুন নেভাতে।
তাদের সাধের জিনিস যে চুরি যাচ্ছে, সে দিকে আর তাদের খেয়াল করার উপায় রইল না।
ঋণ: তিন্দুক জাতক