জানবাজারের অন্দরমহলে ছোট-বড় নির্বিশেষে মথুরবাবুর পরিবারের প্রত্যেক মহিলা সদস্যদের কাছেই শ্রীরামকৃষ্ণ বিশেষ প্রিয়। তাঁরা কেউই তাঁর প্রতি কোনও সংকোচ বোধ করতেন না। বা বলা উচিত, রামকৃষ্ণকে তাঁরা কেউ ‘পুরুষ’ হিসেবে ভাবতেন না। ভাবত, তিনি যেন তাঁদেরই একজন নিকটবয়সিনী, অথবা নেহাত নিষ্পাপ বালক। যেমন, একদিন ভুলক্রমে রামকৃষ্ণ মথুরবাবুর শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়েছেন; তাঁকে অপ্রতিভ না করে মথুরবাবু ও জগদম্বা সস্নেহে তাঁকে আহ্বান করেন। তারপর থেকে মথুরবাবুরা কয়েকবার রামকৃষ্ণকে মাঝে শুইয়ে দু’জন দু’দিকে শয়ন করতেন। আবার মথুরবাবুর মেয়েরা অনেক সময় তাঁকে তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিতেন।
সেদিন দুর্গা-অষ্টমী। জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়িতে মহা সমারোহে আরতি হচ্ছে। রানির মৃত্যুর পরও তাঁর জামাই মথুরামোহন আয়োজনে কোনও কার্পণ্য করেন না। হঠাৎ মথুরবাবু খেয়াল করলেন, তাঁর স্ত্রী জগদম্বার পাশটিতে দাঁড়িয়ে এক অপরিচিতা চামর হাতে দেবীকে ব্যজন করছেন। ভদ্রমহিলার মহার্ঘ্য বেশভূষা। হাবভাবে স্পষ্ট, তিনি সম্ভ্রান্তবংশীয়া। জগদম্বার কোনও বন্ধু বা তুতো দিদি হবেন কি? আরতি শেষে মথুর স্ত্রীকে আড়ালে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে বল তো?
মথুরের প্রশ্ন শুনে জগদম্বা হেসেই আকুল, ‘চিনতে পারলে না? উনি আমাদের বাবা।’
স্তম্ভিত মথুরামোহন এই আদ্যন্ত ‘মেয়েলি’ ঠাটঠমকের আড়াল পেরিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ রামকৃষ্ণকে খুঁজে না পেলেও, ভালো করে ঠাওর করে বুঝলেন, এই সব অলংকার-বেনারসী তো তাঁরই এনে দেওয়া।
কিছুদিন আগে রামকৃষ্ণ একদিন হঠাৎ মথুরের কাছে মধুরভাবে সাধনের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। বলেন, মেয়েদের পোশাক এনে দিতে। মথুর জানতেন, এই বিষয় নিয়ে চারপাশের মানুষ নানা মন্দ রঙ্গ-মশকরা করবে। তবু দ্বিরুক্তি না করে মথুর এনে দেন যাবতীয় আবরণ-আভরণ: শাড়ি, ঘাগরা, পেশোয়াজ, ওড়না, কাঁচুলি, চোখের কাজল, মাথার সুবিন্যস্ত পরচুলা। তার সঙ্গে কত রকমের অলংকার: গলার হার, কানের দুল। নাকের বেসর, বাহুর বালা, কোমড়ের চন্দ্রহার, দু’-পায়ে নূপুর।
কিন্তু এ কেমন সাধনার ধারা?
এক্ষেত্রে মনে করা হয়, পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণই জগতে একমাত্র পুরুষ। আর সব কিছুই তাঁর মহাভাবময়ী প্রকৃতির অংশ থেকে উদ্ভূত– অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী। সুতরাং জীব যদি পুণ্যচিত্তে স্বামীরূপে কৃষ্ণ ভজনা করে, সে-ই হল মধুরভাব সাধনের মূল সূত্র। শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং যার চর্চা ও প্রচার করেছিলেন।
কিছুকাল আগেও এমন মধুরভাবের প্রতি বিকর্ষণ বোধ করতেন রামকৃষ্ণ। ভৈরবী ব্রাহ্মণীর তত্ত্বাবধানে যতদিন তন্ত্রসাধনা করতেন উগ্র পুরুষভাব ছিল তাঁর। পরে এল রামলালাকে কেন্দ্র করে বাৎসল্য রস। তখনও ভৈরবী যদি ব্রজগোপীদের ভাবে আবিষ্ট হয়ে কখনও মধুররসের গান ধরতেন, রামকৃষ্ণ বাধা দিতেন, ‘ও ভাব আমার ভালো লাগে না’, মায়ের ভজন শোনাও। সেই ভৈরবী এখন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বাগানে ভোরবেলা রামকৃষ্ণকে ফুল তুলতে দেখে ভাবেন, এ-ই কি আমার তন্ত্রসাধনার শিষ্য না কি স্বয়ং রাধারাণী?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কামারপুকুরে মহিলাদের সামনে গদাধর যখন নারী সেজে রাধা বা রাধার প্রধানা সখী বৃন্দার ভূমিকায় অভিনয় করে তখন কে বলবে সে পুরুষমানুষ! এমনকী, কখনও কখনও মজা করে গদাই মেয়েদের মতো সেজে মেয়েদের দলে মিশে হালদারপুকুরে যখন কলসি কাঁখে জল আনতে যেত কারও পক্ষে তাঁকে চেনার উপায় ছিল না। একদিন গদাধর বিকেলবেলা তাঁতি-বউ সেজে বগলে চুবড়ি নিয়ে, ঘোমটা দিয়ে হাটের দিক থেকে হেঁটে এসে রক্ষণশীল দুর্গাদাস পাইনের বাড়িতে ঢুকেছিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
একদিন ধাঁধা লেগে গেল হৃদয়েরও। মথুরবাবু সেদিন জানবাজার বাড়ির অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে রহস্য করে বললেন, বলো দেখি, ‘এঁদের মধ্যে তোমার মামা কোনজন?’ এত দীর্ঘকাল নিয়মিত তাঁর সঙ্গ এবং সেবা করেছে হৃদয়। তবু তার পক্ষেও রামকৃষ্ণকে চিনে নিতে বেশ মুশকিল হল!
রামকৃষ্ণ যখন দক্ষিণেশ্বরে থাকতেন, ভোরবেলা ফুল তুলে এক একদিন এক একরকম সুন্দর সুন্দর মালা গাঁথতেন। সাজাতেন রাধাগোবিন্দজীউকে। কখনও জগদম্বাকেও। তবে মধুরভাবের সময় তিনি অনেক সময়েই জানবাজারে মথুরবাবুর পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। কখনও দু’দিন, কখনও দশ দিন, কখনও একটানা মাস খানেকেরও বেশি।
সেখানে থাকলে মথুরবাবু নির্দ্বিধায় তাঁকে অন্তঃপুরেই রাখতেন। ছোট-বড় নির্বিশেষে তাঁর পরিবারের প্রত্যেক মহিলা সদস্যদের কাছেই তিনি বিশেষ প্রিয়। তাঁরা কেউই তাঁর প্রতি কোনও সংকোচ বোধ করতেন না। বা বলা উচিত, রামকৃষ্ণকে তাঁরা কেউ ‘পুরুষ’ হিসেবে ভাবতেন না। ভাবত, তিনি যেন তাঁদেরই একজন নিকটবয়সিনী, অথবা নেহাত নিষ্পাপ বালক। যেমন, একদিন ভুলক্রমে রামকৃষ্ণ মথুরবাবুর শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়েছেন; তাঁকে অপ্রতিভ না করে মথুরবাবু ও জগদম্বা সস্নেহে তাঁকে আহ্বান করেন। তারপর থেকে মথুরবাবুরা কয়েকবার রামকৃষ্ণকে মাঝে শুইয়ে দু’জন দু’দিকে শয়ন করতেন। আবার মথুরবাবুর মেয়েরা অনেক সময় তাঁকে তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিতেন। ভাবের ঘোরে তাঁর পোশাক এলোমেলো হয়ে গেলে তাঁরাই সব ঠিক করে দিতেন। মথুরের জামাইরা শ্বশুরবাড়ি এলে রামকৃষ্ণই মেয়েদের শাড়ি-গয়না পরিয়ে চুল বেঁধে দিতেন; তারপর সখীর মতো মজা-মশকরা করতে করতে হাত ধরে বরের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতেন।
রমণী সাজে রামকৃষ্ণের অবশ্য আবাল্য অনায়াস পটুত্ব। কামারপুকুরে মহিলাদের সামনে গদাধর যখন নারী সেজে রাধা বা রাধার প্রধানা সখী বৃন্দার ভূমিকায় অভিনয় করে তখন কে বলবে সে পুরুষমানুষ! এমনকী, কখনও কখনও মজা করে গদাই মেয়েদের মতো সেজে মেয়েদের দলে মিশে হালদারপুকুরে যখন কলসি কাঁখে জল আনতে যেত কারও পক্ষে তাঁকে চেনার উপায় ছিল না। একদিন গদাধর বিকেলবেলা তাঁতি-বউ সেজে বগলে চুবড়ি নিয়ে, ঘোমটা দিয়ে হাটের দিক থেকে হেঁটে এসে রক্ষণশীল দুর্গাদাস পাইনের বাড়িতে ঢুকেছিল। গৃহকর্তা তখন বন্ধু-পরিবৃত হয়ে বৈঠকখানায়। প্রশ্ন করে জানা গেল তাঁতিবউ আজ রাতের জন্য আশ্রয়প্রার্থী। দুর্গাদাস তাকে ভিতরবাড়িতে পাঠালেন। সেখানে মুড়িমুড়কি-সহ জলযোগ সেরে তাঁতিবউ বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে গল্পে মাতলেন। তাঁর পরনের মোটা মলিন শাড়ি, রূপার পৈঁছা, সর্বোপরি গদাধরের তুখড় অভিনয়– সব মিলিয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
কিন্তু এখন অভিনয় নয়। তাঁর ভেতর থেকে যেন রমণী ভাবের উদ্দীপন হচ্ছে।
প্রথম দিকে তিনি নিজেকে শ্রীরাধার অষ্টসখীর সেবিকা বলে মনে করতেন। শাস্ত্রে বলে নিষ্কাম কর্মই সকল কর্মের শ্রেষ্ঠ। সখীভাব আকাঙ্ক্ষাবিহীন সাধন–বৃন্দাবনেশ্বরী শ্রীরাধার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের শুভমিলন ঘটানোর জন্যই সখীদের যাবতীয় আয়োজন, নিজেদের কোনও প্রাপ্তির উদ্দেশ্য নেই। রামকৃষ্ণ তেমনই নারীসাজে সেজে নিঃস্বার্থ আকুলতায় ডাকতেন, কোথা ললিতা, কোথা বিশাখা, আমি তোমাদের দাসীর দাসী; আমার প্রতি দয়া করো, রাধার সাক্ষাৎ করিয়ে দাও, আমি যেন তাঁর সাহায্যে আসতে পারি।
একদিন এমন বিলাপ করছেন। এমন সময় হঠাৎ তাঁর সমুখে এক অপূর্ব লাবণ্যময়ীর আবির্ভাব হল। পূর্ণ যুবতী। পরনে তার জরির পেশোয়াজ-কাঁচুলি-ওড়না, অলংকারের আতিশয্য শরীরের সব ঢেউ আড়াল করেছে, মাথা ভর্তি কালো দামাল চুল, মুখে-চোখে সম্ভ্রান্ত স্নিগ্ধতা। রামকৃষ্ণের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে তিনি তাঁর হাতদু’টি নিজের হাতে তুলে নিলেন, পাঁচজোড়া আঙুলের মাঝে তাঁর পাঁচ জোড়া চাঁপার কলি প্রবেশ করিয়ে মৃদু চাপ দিলেন। অভিভূত রামকৃষ্ণ সজ্ঞা হারানোর আগে শুধু অস্ফূটে বললেন, রাধারাণী!
রামকৃষ্ণের মধুরভাব সাধনায় এক উত্তরণ ঘটল। এখন তিনি মনে করেন, তিনিই সখী-শিরোমণি, প্রেমময়ী রাধা।
হ্যাঁ, তিনিই শ্রীরাধা, আরাধ্যার সঙ্গে অভেদ অনুভব তাঁর। ‘স্বামী’ সম্বোধন করে শ্রীকৃষ্ণকে সজল চোখে তিনি সরাসরি আহ্বান করেন। বুকের খাঁচা নিংড়ে গান ধরেন, ‘শ্যামের নাগাল পেলুম না সই।/ আমি কী সুখে আর ঘরে রই।।’
দ্বৈতভাবসাধনার চরম উপলব্ধিতে পৌঁছে এই আকুলপারা আহ্বান শুধু শ্যামকে নয়, তিনি বুঝি ডাক দিচ্ছেন তাঁর সেই আগামী কান্ডারিকে যিনি তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন অন্য কোথা অন্য কোনখানে– অদ্বৈতভাবের অকূল পাথারে।
ঋণ
স্বামী সারদানন্দ। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ।
রামচন্দ্র দত্ত। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনবৃত্তান্ত।
ক্রিস্টোফার ইশারউড। রামকৃষ্ণ ও তাঁর শিষ্যগণ