ধর্ম হচ্ছে জীবনের অতন্দ্র প্রহরী, চিরসখা। তার অর্থকে একটিমাত্র শব্দে সীমায়িত করা যায় না। এই কল্যাণ-মহীরুহ গভীর দ্যোতনা নিয়ে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে। লিখছেন স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দ।
জীবন একরকমের বহতা নদী। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সুন্দর-অসুন্দর, সাফল্য-ব্যর্থতা, প্রেম-হিংসা, নিন্দা-প্রশংসা। জীবনে এই সমস্ত আবেগ-অনুভূতি নিরন্তর আসতেই থাকে। তা কখনও আমাদের উল্লসিত করে, কখনও দুঃখের পারাবারে নিয়ে যায়। এই জীবনপ্রবাহের মধ্য দিয়ে নিত্যই চলেছি আমরা। কিন্তু এরই সঙ্গে, এখন আমাদের অনুভূতিমালায় বিপুল পরিমাণে জুড়ে বসেছে দ্বিধা, সংশয়, অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা। এমনটা সম্ভব নয় যে, চাইলেই আমরা সরিয়ে ফেলতে পারি এই সমস্ত নঞর্থক বোধ। জীবনকে দেখতে গেলে তার সমগ্রটাই দেখতে হবে। শুধু দুঃখের বা শুধু সুখের রঙে জীবন নিরীক্ষণ করা চলে না। জীবনের একটা পূর্ণ পরিচয় আছে।
আরও পড়ুন: পুজোর পাঁচদিন কলকাতায় জ্যাম হয়! শুনেছি বটে, দেখিনি কখনও
মানুষের জীবনের যেমন একটা বাইরের ইতিহাস আছে, তেমনই আছে একটা অন্তরের ইতিহাস। ভেতর-বাইরের একটা সামঞ্জস্য কি আমরা তৈরি করতে উদ্যোগী? অন্তরে স্থায়ী আনন্দ আর শান্তি যে আমরা প্রত্যেকেই চাই। কিন্তু এই সবই নির্ভর করছে আমার, আমাদের চলার পথে চাওয়া-পাওয়ার ওপর। জীবনে কী চাই? সব চাওয়াই কি ঠিক চাওয়া? সব পাওয়াই কি যথার্থ পাওয়া? চাওয়া-পাওয়া আর না-চাওয়া, না-পাওয়ার সঙ্গে সুখ-দুঃখের একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব-মিশেল আছে। এই ‘কী চাই’-এর জন্য একটা শব্দ আমাদের দেশে বহুকাল আগে থেকে চলে আসছে– ‘পুরুষার্থ’। ‘পুরুষার্থ’-এ ‘অর্থ’ শব্দটি ‘প্রয়োজন’ রূপে ব্যবহৃত। ঋষিরা জীবনের লক্ষ্য বা চাওয়া সম্বন্ধে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, যে-চারটি প্রয়োজন মানুষের থাকে– ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। আমাদের জীবন এই চারটির আবর্তে থাকে।
ধর্ম শব্দের অর্থ এই– যা আমাদের ধরে রাখে। বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করে। যা আমাদের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত হতে দেয় না। ধর্ম ব্যক্তিসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। অর্থ, কাম– এগুলিরও তো প্রয়োজন আছে। তবে কতটুকু, তা বিচার্য। প্রয়োজন মানে লাগামছাড়া নয়, সেখানে নিয়ন্ত্রণ জরুরি। ধর্মের ইতিবাচক ভূমিকা এখানেই নিহিত। জীবনে চলার পথে শান্তি-আনন্দ যদি চাই, তাহলে চলার পথে কিছু ব্যাকরণ মেনে তো চলতে হবে। ধর্ম সেই ব্যাকরণ, যা মানবসমাজকে শ্রেয়ের পথে নিয়ে যায়। গভীর অরণ্যে চলতে গেলে একটা মানচিত্রর দরকার পড়ে। ধর্ম পুরুষার্থের মধ্যে একটি, যার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ হয়, কারণ ধর্ম হচ্ছে জীবনের অতন্দ্র প্রহরী, চিরসখা। তার অর্থকে একটিমাত্র শব্দে সীমায়িত করা যায় না। এই কল্যাণ-মহীরুহ গভীর দ্যোতনা নিয়ে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে।
আরও পড়ুন: খিদে মেটার পরও কেন ধানের শীষ নিয়ে যেত পাখিটি?
শুরুতে বলেছিলাম, জীবন-নদী, এখন জীবনের সঙ্গে ইচ্ছে করেই চারাগাছের তুলনা টানছি। যে চারাগাছ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে। জল, হাওয়া, বাতাস চাই তার। একটু ভাল সার হলে মন্দ হয় না। সঙ্গে একটা বেড়া– গরু-ছাগলে যাতে খেয়ে না ফেলে। এসব কিছুরই ব্যবস্থা প্রয়োজন, তাই কোনও একটিরও ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। ধর্ম আমাদের জীবনে এই ভূমিকাই পালন করে। ঠিক যত্ন পেলে ছোট্ট চারাগাছ যেমন ফুল-ফলে ভরা এক মহীরুহের রূপ নেয়, তেমনই প্রকৃত ধর্মের প্রভাবে আমাদের জীবন ছাপিয়ে উপচে পড়ে অফুরান শুভশক্তি। গাছ শুধু বাইরে বাড়ে তা নয়, ভেতরেও পুষ্ট হয়। আমাদের একটা অন্তর আছে, তাও গভীর হয়, সুন্দর হয়। আর তাই শান্তি ও আনন্দ। বাইরের জগৎ আর অন্তর জগতের মধ্যে যে নিরন্তর টানাপোড়েন, তা মুছে গিয়ে মানুষ ডুবে যায় এক গভীর নীরবতায়। এই অন্তরের সৌন্দর্যের উপলব্ধিই আধ্যাত্মিকতা। কেউ কেড়ে নিতে পারে না সে স্থায়ী সৌন্দর্য, ‘মানুষের মনে/ যে সৌন্দর্য জন্ম লয় শুক্নো পাতার মত ঝরে নাকো বনে/ ঝরে নাকো বনে’ (জীবনানন্দ দাশ)। যে গাছ অনেক বড় হয়, তার ছায়ায়, ফুলে-ফলে অনেক মানুষের উপকার হয়। যে মানুষ মহৎ হয়, সে হয় অনেক প্রাণের জুড়নোর জায়গা।