ছোটভাই বললেন, যে এমন চুরি করেছে তার যেন ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি, সিন্দুক উপচানো সোনা-রূপো হয়। মহাকাঞ্চন তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন শাপ-শাপান্ত করিসনি ভাই!’ আড়াল থেকে শক্র সব কিছু লক্ষ করছিলেন। এমন অদ্ভুত অভিশাপ এবং তার এমন অদ্ভুততর প্রতিক্রিয়া শুনে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।
রূপকথার গল্পের মতো তাঁরাও ছিলেন সাত ভাই, আর তাঁদের কোলে আদরের এক বোন। বোনের নাম কাঞ্চন। সবচেয়ে বড় দাদার নাম মহাকাঞ্চন। তিনিই সেই জন্মের বোধিসত্ত্ব। তাঁদের পিতা ছিলেন বারাণসীর অত্যন্ত সম্পন্ন ব্রাহ্মণ। বৃদ্ধ হলে তিনি বড় ছেলেকে বললেন, এবার সংসারে থিতু হও। ঘটককে খবর পাঠাচ্ছি।
মহাকাঞ্চন দৃঢ় গলায় বললেন, ‘ক্ষমা করুন। সংসার আমার জন্য নয়। আপনার অন্য সন্তানদের বিবাহের কথা ভাবুন।’
কিন্তু রাজি হলেন না কোনও ছেলেমেয়েই। সেকালে নারীরও একক জীবনযাপনে পুরুষের সমান অধিকার। বোন কাঞ্চন এবং ছয় ভাই তাঁদের অগ্রজকে বললেন, যে ধনে ধনী হয়ে তুমি জাগতিক সম্পদকে হেলা করতে পারছ, আমরাও নতশিরে তোমার কাছে সেই ধন ভিক্ষা করছি। মহাকাঞ্চন সন্তুষ্ট গলায় বললেন, ‘তবে তা-ই হোক।’
পিতৃ-মাতৃ বিয়োগ হলে পারলৌকিক কাজ সমাধা করে, সঞ্চিত সব ধন-দৌলত গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে, মহাকাঞ্চনকে সামনে রেখে তাঁরা চলে গেলেন হিমবন্ত প্রদেশে। পদ্ম সরোবরের তীরে সুন্দর এক আশ্রম তৈরি করে সবাই প্রব্রজ্যা নিলেন। একান্ত জপ-ধ্যানের জন্য প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কুটির প্রস্তুত হল।
বড়দাদা আর বোনকে আশ্রমে রেখে ভাইরা ভোরবেলা ফলমূল সংগ্রহে বেরতেন। কেউ কোনও উৎকৃষ্ট খাবার পেলেই চিৎকার করে অন্যদের জানিয়ে দিতেন কী কী পাওয়া গেল, বাকি কতটুকু দরকার।
কিন্তু মহাকাঞ্চন বললেন, এমন সোৎসাহ চিৎকারে যেন লোভের আভাস থাকছে; তাছাড়া তপোবনের শান্তিও টলে যাচ্ছে। আমিই বরং প্রতিদিন তোমাদের জন্য যতটুকু পাই সংগ্রহ করে আনি, তোমরা ভোরবেলা শান্তিতে ধ্যান করো।
তা কি আর ভাইরা মানতে পারেন? তাঁরা ঠিক করলেন ছয় ভাই পালা করে এক একদিন এক এক জন খাদ্য সংগ্রহ করে আনবেন, তারপর আশ্রমের মাঝের এক পাথরের ওপর খাবার সমান আট ভাগ করে সামান্য ঘণ্টাধ্বনি করবেন, যাতে যে যাঁর ভাগ এসে নিয়ে যান।
তেমনভাবেই চলছিল আট ভাই-বোনের নির্লোভ তপস্যা। সেই পুণ্যের মিলিত শক্তিতে টলে উঠল দেবরাজ শক্রের আসন। পরীক্ষা করার জন্য তিনি নেমে এলেন পদ্ম সরোবরের তীরে। দেখি তপস্বীরা লালসাকে কতটা জয় করতে পেরেছেন– এই ভেবে তিনি পরপর তিনদিন মহাকাঞ্চনের ভাগের খাবারটুকু সরিয়ে নিলেন।
প্রথম দিন মহাকাঞ্চন ভাবলেন, ভাই বোধহয় ভুলে গেছে। পরের দিন ভাবলেন, আমি কি কোনও দোষ করেছি, তাই ভাইরা আমার ভালোর জন্য শাস্তি দিচ্ছে? তৃতীয় দিন ভাবলেন, তবে তো অজান্তে করে ফেলা পাপের জন্য আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি বিকেলবেলা একবার ঘণ্টা বাজালেন।
এমন অসময়ে ঘণ্টাধ্বনি কেন? ভাইবোনরা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন।
সব ঘটনা শুনে তাঁরা তো অবাক! এই তিনদিন যাঁদের দায়িত্ব ছিল, তাঁরা নিয়মমতো সংগৃহীত খাবার আটভাগ করেছেন, ঘণ্টা বাজিয়েছেন। তাহলে এই ঘেরাটোপ থেকে তাঁদের অগ্রজের ভাগ কীভাবে চুরি যাবে?
ছোটভাই বললেন, যে এমন চুরি করেছে তার যেন ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি, সিন্দুক উপচানো সোনা-রূপো হয়।
মহাকাঞ্চন তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন শাপ-শাপান্ত করিসনি ভাই!’
আড়াল থেকে শক্র সব কিছু লক্ষ করছিলেন। এমন অদ্ভুত অভিশাপ এবং তার এমন অদ্ভুততর প্রতিক্রিয়া শুনে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।
দ্বিতীয় ভাই বললেন, ‘যে এ-কাজ করেছে স্ত্রী-পুত্রসহ সে যেন আজীবন বিষয়-আশয় নিয়ে মজে থাকে।’ অন্য ভাইরা একে একে বললেন, ‘সে মানুষ যেন গোলাভরা শস্য পায়, শাস্ত্রজ্ঞ হিসেবে সুখ্যাত হয়, রাজার মতো ক্ষমতাশালী হয়, অগণিত মানুষের দ্বারা পূজিত হয়।’ কাঞ্চন বললেন, ‘সে চোর যদি নারী হয়, তবে সে যেন রাজাধিরাজের প্রধানা রানি হয়।’
প্রতিবারই অন্যরা এমনভাবে শিউরে উঠছেন, যেন এত নির্মম অভিশাপ শুনতেও তাঁদের কষ্ট হচ্ছে।
শক্রের এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। তিনি বিমূঢ় হয়ে শুনলেন, সবশেষে মহাকাঞ্চন বলছেন, ‘খাদ্য পেয়েও যদি কেউ তা অস্বীকার করে, তবে অফুরান ইন্দ্রিয়সুখে সে যেন দীর্ঘজীবন কাটাতে পারে।’
সাত ভাই-বোন আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘দোহাই দাদা, আর যে সহ্য হয় না।’ শক্র আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি আবির্ভূত হয়ে বললেন, ‘সবাই জন্ম-জন্মান্তর ধরে যা আকাঙ্ক্ষা করে আপনারা তাকে এমনভাবে ঘেন্না করছেন?’
ভাই-বোনেরা বললেন, ‘বিষয় যে বিষ। তার থেকে রক্ষা পেতেই তো আমাদের প্রব্রজ্যা।’
শক্র জোড়হাতে বললেন, ‘আপনাদের পরীক্ষা করার জন্য আমিই মহাকাঞ্চনের খাবার আত্মসাৎ করেছিলাম। আমার শিক্ষা হয়েছে। আপনারা আমায় ক্ষমা করুন।’
বুকভরা তৃপ্তি নিয়ে আট ভাই-বোন আবার যে যাঁর কুটিরে ফিরে গেলেন।