‘ডবল’ সুপার ওভারই ভালো। মরা সিরিজে ওটাই ইউএসপি। ‘ডবল জিরো’র পর রোহিতের চওড়া ব্যাট সেঞ্চুরির শিখরে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ক্রিকেট দেবতার তাতে মন গলে না। দর্শকেরও। ঠান্ডা পানীয়-তে গলা ভেজানো শচীনদের মতো তারাও বলে ওঠে, ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’। চিন্নাস্বামীতে ২২ গজের কুলদেবতা কল্পতরু হন। শীতের দীর্ঘরাত দীর্ঘ টি-টোয়েন্টির জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রসব করে তাঁর প্রথম ‘ডবল’ সুপার ওভার ম্যাচ।
সে এক ফেলে আসা সময়। বিস্মৃতির পাহাড়ে হারিয়ে ফেলা বিন্দু বিন্দু মুহূর্ত। সময়ের দমকা বাতাস আচমকা হানা দিলে লজঝড়ে জানালা হাট হয়ে খুলে যায়। অগোছালো পাতার মতো সামনে এসে পড়ে ঝাপসা স্মৃতি। সেই দূর-দ্বীপবাসিনীদের হঠাৎ দেখে মন বলে ওঠে ‘চিনি তোমারে চিনি’। শীত তখন আরও জমকালো। সাদা-কালোর জগৎ ছাড়িয়ে পোর্টেবল টিভির রঙিন পৃথিবী গোগ্রাসে গিলছে হৃদয়। অ্যান্টেনা পেরিয়ে কেবলে তখন ‘সব পেয়েছি’র দুনিয়া। গেরস্তের কাছে দূরদর্শন ক্রমশ দুয়োরানি। স্টার থেকে সোনি তখন মধ্যবিত্তের ‘বেশ-করেছি’ সুলভ লাভ-অ্যাফেয়ার। মা-মাসি-পিসিদের টিভি সিরিয়ালের পরম্পরা সলতে পাকাচ্ছে। ভরদুপুরে স্কুলফেরত পা আটকে যায় সিনেমা হলের সামনে। দেওয়াল জুড়ে পোস্টারে নতুন নায়ককে বেমানান লাগে। ততটাই আকর্ষণীয় বলে মনে হয় ওই মিনি স্কার্ট, খোলা পিঠ। হলের সামনে জটলা-চোখ গিলে খেতে আসে। লজ্জায় এঁটো ঘাড় নুয়ে আসে। পা কখন গতি পেয়ে চেনা চৌকাঠে ঠেকে, পড়তে পারে না মন।
শীত পেরিয়ে হানা দেয় রুদালি গরম। টিভির পর্দায় বিজ্ঞাপনের ফাঁকে পড়াশোনা কান খুঁজে নেয়, অমুক দিনের রাতের তমুক সময়ে ‘কহো না প্যায়ার হে’-র চেনা বোল। ভেসে ওঠে নোনাধরা সিনেমা হলের দেওয়ালের মিনি স্কার্ট, নায়ক অজান্তে শরীরে কিলবিল করে। তারপর কয়েক জোড়া রক্তচক্ষু এড়িয়ে টিভির মুখোমুখি বেপরোয়া হৃদয়। ঠোঁটের কোণে জন্ম নিতে থাকে ছোট থেকে হঠাৎ বড় হওয়া শরীর। অজান্তে আবিষ্কৃত অগ্রজ ইশারায় অনুগামী হতে বলে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘ডাবল’-এর অযাচিত খুশি আবেশে মুড়ে রাখে শরীর। ডবল বলতে শুধুই ঋত্বিক, স্রেফ ‘কহো না…’। আগে যেমন ছিল মামলেট। ফি-বছর পুজোর আগে সেটাই ছিল বাড়ি বয়ে আসা ছোটমামার গলঃধকরণের সহজ উপায়। নতুন জামা, আর মা-র শাড়ির গন্ধে ভাগ বসাত ওই ‘ডবল ডিম’, হ্যান্ড-স্টোভের চটজলদি গুণে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
চলমান পর্দায় নায়ক জাঁকিয়ে বসে, সমুদ্র-সিক্ত নায়িকার ‘ক্যাহেতা হ্যায় মন, আপনা মিলন…’ বোল কণ্ঠনালীতে সাহারার জন্ম দেয়। হঠাৎ-ই ঘোর ভেঙে নায়ক তলিয়ে যায় জলে। গল্পের নটে গাছ মুড়নোর বিষণ্ণতার মুখে ফিরে আসে সেই নায়ক, ডাবল রোলে। তারপরে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনে ডগমগ মন উপেক্ষা করে শক্ত চোয়াল। উপযাচিত ভর্ৎসনা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
…………………………………………………………………………………………………………………………………
‘ডাবল’-এর অযাচিত খুশি আবেশে মুড়ে রাখে শরীর। ডবল বলতে শুধুই ঋত্বিক, স্রেফ ‘কহো না…’। আগে যেমন ছিল মামলেট। ফি-বছর পুজোর আগে সেটাই ছিল বাড়ি বয়ে আসা ছোটমামার গলঃধকরণের সহজ উপায়। নতুন জামা, আর মা-র শাড়ির গন্ধে ভাগ বসাত ওই ‘ডাবল ডিম’, হ্যান্ড-স্টোভের চটজলদি গুণে। পুজোর পরেই আগুয়ান ওই কানে-খাটো ছোট-দাদু। ডবল বলতে তার জগতে ছিল দোতলা বাস। সে তো মুগ্ধ স্মৃতি, ঝাপসাও বটে। বান্ধবীর চেনা হাত ছাড়িয়ে একদিন ইকো পার্কের পাশে অবাক চোখ আবিষ্কার করেছিল সেই ‘ডাবল ডেকার’-কে। চলৎশক্তিহীন। ঠিক ছোট-দাদুর দেওয়ালজোড়া ছবির মতো। আর ছিল ডাবল ধামাকা। পিনআঁটা কাগজের তোড়া, কাকিমার বড় ভাই ক্লান্ত মুখে ছড়িয়ে দিত সেসব বিছানায়। বিড়ির ফাঁক দিয়ে ছলকে উঠত তার দীর্ঘশ্বাস, আর একরাশ ধোঁয়া। সাবালক মন অনেক পরে জেনেছে, ওসব বাম্পার-লটারির দিবাস্বপ্ন।
কিন্তু কান? সে তো এখনও শোনে, ফেরিওয়ালার ডাক। থুরি, চলমান টেপরেকর্ডারের চেনা বুলি। ‘একটা কিনলে, আরেকটা ফ্রি’। মানে, ডবল পাওনা। ওই যে ট্রেভর মর্গ্যান। কলেজ কেটে সল্টলেক ভরানো দু’চোখে খামচে ধরা রবিন-টোলগে জুটি। ডাবল স্ট্রাইকারে ব্রিটিশ কোচের কেরামতি ভরে দিত একবুক টাটকা গর্ব। তাতেই ছাতি ফুলে ছাপান্ন। চওড়া ছাতির কথাতেই মনে পড়ে যায়, ডবল ইঞ্জিন সরকারের কথা। জনগণের মতো বুকের বাঁদিক গভীর অবিশ্বাসে ফিসফিসিয়ে ওঠে– যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।
এসবের চেয়ে ‘ডাবল’ সুপার ওভারই ভালো। মরা সিরিজে ওটাই ইউএসপি। ‘ডাবল জিরো’র পর রোহিতের চওড়া ব্যাট সেঞ্চুরির শিখরে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ক্রিকেট দেবতার তাতে মন গলে না। দর্শকেরও। ঠান্ডা পানীয়-তে গলা ভেজানো শচীনদের মতো তারাও বলে ওঠে, ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’। চিন্নাস্বামীতে ২২ গজের কুলদেবতা কল্পতরু হন। শীতের দীর্ঘরাত দীর্ঘ টি-টোয়েন্টির জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রসব করে তাঁর প্রথম ‘ডাবল’ সুপার ওভার ম্যাচ। ‘কহো না…’র পর্দার রোহিতের মতো হিটম্যানও ফিরে আসেন। ভারতের ম্যাচ জয়ের ডুবন্ত স্বপ্নকে ভাসিয়ে তোলেন। রবি বিষ্ণোইরা শেষ বলে মনে গেঁথে যান। উসকে দিয়ে যান কিছু ঝাপসা স্মৃতি। এক দমকায়। লড়ঝড়ে জানলা হাট করে।
শহরের অতীত ও ঐতিহ্য নির্মাণের এক বিশেষ মুহূর্ত ছিল বিশ শতকের গোড়ার বছরগুলি। এই সময়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটছে, কলকাতা পুরসভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের গলার জোর বাড়ছে, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে প্রথমবার শহরের রাস্তায় মানুষ মিছিল বের করছেন– ফলে বোঝাই যাচ্ছিল কলকাতার দাবিদার অনেক, শুধু ব্রিটিশ রাজপুরুষদের নয় এ শহর।