সামনের বছর জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেটাই যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার আসল মঞ্চ, তা ভালোই জানেন বিষ্ণোই। সেই ভাবনাই এখন কাজ করছে ভারতীয় স্পিনারের মগজে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যুজবেন্দ্র চাহালকে নিয়ে ভবিষ্যৎ দেখছেন না নির্বাচকরা। আর এক রবি, রবিচন্দ্রন অশ্বিনের স্পিন-ইন্দ্রজালও সীমিত ওভারে অস্তমিত। ফলে নির্বাচকদের বাজি এখন নতুন রবি, রবি বিষ্ণোই।
যোধপুর! নামটা মনে পড়লেই আচম্বিতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার বিভিন্ন খণ্ডচিত্র। সময়ের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েও সে স্মৃতি বাঙালির মনে চিরজাগরিত। কিন্তু ইতিহাস বিধৌত সেই মারোয়ার রাজধানীকে নতুন শতাব্দীতে চিনে নিতে হবে এক ভারতীয় ক্রিকেটারের ‘হ্যালির ধূমকেতু’র ন্যায় উত্থানের জন্য, তা কে জানত!
কথা হচ্ছে রবি বিষ্ণোইকে নিয়ে।
ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ হারের যন্ত্রণায় তখন কাতর গোটা দেশ, তখনই আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছেন রাজস্থানের এই তরুণ স্পিনার। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে রবির শিকার নয় উইকেট। সিরিজ সেরার সম্মান আদায় করে নিয়েছেন অচিরেই। তবে আসল পুরস্কার লাভ হয়েছে দিনকয়েক পর। আইসিসির টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বোলারদের ক্রমতালিকায় এখন সবার উপরে বিষ্ণোইয়ের নাম। মানে এক নম্বরে।
আফগানিস্তানের রশিদ খানকে সরিয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছেন ২৩ বছরের লেগস্পিনার। বাকি সব হেভিওয়েটদের পিছনে ফেলে আন্ডারডগ হিসাবে বাজিমাত করবেন রবি, আর পাঁচজন ক্রিকেটপ্রেমী জনতার মতো হয়তো কল্পনা করেননি খোদ বিষ্ণোই-ও। কিন্তু ক্রিকেটের ভাগ্যলক্ষ্মী কবেই বা চেনা ছকে ধরা দিয়েছেন রবির সামনে।
যোধপুর থেকে ৩২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রাম বিড়ামি। পাশ দিয়ে নীরবে ক্ষীণপ্রভ ছন্দে বয়ে চলেছে লুনি নদী। থর মরভূমির সেই পূর্বকোণায় অবস্থিত বিড়ামিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা রবি বিষ্ণোইয়ের। বাবা মঙ্গিলাল বিষ্ণোই স্থানীয় সরকারি স্কুলের হেডমাস্টার। দাদা অশোক ও দুই বোনের সঙ্গে বড় হওয়া ‘গাঁয়ের ছেলে’ বিষ্ণোইয়ের ছোটবেলা থেকেই ধ্যানজ্ঞান ছিল ক্রিকেট। আর সেই ব্যাট-বল প্রীতি রবি পেয়েছেন তাঁর মা সোহিনী দেবীর কাছে।
ভারতের ম্যাচ থাকলেই কাজ ভুলে টিভির পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেন সোহিনী দেবী। ছেলের মধ্যে সেই ক্রিকেট অনুরাগ সঞ্চারিত হয়েছে অচিরেই। শচীন-সৌরভের ব্যাটিং থেকে কুম্বলে, শেন ওয়ার্নের স্পিন মায়াজাল তন্ময় হয়ে দেখতেন মা ও ছেলে। সেই মুগ্ধতার রেশ ধরেই কুম্বলে, ওয়ার্ন হয়ে উঠেছিলেন ‘ছোট্ট’ রবির আরাধ্য। স্কুলের ‘কড়া’ হেডমাস্টার মঙ্গিলাল অবশ্য ক্রিকেটার নয়, চেয়েছিলেন পড়াশোনায় পারঙ্গম হোক দুই পুত্র। কিন্তু বিধি বাম। ক্রিকেটের নেশা শেষমেশ পেয়ে বসল বিষ্ণোইকে। সঙ্গে প্রশ্রয় দিলেন মা। তবে শর্ত একটাই, স্কুল থেকে বাবা ফেরার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে রবিকে। শৃঙ্খলা, অনুশাসনের সেই প্রারম্ভিক পাঠ পরিণত করেছিল সেদিনের রবি বিষ্ণোইকে।
কিন্তু পেশাদার ক্রিকেটার হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। অধ্যাবসায়ের সঙ্গে চাই অনুশীলনের অগাধ সুযোগ। প্রান্তিক বিড়ামিতে সে’সবের সুযোগ কোথায়! অগত্যা যোধপুর-যাত্রা। তবে ক্রিকেটার হওয়ার চেয়ে আরও বড় যুগান্তকারী পদক্ষেপ রচনা করেছিলেন বিষ্ণোই। কতই বা বয়স তখন তাঁর। বারো কি তেরো। পাঁচ বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে হাড়ভাঙা অক্লান্ত পরিশ্রম আর অলম্য জেদে তৈরি করেছিলেন সাধের ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। নাম দিয়েছিলেন, ‘স্পাটার্নস ক্রিকেট অ্যাকাডেমি’। প্রতিদিন ২০ কিলোমিটার বাইক চালিয়ে এসে সেখানেই চলত বিষ্ণোইয়ের একান্ত অনুশীলন। বিষ্ণোইয়ের রক্ত জল করে গড়ে তোলা এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমি এখন রাজস্থান ক্রিকেটে প্রতিভা তুলে আনার আঁতুড়ঘর হিসাবে চিহ্নিত।
তবে প্রথমদিকে স্পিনার নয়, মিডিয়াম পেসার হওয়াই লক্ষ্য ছিল রবির। পরে কোচের পরামর্শে শুরু করেন স্পিন। আর তাতেই সাফল্যের শুরু। সঙ্গে শুরু আইপিএলে খেলার স্বপ্ন দেখা। ২০১৮-তে সেই টানেই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় না বসে বিষ্ণোই ছুটে ছিলেন জয়পুর, রাজস্থান রয়্যালসের ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে। কিন্তু ওই যে রবি ভাবেন এক, ভাগ্যলক্ষ্মী করেন আর এক। দু’দিন রয়্যালসের ট্রায়ালে ডাক না পেয়ে বিফলমনোরথ হয়ে যোধপুরেই ফিরেই আসছিলেন বিষ্ণোই। কোচের পরামর্শে আরও একটা দিন থেকে যান।
আর সেদিনই নেটে ডাক পড়ে তাঁর। বল হাতে নজর কেড়ে নিতে কালক্ষেপ করেননি বিষ্ণোই। পরের বছর রাজস্থানের হয়ে বিনু মাঁকড় ট্রফিতে সাত ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন রবি। সেই অনবদ্য পারফরম্যান্স বিশ্বকাপে অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলে জায়গা করে দেয় বিষ্ণোইকে।
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে চারটে সহ মোট ১৭ উইকেট নিয়েছিলেন। তবে সাফল্য ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বিতর্কের রাহুগ্রাসে। ফাইনালে বাংলাদেশের কাছে হারের পর মেজাজ হারিয়ে প্রতিপক্ষ প্লেয়ারদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর জেরে আইসিসির নির্বাসনের মুখেও পড়তে হয় বিষ্ণোইকে।
প্রাপ্তিযোগও আছে। যে আইপিএল খেলার স্বপ্নে পরিবারের অমতে পরীক্ষায় বসেননি, সেই কোটি টাকার লিগে অপ্রত্যাশিত সুযোগ চলে আসে রবির কাছে। সুযোগ পান কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব (বর্তমানে পাঞ্জাব কিংস) টিমে। গতবার লখনউ সুপার জায়ান্টস টিমর জার্সিতেও চেনা ঔজ্জ্বল্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছে রবির পারফরম্যান্সে।
গত বছর টিম ইন্ডিয়ার জার্সিতে অভিষেকেও সমান উজ্বল ছিলেন বিষ্ণোই। সেই ধারাবাহিকতা দেখা গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সদ্য সমাপ্ত অস্ট্রেলিয়া সিরিজে। তার ফলস্বরূপ টি-টোয়েন্টিতে এখন নম্বর ওয়ান রবি। কিন্তু বিষ্ণোইয়ের স্বপ্ন যে আরও উঁচু তারে বাঁধা। সামনের বছর জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেটাই যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার আসল মঞ্চ, তা ভালোই জানেন বিষ্ণোই। সেই ভাবনাই এখন কাজ করছে ভারতীয় স্পিনারের মগজে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যুজবেন্দ্র চাহালকে নিয়ে ভবিষ্যৎ দেখছেন না নির্বাচকরা। আর এক রবি, রবিচন্দ্রন অশ্বিনের স্পিন-ইন্দ্রজালও সীমিত ওভারে অস্তমিত। ফলে নির্বাচকদের বাজি এখন নতুন রবি, রবি বিষ্ণোই।
বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে চাতক হয়ে থাকা ভারতবাসীকে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখাবেন ‘গাঁয়ের ছেলে’ রবি, সেটাই তো স্বাভাবিক।