সময়কে হারাতে পারেননি নাদাল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তার পরেও নিজে টেনিসের সময়হীন এক নক্ষত্র হয়ে থেকে গিয়েছেন। থেকে যাবেন। টেনিস নামক খেলাটা যত দিন বেঁচেবর্তে থাকবে, তত দিন জীবিত থাকবে ‘এসপানা’ লেখা অতিকায় বোর্ডের পাশ দিয়ে রাফায়েল নাদাল পেরিরার হাত তুলে টানেলে চির-অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার দৃশ্যপটখানি। সঙ্গে থেকে যাবে এক শব্দ। এক নাদ। এক অবিনশ্বর শঙ্খধ্বনি।
রাফা…রাফা…রাফা…!
রাফা…রাফা…রাফা…।
হাতের তালু খোলা-বন্ধের সঙ্গে স্নায়ু সংযমের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে কি না, জানা নেই। কিন্তু তাঁর হাত, মঙ্গল-রাতে তা করছিল। অবিরাম। অক্লান্ত। মুঠো একবার খুলছিল। একবার বন্ধ হচ্ছিল। স্পেনের জাতীয় সংগীত বাজবে একটু পর। গলা মেলাতে হবে প্রথামাফিক। কিন্তু অবাধ্য চোখের জল যদি রেয়াত না করে? স্বর যদি গানের স্বরবর্ণ ভুলে যায়? রাফায়েল নাদাল সব নিয়ে ঈষৎ সংশয়ে ভুগছিলেন কি? কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না? নাহ্, নাদালকে দোষ দেওয়া যায় না মোটে। এ লগ্ন যে, বড় দুঃখ-লগ্ন। এ বেলা যে, প্লেয়ারের কালবেলা। সহজে নিস্তার পাওয়া যায় নাকি তার থেকে? যতই তিনি রাফায়েল নাদাল নামক লৌহপুরুষ হোন না কেন, দিন শেষে রক্তমাংসের মানুষ যে! হৃদয়ে হাহাকারের শলাকা ফুটলে আজও যে ব্যথা লাগে।
আর ওই, উফ ওই মহাকালের ডাক– রাফা…রাফা…রাফা…। যা চলছে অবিরাম, অক্লান্ত। তাঁকে, তাঁর টেনিস-কৃষ্টিকে প্রদক্ষিণ করে যাঁরা সৃষ্টি করছেন সেই বিদায়ী মেঘমল্লার, সরকারি একটা নাম রয়েছে তাঁদের। সমর্থক কিংবা উপাসক। মালাগায় যাঁরা খেলা দেখতে এসেছেন। ডেভিস কাপের খেলা। ধুর। ডেভিস কাপ দেখতে কোথায় আর এসেছেন তাঁরা? দেখতে তো এসেছেন তাঁরা রাফায়েল নাদালকে!
দেখতে এসেছেন টেনিসের এক হারানোর সুরকে!
যে সুর মঙ্গল-রাতের পর চিরতরে কোর্ট থেকে হারিয়ে গেল। ঘাস। ক্লে। হার্ড। কোনও কোর্টেই আর দেখা যাবে না নাদালকে। আর কাকভোরে উঠে জিমে ছুটতে হবে না তাঁকে। আগ্রাসী হেডব্যান্ড মাথায় আর বাঁধতে হবে না। কোর্টের পাশের চেয়ারে স্তূপাকৃত করে রাখতে হবে না সার-সার জলের বোতল। এক, মাত্র এক মালাগা-রাতে কোথায় সব হারিয়ে গেল! এক পলকে। এক লহমায়।
বিদায়ী-রাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন নাদাল। পারেননি। আসলে এলিট স্পোর্ট পারফর্মারের বয়স নির্বিচারে একাধিক জিনিস দাবি করে। আচার। কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি। সময়-সময় মোক্ষম ঝাঁকুনি। পরিস্রুত স্কিল। শক্তি সম্পর্কে ধারণা। দুর্বলতা নিয়ে ভয়। এবং অবশ্যই প্যাশন। এ সমস্ত কিছু মহাজোট বাঁধলে প্লেয়ার তবেই প্লেয়ার ম্যাচ জেতে।
আটত্রিশের নাদাল সাধ্যমতো সমস্ত কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন গত রাতে। কিন্তু ওই যে পূর্বে লিখলাম, হয়নি। বিজয়ী নয়, বিদায়ী যুদ্ধে বিজিত থেকে যেতে হয়েছে তাঁকে। তবে হেরে গিয়েও হেরে যাননি তিনি। বরং সেই মর্যাদা নিয়েই কোর্ট ছেড়েছিলেন, যা তিনি পেয়েছিলেন পনেরো বছর বয়সে, কোর্টে প্রথম জয়ের সময়। অবশ্যই নাদাল চাননি তাঁর শেষের কবিতা এমন হৃদয়বিদারক হোক। কে আর অজ্ঞাতকুলশীল প্রতিযোগীর কাছে পরাভূত হয়ে সরতে চায়? রাফা কোর্টের শেষ যুদ্ধে হারলেন যাঁর কাছে, তাঁর নাম লিখতে গেলে বানান ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা! কেউ চেনে নাকি বোটিক ফান দে জন্ডস্কালপকে, বিশ্বের ৮০ নম্বরকে?
……………………………………………………………….
মাত্র আঠারো বছর বয়স যখন, ডাক্তাররা নাদালকে বলেন যে, বাঁ পায়ের একটা ছোট হাড় তাঁকে প্রবল ভোগাতে চলেছে! যন্ত্রণা এতটাই অসহনীয় পর্যায়ে যায় যে, বছর দেড়েকের মধ্যে স্পেনীয় টেনিস-আর্মাডা প্রায় চলৎশক্তিরহিত হয়ে যান! ডাক্তাররা মোটামুটি নিদান দিয়েও দিয়েছিলেন তাঁকে যে, টেনিস ছাড়তে হবে! যা শোনার পর নাদালের মনে হয়েছিল, কেউ বুঝি করাত দিয়ে তাঁর জীবনকে দু’ভাগ করে দিয়েছে! বিশ্বাস না হলে, নাদালের আত্মজীবনী পড়ে নিন।
……………………………………………………………….
তবু, তার পরেও জেক পলের বিরুদ্ধে মাইক টাইসনের মতো করুণ পরিণতি হয়নি স্পেনীয় মহাযোদ্ধার। বরং প্রতিটা পয়েন্ট, প্রতিটা মুহূর্তকে কব্জা করতে আটত্রিশের শরীরকে আছড়ে-পিছড়ে ফেলেছেন কোর্টে। স্কোরলাইন দেখলে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে– নাদাল হেরেছেন ৪-৬, ৪-৬। যার অর্থ, উনত্রিশের ডাচ প্লেয়ার চুরমার করে দিতে পারেনি ‘বৃদ্ধ’ নাদালকে। পয়েন্ট তিনিও পেয়েছেন। ক্ষমতা অনুপাতে কেড়ে নিয়েছেন। তলিয়ে দেখলে, ঠিকই আছে। এ অতি স্বাভাবিক, এটাই তো হওয়ার ছিল। স্পেন বলতে আমরা যা বুঝি, সেই তিকিতাকার পেলবতা কখনওই ছিল না নাদালের খেলায়, চরিত্রে। বরাবরই তিনি লড়াকু। খুনে। যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশ্বাসী। মাত্র আঠারো বছর বয়স যখন, ডাক্তাররা নাদালকে বলেন যে, বাঁ পায়ের একটা ছোট হাড় তাঁকে প্রবল ভোগাতে চলেছে! যন্ত্রণা এতটাই অসহনীয় পর্যায়ে যায় যে, বছর দেড়েকের মধ্যে স্পেনীয় টেনিস-আর্মাডা প্রায় চলৎশক্তিরহিত হয়ে যান! ডাক্তাররা মোটামুটি নিদান দিয়েও দিয়েছিলেন তাঁকে যে, টেনিস ছাড়তে হবে! যা শোনার পর নাদালের মনে হয়েছিল, কেউ বুঝি করাত দিয়ে তাঁর জীবনকে দু’ভাগ করে দিয়েছে! বিশ্বাস না হলে, নাদালের আত্মজীবনী পড়ে নিন।
সেই রাহুদশার রক্তচক্ষুকে ফুৎকারে উড়িয়ে পরবর্তীতে প্রত্যাবর্তন। ২২-টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়। ট্রফি বিচারে কিংবদন্তি রজার ফেডেরারকে ছাপিয়ে যাওয়া। রজার-মহাকাব্যের শ্রেষ্ঠত্বকে বুনো সাহস আর দ্রোহের স্পর্ধা দিয়ে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া। সাধে কী আর গত মাসে অবসর-লগ্ন ঘোষণার সময় নাদাল শপথ নিয়েছিলেন, অন্তিম ম্যাচে প্রয়োজনে কোর্টে তাঁর শরীর পড়ে থাকবে, কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে বেরোবেন না! সাধে কী আর বব ডিলান উদ্ধৃত করে তাঁকে বলা হয়, ‘ফরএভার ইয়ং’? কোনও এক লেখায় পড়েছিলাম, একবার এক সাংবাদিককে কথাটা বলেওছিলেন নাদাল। বছর সাত পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে উনিশ বছরের আন্দ্রে রুবেলভকে খেলার আগে তিনি বলে ফেলেছিলেন, ‘‘রুবেলভের বয়সটা পেলে বেশ হত। আমি চাই না, বয়স বাড়ুক আমার। চাই, আমার বয়স উনিশ-কুড়িতেই আটকে থাকুক!’’
সময়কে হারাতে পারেননি নাদাল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তার পরেও নিজে টেনিসের সময়হীন এক নক্ষত্র হয়ে থেকে গিয়েছেন। থেকে যাবেন। টেনিস নামক খেলাটা যত দিন বেঁচেবর্তে থাকবে, তত দিন জীবিত থাকবে ‘এসপানা’ লেখা অতিকায় বোর্ডের পাশ দিয়ে রাফায়েল নাদাল পেরিরার হাত তুলে টানেলে চির-অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার দৃশ্যপটখানি। সঙ্গে থেকে যাবে এক শব্দ। এক নাদ। এক অবিনশ্বর শঙ্খধ্বনি।
রাফা…রাফা…রাফা…!
…………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………
তত্ত্ববিদ, মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার কাজ নিয়েছে মস্কো রেডিয়োতে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ‘মির’ বা ’প্রগতি’তে অনুবাদক হয়েছে, কেউ বা সাংবাদিকতায় পি.এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করে সংবাদপত্রের দফতর খুলে তার অন্তরালে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।