ব্রাজিলের ফুটবলের ঐতিহ্য, ফুটবল ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পেলে প্রথম ব্রাজিলীয় ফুটবল, সেলেসাও-কে সার্বিক রূপ দেন, জনপ্রিয় করেন। কিন্তু ব্রাজিলীয় ফুটবলের সঙ্গে নাড়ির যোগ যদি কারও থেকে থাকে, তা মারিও জাগালোর। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের আলাগোয়া প্রদেশের মারিও লোবো জাগালোর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেলেসাও ফুটবলের এক বর্ণময় ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটল।
১৯৫৮-তে বিশ্বকাপ প্রথমবারের জন্য যে ব্রাজিল দল জিতেছিল, তার সদস্যদের প্রত্যেকেরই মারাকানাজো নিয়ে কোনও না কোনও গল্প আছে।
১৯৫০-এর জুলাই মাসের ১৬ তারিখ শুধুমাত্র ড্র করলেই যেখানে প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপ জিতত ব্রাজিল, তাও নিজের দেশে। সেই ম্যাচে, উরুগুয়ের কাছে ১-২ গোলে হার জাতীয় বিপর্যয় হয়েছিল। ব্রাজিলের ফুটবল দর্শন প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল।
সেই ১৬ জুলাই, ১৮ বছরের সদ্য বাধ্যতামূলক সেনায় যোগদানকারী এক তরুণ, সামনের সারিতে বসে সেই বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যন্ত্রণাটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছিলেন। অনুভব করেছিলেন, ডিফেন্স খোলা রেখে আক্রমণে গেলে, কী হতে পারে। এর পরের বছর ফ্ল্যামেঙ্গো ক্লাবে যোগ দেন তিনি। ফ্ল্যামেঙ্গোয় দশ নম্বর প্লে মেকারের জায়গায় তাকে বামপ্রান্তিক উইঙ্গারের জায়গায় খেলানো হয়। তবে আর আট বছর পরে হয়তো বিশ্বকাপ খেলা হত না তাঁর, যদি না ভিসেন্তে ফিওলার দলের নির্ভরযোগ্য তারকা পেপে আহত হতেন। বিশ্বকাপে জায়গা পেলেন এবং পেলে, ভাভা, গ্যারিঞ্চার দুর্ধর্ষ ফরোয়ার্ড লাইনের বামপ্রান্তের দায়িত্ব পেলেন।
মারিও জর্জে ‘লোবো’ জাগালো। পর্তুগিজে লোবো অর্থাৎ নেকড়ে।
ছোট্টখাট্টো জাগালোর চলাফেরায় ছিল নেকড়ের ছটফটানি। ফিওলা, জাগালোকে পছন্দ করেছিলেন কারণ, বিপক্ষের পায়ে বল থাকলে জাগালো নেমে এসে ডিডি এবং জিটোর মাঝমাঠের তৃতীয় স্তম্ভ হিসেবে কাজ করতেন। আর আক্রমণে তাঁর অবিরাম সচল থাকা তো ছিলই। পরিশ্রমের সেরা পুরস্কার হিসেবে ছিল, বিশ্বকাপের ফাইনালে চতুর্থ গোল।
’৬২-র বিশ্বকাপেও তিনি ছিলেন, ব্রাজিল দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু ’৫৮-র বিশ্বকাপ থেকে ফিরে ফ্ল্যামেঙ্গো থেকে বোটাফেগোয় গিয়ে তাঁর ফুটবলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই পালটে গেল। ১৯৫২ থেকে ’৫৬– দুনিয়া কাঁপানো হাঙ্গেরি দলের অধিকাংশই এসেছিলেন, সামরিক ফুটবল দল হনভেড থেকে। পুসকাস, জিবর, ককসিস। এঁদের কোচ ছিলেন বেলা গাটমান। যিনি পরে ব্রাজিলের বোটাফেগোর কোচ হন। বেলাই ৪-২-৪-এ উইঙ্গারের ভূমিকা, রোভিং স্ট্রাইকারের ভূমিকা অথবা ডিফেন্সিভ স্ক্রিনের ভূমিকা হাতে ধরে শেখান মারিও-কে।
দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে ১৯৭০-এ। ১৯৬৬-তে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পরে কোচ জোয়াও সালদানার হাত ধরে ব্রাজিল ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ১৯৭০-এর আসন্ন মেক্সিকো বিশ্বকাপের ঠিক আগেই সালদানা তাঁর সংবাদপত্রের কলামে সমালোচনা করে চাকরি খোয়ালেন। স্থলাভিষিক্ত হলেন, ৩৮ বছরের বোটাফেগোর কোচ জাগালো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছোট্টখাট্টো জাগালোর চলাফেরায় ছিল নেকড়ের ছটফটানি। ফিওলা, জাগালোকে পছন্দ করেছিলেন কারণ, বিপক্ষের পায়ে বল থাকলে জাগালো নেমে এসে ডিডি এবং জিটোর মাঝমাঠের তৃতীয় স্তম্ভ হিসেবে কাজ করতেন। আর আক্রমণে তাঁর অবিরাম সচল থাকা তো ছিলই। পরিশ্রমের সেরা পুরস্কার হিসেবে ছিল, বিশ্বকাপের ফাইনালে চতুর্থ গোল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
দায়িত্ব নিয়েই ছোট্ট কয়েকটা পরিবর্তন করলেন জাগালো। প্রথমত, শক্তপোক্ত পিয়াজ্জাকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে এলেন সেন্ট্রাল ডিফেন্সে। ফলে, ক্লডোয়াল্ডো ৬ নম্বর জায়গায় সুযোগ পেলেন, যাঁর বল বিতরণ ছিল অসাধারণ। তারপরের কঠিন সমস্যাটি ছিল, আক্রমণভাগে একগাদা বলপ্লেয়ার। কাকে ছেড়ে কাকে নেবেন! পেলে, গারসন, রিভেলিনো আর টোস্টাও। সঙ্গে আবার গতিশীল জেয়ারজিনহো। সমাধান হিসেবে, রিভেলিনোকে ঠেলে দিলেন বামপ্রান্তে, সঙ্গে কাট করে ভিতরে ঢুকতে পারার ঢালাও অনুমতি। গারসনকে মাঝমাঠের সূক্ষ্ম পাসিং গেম খেলার জন্য রেখে পেলেকে একটু নিচ থেকে শুরু করালেন, একদম পাক্কা ১০ নম্বর। টোস্টাও? তাঁকেও এই দলে ফিট করলেন তিনি, তবে পেলের সামান্য উপরে। পেলে এবং টোস্টাও ক্রমাগত উঠে নেমে খেলে ডিফেন্ডারদের বিপক্ষের রক্ষণ ভাগের সমস্ত পরিকল্পনার দফারফা করলেন। আর ডানদিক থেকে ওভারল্যাপে কার্লোস আলবার্তো এবং ইনসাইড রাইট হিসেবে বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে গোলকারী জেয়ারজিনহো। সেরা প্লেয়ারদের একসঙ্গে মাঠে নামিয়ে দিলেই হয় না। তাদের থেকে সেরাটা বারও করে নিতে হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
১৯৭৪-এ অবশ্য জাগালোর বিশ্বজয়ী টিমের বিজয়রথ সেমিফাইনালেই থেমে যায় রেনাস মিশেলের ‘ফ্লাইং ডাচ’ বিশেষত জোহান ক্রুয়েফদের হাতে। এরপর ২৪ বছর ব্রাজিল জাতীয় দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। মধ্যে কুয়েত বা সৌদি আরবের কোচিংও করিয়েছেন তিনি। ১৯৮২-র দিল্লি এশিয়াডে কোয়ার্টার ফাইনালে পি. কে. ব্যানার্জির ভারতকে শেষ মুহূর্তের গোলে হারানো সৌদি আরবের কোচ ছিলেন জাগালোই।
২৪ বছর জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু জাগালোর ট্যাকটিক্যাল জ্ঞান সম্পর্কে শ্রদ্ধা সমগ্র ব্রাজিলের সবসময়ই ছিল। দুই যুগ পরে বিশ্বকাপ জিততে, কার্লোস আলবার্তো পেরিরা-র (নাকি পাহিরা?) সঙ্গে সিবিএফ জুড়ে দেয় জাগালোকে, কো-অর্ডিনেটর হিসাবে। আর জাগালো দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার আলদেয়ার, মরসিও স্যান্টোস এবং দুঙ্গা, মাজিনহো আর মাউরো সিলভার একটা মোবাইল পঞ্চভূজ তৈরি করেন। তাদের ঘিরেই, দুই উইং ব্যাক লিওনার্দো/ ব্র্যাঙ্কো আর জরজিনহো/ কাফু এবং সামনে জোড়া ফলা– বেবেতো আর রোমারিও। সঙ্গে মাঝে সংযোগ স্থাপনকারী জিনহো। ডিফেন্সটা জাগালোর নিজের হাতে সাজানো।
আধুনিক ফুটবলটা জাগালো গুলে খেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও তাঁর খিদে মেটেনি। নিজেকে বরাবর আপডেটেড রেখে গেছেন। ’৯৮-এ রোমারিও-বিহীন ব্রাজিলকে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়েও গেছেন, হেড কোচ হিসেবে।
আর তার পরেরবার, আবার এবং শেষবারের মতো বিশ্বকাপজয়ী রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহোদের ব্রাজিলের লুই ফিলিপে স্কোলারির সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেছেন বর্ষীয়ান জাগালো। অর্থাৎ, ব্রাজিলের প্রতিটি বিশ্বকাপ জয়েই অবদান রয়েছে জাগালোর।
ব্রাজিলের ফুটবলের ঐতিহ্য, ফুটবল ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পেলে প্রথম ব্রাজিলীয় ফুটবল, সেলেসাও-কে সার্বিক রূপ দেন, জনপ্রিয় করেন। কিন্তু ব্রাজিলীয় ফুটবলের সঙ্গে নাড়ির যোগ যদি কারও থেকে থাকে, তা মারিও জাগালোর। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের আলাগোয়া প্রদেশের মারিও লোবো জাগালোর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেলেসাও ফুটবলের এক বর্ণময় ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটল।
বর্তমানে ব্রাজিলের ফুটবল এক অদ্ভুত ডামাডোলের মধ্য দিয়ে চলেছে। গোল করার লোক নেই, সাইড ব্যাক নেই, সিবিএফে দুর্নীতি, ফিফা হয়তো সাসপেন্ডও করে দিতে পারে, বহুদিন আলোচনায় থেকেও কার্লো আন্সেলত্তি মাদ্রিদেই থেকে গেলেন, ডোরিভাল জুনিয়র কোচ হলেন, কিন্তু তাঁরও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা, যেমন চিন্তা এই প্রজন্মের শেষ তারকা নেমার আর ফিরে আসতে পারবেন কি না! এর মধ্যে ১৯৫৮-র প্রথম বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলের শেষ প্রদীপটিও নিভে যাওয়াটা এক অদ্ভুত অর্থপূর্ণ ঘটনা। কে জানে, এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই হয়তো পুনরুত্থান হবে ব্রাজিলের। কিন্তু সেই পুনরুত্থানের সলতে পাকানোর জন্য থাকবেন না মারিও জাগালো। সেলেসাওয়ের ফুটবল আত্মা চিরঘুমে চলে গেলেন মাত্র বিরানব্বই বছর বয়সে।
চিরপ্রণাম।