দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার অন্তহীন গভীরতায় আজ শুধু শেষ সূর্যের সাফল্যের বর্ণচ্ছটা। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটি রিক্ত, ব্যর্থতার কালিতে দগ্ধ করেছিল ‘দ্য ওয়াল’-এর, পরিশেষে সফলতার রঙিন টানে বৃত্ত সম্পন্ন করলেন ‘মিস্টার ডিপেন্ডবল’। ভারতীয় ক্রিকেটে এমন মায়াভরা মুহূর্ত এর আগে আসেনি। ভারতীয় ক্রিকেট তার হৃদয়ে এই মুহূর্তকে পালন করবে চিরকাল।
এই আমরা যারা, এই শহরে, এই ক্রিকেটপাগল দেশে হুড়মুড় করে বেড়ে উঠেছি, আমাদের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতে ক্রিকেট সাক্ষাৎ বিধাতার দেউল। যে আরাধ্য দেবভূমিতে জীবন্ত বিগ্রহ রূপে বিরাজ করেন ক্রিকেটাররা। আবেগের সার-জলে সেই বেদীমঞ্চে পূজার অর্ঘ্য লাভ করেন তাঁরা। সময়ের সঙ্গে সেই বিগ্রহের বিনির্মাণ ঘটে। সুনীল মনোহর গাভাসকর থেকে তা রূপ পরিগ্রহ করে শচীন রমেশ তেণ্ডুলকরে, সময়ের দমকা বাতাসে সেই আদল বদলে গিয়ে হয় মহেন্দ্র সিং ধোনি কিংবা বিরাট কোহলি। আমাদের অন্তরাত্মা সাক্ষী, সেই হৃদয় পদ্মাসনে আপনি, রাহুল শরদ দ্রাবিড় ছিলেন না কোনওদিন। রোহিত গুরুনাথ শর্মা, দুঃখিত, আমরা আপনাকেও সেই মহার্ঘ্য স্থান দিতে পারেনি।
আসলে আমরা অপারগ, আমাদের বিবেচনাবোধের অক্ষমতায়। আমাদের পার্থিব চেতনায় আপনারা বরাবর ছিলেন ‘সেকেন্ড বেস্ট’। প্রথম আরাধনার ফুল আমরা চিরকাল তুলে রেখেছে যাঁদের কল্যাণে, সেই পঙক্তিতে আপনারা অন্তর্ভুক্ত নন। আপনারা, নীরবে সহ্য করেছেন সেই অনাচার। কিন্তু ক্রিকেটবিধাতা? তিনি কি কখনও পেরেছেন আপনাদের প্রতি সুবিচার করতে? পেরেছেন যোগ্য সম্মানের বরমাল্য পড়িয়ে স্বীকৃতির সিংহাসনে আসীন করতে? পারেননি।
যদি পারতেন, তাহলে, শনির পড়ন্তবেলায় বার্বাডোজের বুকে শান্তিবারি নেমে আসত না। সেই বৃষ্টি আসলে ক্রিকেট বিধাতার চোখের জল, আবেগের ঝর্ণাধারা, যাতে সিক্ত হল রোহিত– আপনার তপ্ত হৃদয়, দ্রাবিড়– আপনার আক্ষেপের ভুবন। আপনাদের চোখের জলের বাঁধভাঙা পৃথিবীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল বিধাতাপুরুষের আবেগের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। রোহিত কাঁদছেন। দ্রাবিড়, তাঁর চেনা সংযত, সহনশীলতার বেড়া ডিঙিয়ে শূন্য ছুঁড়ে দিচ্ছেন মুষ্টিবদ্ধ হাত, বিশ্বকাপ আঁকড়ে ধরে। দেখে মনে ভ্রম জাগতে শুরু করেছিল, এ কোনও মায়ালোক নয় তো! নয়তো কোনও আলেয়ামাখা মরীচিকা! বিরাট কোহলি! তিনিও তো আবেগস্নাত। তাঁর লৌহকঠিন চোয়াল, যা দেখে হাড়হিম হয় প্রতিপক্ষের, তাঁরও তো দু’চোখ বেয়ে নেমে আসছে অবিরাম অশ্রু। হার্দিক পান্ডিয়া, শিশুর মতো কাঁদছেন, যেন রিক্তিশূন্য এক মরুভূমিতে বাঁচার মানেটা হঠাৎ খুঁজে পেয়েছেন চলতে-চলতে। ২০২৪-এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুধু প্লেয়ার হিসেবে নয়, তাঁকে জীবনযুদ্ধে সহজপাঠও শিখিয়ে গেল। বুঝিয়ে দিল, ক্রিকেট হোক কিংবা অনন্ত-জীবন, ২২ গজে দাঁড়িয়ে থেকে লড়ে যাওয়াটাই অমরত্ব লাভের সূচক। হার্দিক শত যন্ত্রণা আর উপেক্ষা সয়ে সেই মোক্ষলাভের দ্বারে পৌঁছতে সক্ষম হলেন। হলেন সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে, যার অপেক্ষায় ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতিটি সজীব, সমর্থনশীল হৃদয়। আসলে এই মুহূর্ত শাচমোচনের। ১৩ বছরের খরার শৃঙ্খল ভেঙে বিশ্বজয় করল টিম ইন্ডিয়া। সেটাও খুব সহজে নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মুখের গ্রাস কেড়ে, ২০০৭-এর প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বজয়ের স্মৃতি উসকে।
…………………………………………………………………………………………………………………………
রোহিত কাঁদছেন। দ্রাবিড়, তাঁর চেনা সংযত, সহনশীলতার বেড়া ডিঙিয়ে শূন্য ছুঁড়ে দিচ্ছেন মুষ্টিবদ্ধ হাত, বিশ্বকাপ আঁকড়ে ধরে। দেখে মনে ভ্রম জাগতে শুরু করেছিল, এ কোনও মায়ালোক নয় তো! নয়তো কোনও আলেয়ামাখা মরীচিকা! বিরাট কোহলি! তিনিও তো আবেগস্নাত। তাঁর লৌহকঠিন চোয়াল, যা দেখে হাড়হিম হয় প্রতিপক্ষের, তাঁরও তো দু’চোখ বেয়ে নেমে আসছে অবিরাম অশ্রু। হার্দিক পান্ডিয়া, শিশুর মতো কাঁদছেন, যেন রিক্তিশূন্য এক মরুভূমিতে বাঁচার মানেটা হঠাৎ খুঁজে পেয়েছেন চলতে-চলতে।
…………………………………………………………………………………………………………………………
যেন ফিরতে বসেছিল সাত মাস আগের করাল রাত্রি। ১৯ নভেম্বরের আমেদাবাদ যেন ক্রমশ ঘনিয়ে উঠছিল বার্বাডোজের ক্রিকেট-পরিমণ্ডলে। সেই সিঁদুরে মেঘ চিনতে ভুল হচ্ছিল না রোহিত, বুমরাদেরও। ফলে সেই আশঙ্কার মেঘ উড়িয়ে টি-টোয়েন্টি খেতাব নিশ্চিত হতে আবেগের বাঁধ টুঁটে যাবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। মাটিতে শুয়ে পড়ে রুদ্ধ আবেগে মাটিতে চাপড় মারতে থাকা রোহিতকে দেখে তাই মনে হচ্ছিল ‘নায়ক’ সিনেমার অরিন্দমরূপী উত্তম। ‘আই উইল গো টু দ্য টপ’-এর শপথে রাঙানো যাঁর দুনিয়াটা। অবশেষে সেই স্বপ্নমঞ্জীলে প্রবেশ করতে সমর্থ হলেন রোহিত ‘গুরুনাথ’ শর্মা। হলেন কেরিয়ারের গোধূলীলগ্নে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটজীবনের শেষ ম্যাচে।
……………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: বিরাটের আইপিএল জয়ে বুঝি অভিসম্পাত আছে
……………………………………………………………………………………..
জীবন তাঁর জন্য বরাবর কর্ণের আসন বরাদ্দ করে রেখেছিল এযাবৎ। সেই পাশার দান নিরলস পরিশ্রম ও অক্লান্ত চেষ্টার আহুতিতে জয় করলেন রোহিত। মনে করিয়ে দিলেন ভারতের হৃদয়ে থাকা ‘মন্নতবাসী’র অমোঘস্বর– ‘আগর কিসি চিজ কো সাচ্চে দিল সে চাহো, তো পুরি কায়নাৎ উসসে তুমসে মিলানে কি কোশিশ ম্যায় লাগ যাতি হ্যায়।’ কায়নাৎ অর্থাৎ প্রকৃতি, ক্রিকেটবিধাতাও কি তাই চেয়েছিলেন। তাই কি এমন রূপকথার আসন বিছিয়ে বরণ করে নিলেন টিম ইন্ডিয়াকে, টি-টোয়েন্টি দুনিয়ার নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন রূপে? হয়তো বা। সবকিছু ঠিকঠাক চললে এতক্ষণে জো’বার্গে খুশির রোশনাই জ্বলে ওঠার কথা ছিল। ম্যান্ডেলার দেশে নায়কের বেশে উৎসব-যাপনের প্রাক্ প্রস্তুতি নিতে হত এইডেন মার্করাম, হেনরিক ক্লাসেনদের। বদলে লান্স ক্লুজনার, এবি ডিভিলিয়ার্সদের ‘চোকার্স’-এর প্রেত গিলে খেল প্রোটিয়াদের। নাকি প্রবল চাপের মুখে বল হাতে বুমরা নামক ভারতীয় বোলিং ম্যাজিশিয়ানের জ্বলে ওঠাটাই ভবিতব্য ছিল ফাইনালে? নাকি ভবিতব্য ছিল বাউন্ডারি লাইনে ‘আগুনপাখি’ হয়ে ডেভিড মিলারের ক্যাচটা তালুবন্দি করা সূর্যকুমার যাদবের উদ্ভাস? হয়তো দু’টোই।
আসলে ক্রিকেটের বিধাতারপুরুষও চাননি ম্যাচটা হেরে যাক ভারত। হারলে মিথ্যে হয়ে যেত রোহিতের বাল্যকালের কষ্টযাপন। ভুল প্রমাণিত হত দ্রাবিড়ের নীরব সাধনা। কথায় বলে, অপেক্ষার ফল মিঠে হয়। শনিবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তাই বরাবরের মতো নীরব, নিঃসঙ্গ বিদায় নয়, আলবিদা-কালে মাথা উঁচু করে রাজকীয় নিষ্ক্রমণ নিয়তি নির্ধারিত ছিল রাহুল শরদ দ্রাবিড়ের।
দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার অন্তহীন গভীরতায় আজ শুধু শেষ সূর্যের সাফল্যের বর্ণচ্ছটা। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটি রিক্ত, ব্যর্থতার কালিতে দগ্ধ করেছিল ‘দ্য ওয়াল’-এর, পরিশেষে সফলতার রঙিন টানে বৃত্ত সম্পন্ন করলেন ‘মিস্টার ডিপেন্ডবল’। ভারতীয় ক্রিকেটে এমন মায়াভরা মুহূর্ত এর আগে আসেনি। ভারতীয় ক্রিকেট তার হৃদয়ে এই মুহূর্তকে পালন করবে চিরকাল। কামনা করবে দ্রাবিড়, রোহিত, বিরাটদের যোগ্য উত্তরসাধকের। যেমনভাবে আমরা জাতিস্মরের পথ চেয়ে কামনা করি– ‘…নতজানু হয়ে ছিলাম তখন এখনো যেমন আছি/ মাধুকরী হও নয়নমোহিনী স্বপ্নের কাছাকাছি!’
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..
ধৈর্যের একেবারে চূড়ান্ত সীমায় এসে কবির মনে হয়েছে, ‘ছবিগুলি বুবা লুকিয়ে রেখেছে এই সন্দেহ বরাবর আমার মনে আছে। সে আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারও বছর তিনেক বাদে কিশোরীমোহনের প্রবল পরিশ্রমে ১৯৪০-এর পুজোর মুখে সেই ছবির অ্যালবাম ‘চিত্রলিপি’ প্রকাশ পেয়েছে।