Robbar

যে বাজার তাঁকে ‘বিরাট’ করেছিল, অবসর ঘোষণায় তাকেই ব্যাকফুটে ঠেললেন কোহলি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 13, 2025 8:02 pm
  • Updated:May 14, 2025 3:58 pm  
An article about virat kohli on his test retirement। Robbar

বার্বাডোজে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় জানানোর পরে দর্শকদের উদ্দেশে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ব্রায়ান লারা। “আমি কি আপনাদের বিনোদন দিতে পেরেছি আদৌ?” উত্তরটা সহজ। সকলেই জানতেন। লারা নিজেও জানতেন। তবু, ওই প্রশ্নটার প্রয়োজন ছিল। ওই প্রশ্নটা আসলে লারার দর্শন। তিনি যেভাবে ক্রিকেটে বেঁচেছেন, তার নির্যাস। আর বিরাট কোহলি তাঁর অবসরের ভাষ্যে লেখেন, টেস্ট ক্রিকেট থেকে পাওয়া শিক্ষার কথা, খেলার অন্তরঙ্গে লুকিয়ে থাকা নানা ছোটো ছোটো মুহূর্ত, চেষ্টার কথা। এবং লেখেন, “সবসময় নিজের টেস্ট কেরিয়ারের দিকে হাসিমুখেই ফিরে তাকাব।”

অনিতেশ চক্রবর্তী

‘সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত…
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেল দিনান্তের,
শুধু এই–’

নাহ, ক্রিকেটার এবং মানুষ হিসেবে বিরাট কোহলিকে কখনওই সেভাবে ‘কাব্যিক’ মনে হয়নি আমার। তিনি চাবুকের মতো ক্ষিপ্র, ক্ষেত্রবিশেষে রুক্ষ, আগ্রাসী। অসম্ভব পেশাদার, তীক্ষ্ণ প্রতিযোগী। তিনি নতুন প্রজন্মের খেলোয়ারদের দুনিয়ায় মেগাস্টার। ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে তর্কাতীতভাবে সবচেয়ে বড় ‘ব্র্যান্ড’। বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেটার। সমাজমাধ্যমে যাঁর ফলোয়ার-সংখ্যা পেশা-নির্বিশেষে বিশ্বের তাবড় তারকাদের লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। সফল হওয়ার খিদে যাঁর মারাত্মক। যাঁর ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে গড়েপিটে নেওয়া ক্রিকেট-দর্শনেও কাব্যের ছায়া প্রায় নেই। অথচ, তাঁকে নিয়ে লেখার সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পদ্য মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। মনে হচ্ছে, অমোঘ।

“I’ll always look back at my Test career with a smile.

#269, signing off.”

টেস্ট ক্রিকেটকে চিরবিদায় জানানোর বার্তায় বিরাট কোহলি (Virat Kohli Test Retirement) লিখেছেন, লাল বলের ক্রিকেট তাঁকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। প্রত্যাশার চাইতেও বেশি। তাই, বিদায়কালে কোনও খেদ থাকল না, ‘সবসময় নিজের টেস্ট কেরিয়ারের দিকে হাসিমুখেই ফিরে তাকাব।’ কে জানে, ভুলভাবে পড়ছি কি না! কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে, এই ‘হাসিমুখে’ শব্দটা অত সহজ নয়। এত এত গৌরব, প্রাপ্তি, সাফল্যের পরে ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকাতে গেলে কোনও ব্যর্থতার গ্লানি স্মৃতির পা অহেতুক জড়িয়ে ধরবে না। এসবই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাও, ওই একটা ‘হাসি’-র উল্লেখ উজ্জ্বল অথচ বিষণ্ণ সংকেতের মতো।

BGT Recap: When Virat Kohli's inspired run was triggered by a Johnson bouncer - India Today
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শতরানের পর বিরাট কোহলি

ওই সংকেতের গলি ধরে হাঁটতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে, অ্যাসেজে ইংরেজ ব্যাটারদের ত্রাসে পরিণত হওয়া মিচেল জনসনকে বেদম ঠেঙিয়ে শতরানের পর মেলবোর্নের দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বিরাট কোহলি হাসছেন। কী দাপট সেই চওড়া হাসিতে। মনে পড়ে যাচ্ছে, এজবাস্টনে লড়াকু শতরানের পর হেলমেট খুলে তিনি হাসছেন। স্মিত, খানিক ক্লান্ত অথচ গৌরবের হাসি। ইংল্যান্ডে এর আগের সিরিজেই ক্রমাগত ব্যর্থতা তাঁর টেকনিক নিয়ে ঘোরতর সব প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। সেইসব প্রশ্নের চিরস্থায়ী জবাব দেওয়ার হাসি। মনে পড়ে যাচ্ছে, লর্ডসে শেষদিন ইংল্যান্ডকে ৬০ ওভারের আগেই অলআউট করে দেওয়ার পর ধারাভাষ্যকারের প্রশ্নের উত্তরে গর্বিত অধিনায়ক কোহলি হাসছেন। এবং মনে পড়ে যাচ্ছে, ঘরের মাঠে হঠাৎই নিচু হয়ে যাওয়া অফস্পিন মিস করে এলবিডব্লু হওয়ার পর কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় ফের পঞ্চম স্ট্যাম্পের বলে স্লিপে আউট হওয়ার পরেও তিনি নন স্ট্রাইকারের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলছেন বারবার। ব্যর্থতার একই পুনরাবৃত্তিতে ক্লান্ত ও হতাশ এক অসামান্য পারফর্মারের হাসি।

যে ফরম্যাট তাঁকে এত কিছু দিল, তারই সামনে এসে ১৪ বছর পর অসহায়ভাবে তিনি আবিষ্কার করছেন, তাঁর অন্যতম প্রিয় স্কোরিং শটই তাঁর স্থায়ী মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিরিজের মাঝপথে স্টান্স খানিক বদলে ফেলেও অফস্ট্যাম্পের বাইরে যাওয়া বলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছেন না। না পারছেন পুরনো বিরাট কোহলির মতো একের পর এক সিগনেচার কভার ড্রাইভে বা অন-দ্য-আপ ড্রাইভে এই ফাঁদকে উড়িয়ে দিতে, না পারছেন শচীনের মতো নির্মোহ হতে। সিডনিতে উপন্যাসপ্রতিম সেই দ্বিশতরানের ইনিংস খেলার সময় যিনি সযত্নে কভার ড্রাইভ নামক শটটাই নিজের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে ছেঁটে ফেলেছিলেন।

Virat Kohli Total Double Century - India 2023
দ্বিশতরানের পর। সিডনি।

অবসর ঘোষণার পোস্টে বিরাট লিখেছেন, এই ফরম্যাট তাঁর পরীক্ষা নিয়েছে, তাঁকে তৈরি করেছে, সারা জীবন বহন করার মতো শিক্ষাও দিয়েছে অনেক। টেস্ট কেরিয়ারের শেষ কয়েকটা বছর থেকে পাওয়া সেই শিক্ষাই কি তাঁকে এমন অবসরের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করল? নির্দিষ্ট করে দিল তাঁর ‘টাইমিং’!

বিরাট কোহলি (Virat Kohli), ভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া-মিডিয়ার প্রিয় ‘দ্য কিং কোহলি’ কি বুঝতে পেরেছিলেন, অফের বাইরে ওই মৃত্যুফাঁদ কেটে বেরনোর মতো টেকনিক আর তাঁর নেই! তাঁর শ্রেষ্ঠ সময় বিগত। যে সময়ে চোখ-হাত-ফুটওয়ার্কের তালমিল অনেক অঘটন রুখে দিতে পারত। যেমনটা বারবার দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার পেস-সহায়ক পিচে। রাবাডা, ফিলান্ডারদের সামলে বিরাট সেখানেও শতরান করেছেন। ঝকঝকে অর্ধশতরান করেছেন। অফস্ট্যাম্পের বাইরে এই ফাঁদ তখনও তাঁকে বিপদে ফেলছে একাধিকবার। ব্যাটের কোনায় বল লেগে গালির ওপর দিয়ে উড়ে গেছে, খোঁচা লাগতে লাগতেও লাগেনি। কিন্তু তারপরেও রান এসেছে। টলোমলো অবস্থা সামলে ব্যাটের শাসন ফিরেছে। ইংল্যান্ডেও একই ঘটনা ঘটেছে। স্লিপে সহজ ও কঠিন ক্যাচ পড়েছে, তারপর শতরান এসেছে। দাপটের সঙ্গেই এসেছে। সময় সঙ্গ দিলে এসব হয়। আর না দিলে!

কেন জানি না মনে হচ্ছে, ফেলে আসা ওইসব সুখস্মৃতির দিকে তাকিয়ে বিরাট কোহলি সত্যিই হাসছেন। টেস্ট ক্রিকেটের এই সমাধানহীন ধাঁধায় মজা পেয়ে, মুগ্ধ হয়ে এবং কাতর হয়ে। এই ফরম্যাটকে তিনিও তো কম কিছু দেননি। টি-টোয়েন্টির ভরা বাজারে সহজেই খ্যাতি আর অর্থলাভের ফাটকা পথ ছেড়ে জীবনের ১৪টা বছর তিনি এখানে ঢেলে দিয়েছেন। ক্রিকেটবিশ্বের সব প্রান্তে ঢালাও রান করেছেন। তারপরেও, ওই ফাঁদ কেটে আর তাঁর বেরনো হল না। হাজারও পরিশ্রমেও না। প্রস্তুতি যেমনই থাক, ক্রিকেট প্রকৃতপ্রস্তাবে এক বলের খেলা। সাহেবদের আদুরে লাল চেরির ফরম্যাট কি সেই শিক্ষাও বিরাটকে দিয়ে গেল না!

২.

টেস্ট ক্রিকেটে বিরাট কোহলির কোনও হঠাৎ অভ্যুত্থান নেই। বরং এক শাসনপ্রবাহ আছে। শুরু থেকেই তিনি প্রতিভাবান। কিন্তু তাঁর টেকনিক ‘প্রশ্নাতীত’ নয়। অবিশ্বাস্য নিষ্ঠায় আর পরিশ্রমে নিজেকে খুঁতের ওপরে, সীমাবদ্ধতার ওপরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। পেরেওছেন। ফিটনেসকে ধারালো থেকে ধারালোতম করেছেন। যাতে দীর্ঘ ইনিংস খেলার পথে ক্লান্তি বা জড়তা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। যাতে টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে-র ধকল সামলেও টেস্ট ক্রিকেটের ধ্রুপদী ফরম্যাটে মানিয়ে নিতে অসুবিধে না হয়। তাঁর ক্রিকেটজীবন প্রতিভার অপ্রত্যাশিত বিচ্ছুরণের থেকেও বেশি করে নির্দিষ্ট নিয়ম, অভ্যেস, অনুশীলন আর পরিকল্পনায় বাঁধা। তাই সমকালীন বা সামান্য আগে-পরের অনেক ব্যাটারের চেয়ে তুলনায় কম দৃষ্টিনন্দন বা সাবলীল হয়েও গত দশকের একটা বড় পর্যায় জুড়ে তিনি টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটার।

একদিনের ক্রিকেটে তিনি শুরু থেকেই ‘বিরাট’। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটার। পরিসংখ্যান আর সাফল্য বিচার করলে হয়তো বা সেরাই। কিন্তু, টেস্ট ক্রিকেটে সেরাদের তালিকায় তাঁর অন্তর্ভুক্তি একদিনে হয়নি। সেখানে কোনও ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’-এর চিত্রনাট্য ছিল না। অনেক পরিশ্রমে সেই তালিকায় জায়গা আদায় করে নিতে হয়েছে তাঁকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ডেবিউ সিরিজ মনে রাখার মতো নয় একদমই। মনে আছে, ধারাভাষ্যকারদের কেই একজন বলেছিলেন, ‘বিরাটকে বুঝতে হবে ওয়ানডে আর টেস্ট ক্রিকেট এক নয়। খেলার মান বাড়াতে হবে।’ এরপর, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিজের প্রথম সিরিজে টানা ব্যর্থ হতে হতে প্রায় বাদই পড়ে যাচ্ছিলেন। সম্ভবত ধোনি আর শেওয়াগের যৌথ সিদ্ধান্তে অ্যাডিলেডের শেষ টেস্টে দলে থেকে যান। দলের ভরাডুবি হলেও প্রথম শতরান ‘উদ্ধত’ বিরাটকে যে অক্সিজেনের জোগান দিয়েছিল, তা অমূল্য।

এরপর বিরাট বিশ্বের সর্বত্র রান করে গেছেন ঈর্ষণীয় ধারাবাহিকতায়। উপমহাদেশের স্পিন সহায়ক পিচে দেদার রান করেছেন। পাকিস্তানের ব্যাটিং সহায়ক পিচে টেস্ট খেলার সুযোগ পেলে আরও বেশি রান করতেন নিশ্চিত। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বা দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েও রান করেছেন। ইংল্যান্ডে প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে, পরের সিরিজে পুষিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে টেস্টেরও সেরা বিজ্ঞাপনে পরিণত করেছে ২০১৪-’১৫ সালের অস্ট্রেলিয়া সফর। চারটি শতরান, অ্যাডিলেডে চতুর্থ ইনিংসে প্রায় রূপকথার মতো ইনিংস। এই সফরই তাঁকে রাজা বানিয়েছিল। ব্যাটে সাফল্যর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল সিরিজের শুরুতে অস্থায়ী আর শেষপাতে পাওয়া স্থায়ী অধিনায়কত্ব। ভারত সেই সিরিজ হারলেও একটা বাঁক-বদল আঁচ করা যাচ্ছিল স্পষ্ট। আগামী পাঁচ বছরে এই দলটাই বিশ্বের সেরা টেস্ট দল হয়ে উঠবে আর যাঁর অন্যতম কৃতিত্ব অবশ্যই অধিনায়ক আর ব্যাটার বিরাট কোহলির।

এই এত সাফল্যগাথার মধ্যেও মনে হয়, বিরাট যে আধুনিক প্রজন্মের ‘গ্রেট’ হয়ে উঠলেন, তা শুধুই ব্যাট হাতে সাফল্যের জন্য নয়। ওই বর্ডার-গাভাসকার ট্রফিতে স্টিভ স্মিথও চারটে শতরান করেছিলেন। অধিনায়কত্বও করেছিলেন প্রথম টেস্টের পর থেকে বাকি ম্যাচগুলোয়। কিন্তু বাজার নির্বাচন করেছিল বিরাট কোহলিকেই। তার একটা কারণ অবশ্যই সাদা বলের ক্রিকেটে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে অনেকটা এগিয়েছিলেন এবং টেস্ট ক্রিকেটেও একটা পর্যায় অবধি তাঁর সাফল্য ধরাছোঁয়ার প্রায় বাইরে ছিল। কিন্তু সেটা একমাত্র কারণ নয় হয়তো। বিরাট কোহলিকে মিডিয়া এবং ক্রিকেটবিজ্ঞরা যে প্রায় অতিমানব বানিয়ে তুলবেন এরপর, তাঁর মূলে আছে একটা আগ্রাসনের ‘বাজার’। নরম করে বললে ‘সম্ভাবনা’। ভারত নামক এক অতিকায় ক্রিকেট-বাজারকে সাফল্যমুখর করে আরও সুতীব্র লাভজনক, পুঁজিসম্ভব করে তোলার সম্ভাবনা। সচিন-দ্রাবিড়-কুম্বলে-সৌরভ-লক্ষণের প্রজন্মও যে সাফল্য এনে দিতে পারেনি দেশকে, ধোনি-যুবরাজ-শেহবাগরাও আসলে পারেননি, সেটা বিরাট কোহলির নেতৃত্বে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল পেরেছিল। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে টেস্ট সিরিজ জেতা, ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংল্যান্ডকে নাকানিচোবানি খাওয়ানো। এই সাফল্যকে আরও বড় করে তুলেছিল নেতা কোহলির আগ্রাসী অস্তিত্ব। আপনার পছন্দ না-ই হতে পারে, উদ্ধতও লাগতে পারে। কিন্তু কোহলি মাঠে আগ্রাসীই থাকবেন। প্রয়োজনে স্লেজ করবেন, আম্পায়ার বা ব্যাটারের দিকে তেড়েও যাবেন, গালাগালিও দেবেন। অমিত ক্ষমতাধর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এবং তারও নেপথ্যে থাকা একটা অতি দক্ষিণাভিমুখী রাষ্ট্রক্ষমতার দাপটকে যেন মাঠে সার্থকভাবে বহন করছেন কোহলি। সরাসরি রাজনীতির বয়ানে নিজেকে না ডুবিয়েই। এবং, একইসঙ্গে ব্যাটে রানও করছেন। অজস্র ব্র্যান্ড এনডোর্স করছেন। অতএব, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব আর ঠেকায় কে!

Virat Kohli two-times more aggressive than me: Sourav Ganguly | Virat Kohli two-times more aggressive than me: Sourav Ganguly

২০২০ সাল থেকে যখন ব্যাটে রানের খরা শুরু হল, তারপরেও যে বিরাট কোহলির ‘গ্রেটনেস’ দীর্ঘকাল প্রশ্নের মুখে পড়েনি, তার অন্যতম কারণ হয়তো এই বিপুলায়তন বাজার। যা অবশ্যই নিছক হাওয়া-বাতাসে তৈরি হয়নি। বিরাট কোহলিকে ওই বাজারের সেরা পণ্য হয়ে উঠতে হয়েছে। শচীন নামক ক্রিকেট-ঈশ্বরের পরে ভারতের তথা বিশ্বের পরবর্তী বরপুত্র হয়ে উঠতে হয়েছে। কোহলি সেই নির্বাচনের পরীক্ষায় পাশ করেছেন বলেই তিনি ‘কিং কোহলি’ হয়েছেন। সেই পথে তাঁর নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না। কিন্তু, এ-ও সত্যি, বাজারও তাঁকে চেয়েছিল। যতই লাল বলের ক্রিকেটে প্রায় শুরু থেকেই স্টিভ স্মিথ, পরে জো রুট এবং উইলিয়ামসনেরা প্রবল সাফল্য নিয়ে হাজির হন না কেন, রাজা তো বিরাটই হতেন। কারণ, তাঁর ডানার তলায় ১০০ কোটির বেশি ক্রিকেট-পাগল মানুষ। যে সমর্থন তাঁর সমকালীন প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছিল না। আজও নেই। বিরাট গত দশকের একটা বড় পর্যায় জুড়ে এই সুযোগের সদব্যবহার করেছেন চুটিয়ে। তাঁর ব্র্যান্ডভ্যালু অতিমানবিক হয়ে উঠেছে। মিডিয়ার একাংশ টানা দাবি করে গেছে, তিনি সর্বকালের সেরা। বা নিদেনপক্ষে শচীনের সমগোত্রীয়। একপ্রকার নিশ্চিত হয়েই গেছে, বিরাট শচীনের শতরান আর মোট রানের রেকর্ড ভেঙে দেবেন। পরে যখন ব্যর্থতা তাঁকে গ্রাস করছে, তখনও ওই অবিশ্বাস্য প্রচার-ভিত তাঁর ব্র্যান্ড ভ্যালুকে টিকিয়ে রেখেছে। সকলে অপেক্ষা করেছে, এ সাময়িক স্খলন। রাজা ফের ফিরবেন, রাজার মতোই ফিরবেন।

………………………………….

সচিন-দ্রাবিড়-কুম্বলে-সৌরভ-লক্ষণের প্রজন্মও যে সাফল্য এনে দিতে পারেনি দেশকে, ধোনি-যুবরাজ-শেহবাগরাও আসলে পারেননি, সেটা বিরাট কোহলির নেতৃত্বে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল পেরেছিল। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে টেস্ট সিরিজ জেতা, ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংল্যান্ডকে নাকানিচোবানি খাওয়ানো। এই সাফল্যকে আরও বড় করে তুলেছিল নেতা কোহলির আগ্রাসী অস্তিত্ব।

………………………………….

রাজা ফিরেওছেন। মাঝেমধ্যে। চকিতে। বিশেষ করে, একদিনের ক্রিকেটে। একের পর এক শতরান এসেছে। শচীনের শতরানের রেকর্ডও ভেঙেছে। কিন্তু টেস্টে কোহলি আর বিরাটকায় হতে পারলেন কই? ২০২৩ সালে তা-ও ধারাবাহিকতা খানিক ফিরেছিল, কিন্তু পরের বছরে ফের ব্যর্থতা। পেসের বিরুদ্ধে পুরনো রোগ আর সারল না। তার মধ্যে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ের ধারা বজায় রাখার জন্য দেশের মাটিতে ঘূর্ণি বানানোর নীতিও ব্যাটার কোহলির ক্ষতি বাড়িয়ে তুলল। একা কোহলিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই অবশ্য, পূজারা, রাহানে, কে এল রাহুল– প্রত্যেকেই ওই ঘূর্ণিতে কম-বেশি কাহিল হয়েছেন। সকলেরই ব্যাটিং গড় কমেছে। ব্যতিক্রম ওপেনার রোহিত শর্মা। কিন্তু তাতে তো বাকি দুর্বলতাগুলো ঢেকে যায় না। সর্বকালের অন্যতম সেরার এত স্থায়ী প্রকৃতির দুর্বলতা থাকলে চলে! এটা তো ক্রিকেটের পোস্টার বয়ের জন্য ভালো বিজ্ঞাপন নয়।

বিরাট কোহলির বারবার প্রত্যাবর্তনের একটা পালটা বিজ্ঞাপন তাই হয়তো বারবার উজিয়ে উঠত সাম্প্রতিককালে। ‘কিং কোহলি ইজ ব্যাক’। লাল বলের ব্যর্থতা যেন সাদা বলের সাফল্যে মুছে যায়। সে যা হোক, কিন্তু এই বারবার ফিরে আসার উল্টোপিঠে যে বারবার পতনের গল্পটাও নিহিত থাকে! পতন থুড়ি ব্যর্থতা দীর্ঘ বলেই তো প্রত্যাবর্তনের বিজ্ঞাপনগুলোও দীর্ঘায়িত হয়। সেই ধিকিধিকি আগুন যে সহজে ধামাচাপা দেওয়া যায় না। শত প্রচার, বাজারের আনুকূল্য, অনুরাগীসংখ্যা দিয়েও যায় না। কোহলি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন নিশ্চিত। তিনি ক্রিকেটের সঙ্গে প্রতারণা করেননি কখনও। অতএব, টেস্ট ক্রিকেটের একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে এই সত্য টের পেয়ে কী করা উচিত, তা তাঁর চেয়ে ভালো আর কে-ই বা জানত!

৩.

বিগত চার-পাঁচ বছরের ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরেও টেস্টে বিরাট কোহলির ব্যাটিং গড় প্রায় ৪৭। শতরান ৩০টা। মোট রান প্রায় সাড়ে নয় হাজার। তাঁর পারফরম্যান্সের অন্যান্য মাপকাঠি সরিয়ে রাখলেও বলা যায়, তিনি ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পাঁচজন টেস্ট ব্যাটারের একজন। দুনিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হওয়ার তালিকাটা অবশ্য পিছলে গিয়েছে আগেই।

এই আগ্রাসী পুঁজির দুনিয়ায় শূন্যতা আর স্মৃতির গল্প এমনিতে বেশিদিন টেকে না। বাজারই টিকতে দেয় না। তারা বিকল্প তুলে আনে দ্রুত। বিকল্প যোগ্য না হলেও তাকে যোগ্য বানিয়ে তোলা হয় নানাভাবে। যা কোনও একভাবে কোহলির ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। অতএব, কোহলির জায়গাও কেউ না কেউ ঠিক নেবেন। আজ না হোক, কাল। কিন্তু হ্যাঁ, বাজারের হাতে এই মুহূর্তে কোনও রেডিমেড পণ্য নেই। শচীনের পরে কোহলি কিন্তু তৈরি ছিলেন। কোহলির পরে শুভমান বা জয়সওয়াল এখনও নির্মীয়মাণ পণ্য। বাজার তাঁদের বেলুনে যতই হাওয়া ভরুক, তাঁদেরও উড়তে জানতে হবে। রান করতে হবে। যে পরীক্ষায় অত্যন্ত সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে কোহলি বিরাট হয়ে উঠেছিলেন, সেই পরীক্ষায় বসতে হবে শুভমন-সহ বাকিদেরও। পাশ মার্কটুকু অন্তত পেতে হবে। বাজারের দ্রুত বিকল্প নিয়ে আসার নিজস্ব দায় আছে। এবং সেই দায় নিষ্ঠুরও। যাঁদের পিছনে লগ্নি করা হল, তাঁরা যদি অকৃতকার্য হয়, সেক্ষেত্রে তাঁদের পতনও বিকট হতে পারে। আগামী কয়েকটা মাস টেস্ট ক্রিকেট-কেন্দ্রিক বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি তাই বেশ রোমাঞ্চকর হতে চলেছে। কত ঘুঁটি যে ওলটাবে, কেউই জানে না।

Selectors thought of Virat Kohli as captain for ENG series...': BCCI trying to convince batter amid retirement reports | Crickit
বিরাট কোহলি ও শুভমান গিল

আবার এ-ও হতে পারে, যোগ্য মুখ খুঁজে না পেয়ে টেস্ট ক্রিকেট ঘিরে বাণিজ্যটাই খানিক চরিত্রবদল করল। পুরনো কায়দায় রাজা-যুবরাজ-রাজপুত্তুরের প্রতিষ্ঠা নয়, খানিক ভিন্ন ধাঁচের প্রচার। খানিক অপেক্ষালীন থাকা। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের মতো এমন দীর্ঘ, ধীর, সাবেকি, তুলনায় কম মুনাফা দেওয়া ফরম্যাট নিয়ে কি সত্যিই অত ধৈর্য দেখাবেন পুঁজিপতি-বহুজাতিকরা?

এইসব ভাবলে মনে হয়, বিরাট কোহলি বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মনে হয়, তাঁর ‘গ্রেটনেস’-কে এই নিক্তিতেও মাপা উচিত। না, তিনি টেকনিক বা ব্যাটিং-সৌন্দর্যে পৃথিবীর সর্বকালের সেরাদের দলে পড়েন না। তিনি আদর্শ মানুষও নন সম্ভবত। নানা দোষ-ত্রুটি তাঁর ছিল। নেহাতই স্বার্থে ঘা না লাগলে ক্রিকেট-কেন্দ্রিক ক্ষমতা-আধিপত্যের বৃত্তে তিনি বিদ্রোহী নন কোনও কালেই। এহেন কোহলিই কিন্তু এমন পুঁজিসর্বস্ব, মুনাফাময় সময়ে দাঁড়িয়ে টেস্ট ক্রিকেটকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে গিয়েছেন এতগুলো বছর। এতে অবশ্যই তাঁর নিজেরও লাভ হয়েছে। কিন্তু ক্রিকেটের আদিতম ফরম্যাটটির লাভও কম হয়নি। কোহলির প্রস্থান টেস্ট ক্রিকেটকে জৌলুসহীন করল অনেকটাই। দর্শকসংখ্যাও এবারে অবধারিত কমবে। শচীনের প্রস্থানেও যে ভাটা পড়েনি, কারণ কোহলি ছিলেন, সেই ভাটা এবারে আসবে। তাই, শুধুমাত্র ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেট টিমের টপ অর্ডারের নয়, বিরাট কোহলির না থাকা ঘিরে সমস্যাটা এখন সামগ্রিকভাবে টেস্ট ক্রিকেটেরও। বলা ভালো, ক্রিকেট-বাণিজ্যেরও।

এই বিন্দুতে এসে মনে হচ্ছে, কোহলি কোনও একভাবে তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া বাজারটাকেই জোরে ধাক্কা দিয়ে গেলেন। তিনি চাইলে ওই বাজারে ঠেস দিয়ে আরও অন্তত পাঁচটা টেস্ট খেলে দিতেই পারতেন। বা অন্তত একটা বিদায়ী টেস্ট। তিনি তা চাইলেন না। বিদায়ী টেস্টের বাণিজ্য-আখ্যান তৈরির সম্ভাবনাও মাঠে মারা গেল। তাঁর অবসরের খবর আইপিএলের ওপর থেকেও খানিক প্রচারের হাওয়া কেড়ে নিল নাকি! যুদ্ধ ঘিরে টিআরপিতেও বেশ খানিক থাবা বসাল হয়তো। সবটাই বেশ অদ্ভুত। যে বাজার তাঁকে অনেকাংশে অতিকায় করেছিল, কোহলি শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটের বাধ্য ছাত্র হয়ে সেই বাজারকেই বেশ খানিক বিপাকে ফেললেন যেন বা। ভেবেচিন্তে করলেন কি? কে জানে!

গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পরে এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম টেস্টে শতরান করার পরে ধারাভাষ্যকারদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে কোহলি একাধিকবার বলেছিলেন, তিনি এতদিন পরে নতুন করে শিখেছেন ক্রিকেটকে নতজানু হয়ে সম্মান করতে হয়। এত এত রান করে একটা মানুষ ক্রিকেট কেরিয়ারের শেষপ্রান্তে এই শেখার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন! অস্ট্রেলিয়ায় শতরান করে উঠে এই কোহলিই বলেছিলেন, ‘জায়গা আটকে থাকার মানুষ আমি নই।’

জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কারণগুলো আরও জটিল হতেই পারে। হয়তো জটিলই। অস্ট্রেলিয়ার ব্যর্থতাই যদি নির্ণায়কভাবে অবসরের কারণ হবে, তাহলে কোহলি দিল্লির হয়ে রঞ্জি খেললেন কেন? রঞ্জি না খেললে কি তাঁর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা হত না! তেমনটা মনে তো হয় না। অতএব আন্দাজ করে নেওয়াই যায়, এই সিদ্ধান্ত হয়তো এত সহজ যুক্তির পথ ধরে আসেনি। সে যাই হোক, তার পরেও ক্রিকেটীয় কারণটা উধাও হয়ে যায় না। কোহলি যেভাবে সরলেন, ইনস্টাগ্রামে একটা মাত্র পোস্ট করে, তার চাইতে বেশি ঢক্কানিনাদ যে-কোনও মুহূর্তেই তিনি করতেই পারতেন চাইলে। করেননি, সেটাও কিছু একটা দেখায়।

Reactions: Cricket World in disbelief as Virat Kohli says Goodbye to Test Cricket — KSportsWatch
টেস্ট ক্রিকেটে এই দৃশ্য এখন অতীত

বার্বাডোজে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় জানানোর পরে দর্শকদের উদ্দেশে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ব্রায়ান লারা। “আমি কি আপনাদের বিনোদন দিতে পেরেছি আদৌ?” উত্তরটা সহজ। সকলেই জানতেন। লারা নিজেও জানতেন। তবু, ওই প্রশ্নটার প্রয়োজন ছিল। ওই প্রশ্নটা আসলে লারার দর্শন। তিনি যেভাবে ক্রিকেটে বেঁচেছেন, তার নির্যাস। আর বিরাট কোহলি তাঁর অবসরের ভাষ্যে লেখেন, টেস্ট ক্রিকেট থেকে পাওয়া শিক্ষার কথা, খেলার অন্তরঙ্গে লুকিয়ে থাকা নানা ছোটো ছোটো মুহূর্ত, চেষ্টার কথা। এবং লেখেন, “সবসময় নিজের টেস্ট কেরিয়ারের দিকে হাসিমুখেই ফিরে তাকাব।”

পড়তে পড়তে মনে হয়, এই কথাগুলোও আসলে বিরাট কোহলির অন্তর্লীন দর্শন। ভিতরের কথা। একজন ক্রিকেটকে গভীর ভালোবেসে জীবনের অনেকাংশ বিনিয়োগ করা খেলোয়াড়ের নিজস্ব আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলা কথা। দিনাতিদিনের ক্লেদ, রাজনীতি, ক্ষমতার দৌড়, ঈর্ষা, প্রতারণা, অঙ্কের বাইরে এসে লেখা কতগুলো শব্দ। একজন বিপুল ধনী, নানা কারণে ক্ষমতাবান, আগ্রাসী, সফল, বিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় ক্রিকেটার, বিশ্বের ক্রিকেটকে দাপিয়ে বেড়ানো ধনীতম ক্রিকেট বোর্ডের পোস্টার বয়ের লুকনো এক সত্যের ভাষ্য। সকল প্রতাপ প্রায় অবসিত হওয়ার পরে যেটুকু পড়ে থাকে, সেই সত্যিটা। খানিক আশ্চর্য বই কি! হয়তো সত্যি বলেই আশ্চর্য।

“শুধু এই– ঘৃণা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।”

নাহ্, এই একটা নেহাতই আশ্চর্য দুর্ঘটনা বাদ দিলে ক্রিকেটার এবং মানুষ হিসেবে বিরাট কোহলিকে কখনওই সেভাবে কাব্যিক মনে হয়নি আমার। আজও হয় না।

………………………………….

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল

………………………………….