কমল গুহকে বয়স জিজ্ঞাসা করায় সাংবাদিককে প্রত্যাহ্বান ছুড়ে দিয়েছিলেন কমল– ফুটবল মাঠ দশ পাক দৌড়ানোর প্রত্যাহ্বান। বলেছিলেন, ‘সন, তারিখ দিয়ে কি বয়স ঠিক করা যায়? শরীরের ক্ষমতাই হচ্ছে বয়স, বুঝলেন? এখন আমার বয়স হচ্ছে…’। পেপে, রোনাল্ডো, মডরিচ, টনি ক্রুজ, মেসিদের ক্ষেত্রে ‘বয়স’ অনুমান করার ভার না-হয় পাঠকের ওপরেই থাক!
‘ব্যালান্স, কমল, ব্যালান্স কখনও হারাস নি’– মতি নন্দীর উপন্যাস ‘স্টপার’-এর নায়ক কমল গুহকে বলেছিলেন তাঁর প্রশিক্ষক পল্টুদা। প্রখর আত্মবিশ্বাস, ফুটবল দক্ষতা এবং আত্মসম্মানের অধিকারী কমল গুহকে নিশ্চয়ই মনে আছে? অনুপম, প্রসূন ভট্চাজদের মতো তরুণ তুখোড় স্ট্রাইকারদের আক্রমণ নির্বিষ করে দিতেন কমল। ৪২ পেরনো কমল গুহ দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছিলেন বিপক্ষের ফুটবলারদের সামনে।
কমল গুহ সাহিত্যের চরিত্র। কলকাতার ফুটবল ময়দানে কোনও অভিজ্ঞ ফুটবলারের প্রতিরূপ হিসেবে তাঁকে হাজির করেছিলেন মতি নন্দী। তবে, ৪১ বছর বয়সে একজন ফুটবলার দেশের জার্সিতে রক্ষণ সামলে যাচ্ছেন, তাও আবার ইউরোর মতো অতি উচ্চমানের প্রতিযোগিতায়, এ এক বিরল ঘটনা। মাঠে তাঁর দাপট, প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগকে ভোঁতা করে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেতৃত্বদান এবং পাস দেওয়ার দক্ষতা কমল গুহকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। তাঁর নাম কেপলার ল্যাভেরান দে লিমা ফেরেইরা– সারা বিশ্বের ফুটবলমহল যাঁকে একডাকে ‘পেপে’ বলে চেনে। পর্তুগালের রক্ষণভাগের স্তম্ভ। জার্সি নম্বর ৩।
২০১৬ সালে হাঙ্গেরির গোলরক্ষক গ্যাবর কির্যালি ৪০ বছর বয়সে হাঙ্গেরির দুর্গ সামলেছিলেন। ২০০০ সালের ইউরোয় লোথার ম্যাথিউজ প্রায় ৪০ বছর বয়সে জার্মানির জার্সিতে মাঠে নেমেছিলেন। বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের রজার মিল্লা ৪২ বছর বয়সে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন। বিশ্বকাপে ৫টি গোলও রয়েছে তাঁর। ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটনও প্রায় ৪৩ বছর বয়েসে জাতীয় দলের জার্সিতে বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। সতেরটি খেলার মধ্যে ১০টিতে অপরাজেয় ছিলেন। কিন্তু, এঁদের থেকেও পেপের কৃতিত্ব একটু হলেও বেশি। কারণ, পেপে দু’টি খেলাতেই প্রায় পুরো সময় মাঠে ছিলেন। চেক দলের বিরুদ্ধে পুরো ৯০ মিনিট এবং তুর্কির বিরুদ্ধে ৮৩ মিনিট। আর, রজার মিল্লা, লোথার ম্যাথিউজদের সময়ের খেলা থেকে এখনকার ফুটবল অনেকটাই বদলে গেছে। ফুটবল দলের নীতি-কৌশল এবং ফুটবলারদের খেলার ধরনেও স্বাভাবিক বদল এসেছে। পেপে এই বদলের সঙ্গে যথোপযুক্ত ভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। ক্লাব-ফুটবলে তাঁর সাম্প্রতিক দল এফসি পোর্তোতে পেপের দক্ষতা এখনও বিকল্পহীন। স্টপার কমল গুহর বিশ্বাস ছিল শিক্ষায় এবং অনুশীলনে ফাঁকি না থাকলে পরিশ্রম করে অর্জন করার স্কিল বয়স বাড়লেও মানুষ হারায় না। পর্তুগালের হয়ে প্রথম দু’টি খেলায় তাঁর নির্ভুল পাস ৯৬%। মাঠে দৌড়েছেন মোট ১৯.৮ কিলোমিটার। আটাকিং থার্ডে ১০টি পাস বাড়িয়েছেন। ইউরোয় পর্তুগালের রক্ষণভাগে পেপের পাশে খেলছেন রুবেন ডায়াস এবং নুনো মেন্দেজ। একজনের বয়স ২৭ এবং অপরজনের ২২। ড্যালো, ভিতিনহা, ব্রুনো ফার্নান্দেজ এবং হোয়াও ক্যান্সেলোর গড় বয়স ২৭ বছর। এই ‘কমবয়সি’দের পাশে পেপে বেমানান তো নয়ই বরং ভিতিনহা, ব্রুনোরা আক্রমণে যাচ্ছেন, নুনো মেন্দেজ বাঁদিকে ওভারল্যাপিং-এ উঠছেন অভিজ্ঞ পেপে রক্ষণে নিশ্চিন্তি দিচ্ছেন বলেই। মনে রাখা জরুরি, ২০১৬ সালে পর্তুগাল ইউরো জিতেছিল ফ্রান্সকে হারিয়ে এবং ফাইনালের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন পেপে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিগত দু’টি বিশ্বকাপ এবং ইউরো বা কোপা আমেরিকার আগে বহুবার আলোচনা হয়েছে– এটাই কি মেসির শেষ বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকা? কিংবা পর্তুগালের জার্সিতে এটাই রোনাল্ডোর শেষ বিশ্বকাপ বা ইউরো কাপ– এহেন আলোচনা ফুটবল অনুরাগীদের মুখে মুখে ঘুরেছে। তারপর প্রতিযোগিতায় এঁদের সক্ষমতা দেখে ফের পরের প্রতিযোগিতার জন্য আলোচনা মুলতুবি রেখেছেন সমালোচকরা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ফুটবলারদের বয়স এবং শারীরিক সক্ষমতা তাঁদের অর্জিত-অনুশীলিত দক্ষতায় কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে বিতর্ক চিরকাল চলেছে। সাম্প্রতিক ফুটবলে মেসি, রোনাল্ডোর মতো অপ্রতিস্থাপনযোগ্য সেরার সেরা ফুটবলারদের নিয়েও সমালোচক, সাংবাদিক ও অনুরাগীদের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিগত দু’টি বিশ্বকাপ এবং ইউরো বা কোপা আমেরিকার আগে বহুবার আলোচনা হয়েছে– এটাই কি মেসির শেষ বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকা? কিংবা পর্তুগালের জার্সিতে এটাই রোনাল্ডোর শেষ বিশ্বকাপ বা ইউরো কাপ– এহেন আলোচনা ফুটবল অনুরাগীদের মুখে মুখে ঘুরেছে। তারপর প্রতিযোগিতায় এঁদের সক্ষমতা দেখে ফের পরের প্রতিযোগিতার জন্য আলোচনা মুলতুবি রেখেছেন সমালোচকরা।
সাম্প্রতিক ইউরোতে ক্রোয়েশিয়ার লুকা মডরিচ এবং জার্মানির টনি ক্রুজকে নিয়ে তেমনই বিদায়সঙ্গীত শোনা যাচ্ছে। দু’জনেই অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই ইউরোই তাঁদের দেশের জার্সিতে খেলা শেষ প্রতিযোগিতা। মডরিচ অবশ্য শেষ দু’টি বিশ্বকাপে যে দক্ষতায় খেলেছিলেন, এখন সেই দক্ষতার ধারেকাছেও নেই। মাঝমাঠ শাসন করা মডরিচ, যিনি রিয়াল মাদ্রিদ এবং ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দলের হয়ে যে কোনও মুহূর্তে খেলার রং বদলে দিতে পারতেন, তিনি নিষ্প্রভ। ক্রোয়েশিয়া হয়তো এই ইউরোয় পরের রাউন্ডে যাবে না। ৩৯ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মডরিচের যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত ক্রোয়েশিয়াকে অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী ইউরো বা বিশ্বকাপে ভালো ফল করার জন্য।
তবে, ৩৪ বছরের টনি ক্রুজ বোধহয় তাঁর জীবনের শেষ ইউরোয় রংমশাল জ্বালাতেই নেমেছেন। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে যেমন রং ছড়িয়েছিলেন কয়েকদিন আগে পর্যন্ত। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার আগে ঘাড়ের ব্যথার জন্য অনিশ্চিত ছিলেন, কিন্তু দলের প্রতি দায়বদ্ধতায় খেলতে নেমে নিজের সেরা খেলা উজাড় করে দিয়েছেন। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে খেলাতেও ৪-২-৩-১ ছকে বাঁদিকে নেমে এসে খেললেন ক্রুজ। তাতে রক্ষণ যেমন ভরসা পেল, তেমনই প্রয়োজন মতো ওপরে উঠে উইর্ৎজকে ঠিকানা-লেখা পাস বাড়ানো গেল। ডানদিক থেকে অ্যানড্রিচ বিপক্ষের ফুটবলারদের জালে আটকে গেলেই ত্রাতা হয়ে উঠেছেন ক্রুজ। বস্তুত, মাঝমাঠের বিস্তীর্ণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে পরিচালনা করেছেন ক্রুজ। জার্মানি দলের নবনিযুক্ত প্রশিক্ষক নাগেলসম্যান ক্রুজকে দীর্ঘদিন পরে জাতীয় দলে ফিরিয়ে এনেছেন এবং তাঁর বিশ্বাসের মর্যাদা দিচ্ছেন ক্রুজ। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১০১টি সঠিক পাস বাড়িয়েছিলেন ক্রুজ– ৯৯% সঠিক পাস যে কোনও ফুটবলারের কাছে স্বপ্নের মতো ব্যাপার। দু’টি খেলায় মোট ১৯.৯ কিলোমিটার দৌড়েছেন ক্রুজ। ৯৭% নিখুঁত পাস দিয়েছেন। আর, বিপক্ষের ফুটবলারের থেকে বল ছিনিয়ে নিয়েছেন ন’বার। মুসিয়ালা, উইর্ৎজ– জার্মান ফুটবল দলের আক্রমণভাগের নতুন প্রজন্ম তৈরি এবং খেলা চলাকালীন প্রকৃত অগ্রজের মতো তাঁদের তত্ত্বাবধান করছেন ক্রুজ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন প্রবুদ্ধ ঘোষ-এর লেখা: কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হত না যে মার্শাল দাবা ক্লাবে, সেখানেই চ্যাম্পিয়ন হলেন মরিস
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
উপর্যুক্ত অংশে বেশ কিছু পরিসংখ্যান দিলাম, নেহাত প্রমাণ রাখতে হয় বলেই। নইলে শুকনো পরিসংখ্যান দিয়ে এঁদের দক্ষতা ও কার্যকারিতা কে-ই বা মাপতে পারে? এঁদের খেলতে দেখলে ফুটবল অনুরাগীরা এখনও আমোদিত হন। বিপক্ষ দলের প্রশিক্ষকরা এঁদের দমানোর জন্য আলাদা কৌশল কষে রাখেন। পেপে, ক্রুজ, মডরিচ, কেভিন দে ব্রুইনের মতো দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলা অনেককেই হয়তো পরের ইউরো বা বিশ্বকাপে দেখা যাবে না। হয়তো। কিন্তু ফুটবল জগৎ এঁদের মনে রাখবে। বয়সকে তুড়ি মেরে, জার্সিকে ভালোবেসে এঁরা কী কাণ্ডটাই না করছেন!
কমল গুহকে বয়স জিজ্ঞাসা করায় সাংবাদিককে প্রত্যাহ্বান ছুড়ে দিয়েছিলেন কমল– ফুটবল মাঠ দশ পাক দৌড়ানোর প্রত্যাহ্বান। বলেছিলেন, ‘সন, তারিখ দিয়ে কি বয়স ঠিক করা যায়? শরীরের ক্ষমতাই হচ্ছে বয়স, বুঝলেন? এখন আমার বয়স হচ্ছে…’। পেপে, রোনাল্ডো, মডরিচ, টনি ক্রুজ, মেসিদের ক্ষেত্রে ‘বয়স’ অনুমান করার ভার না-হয় পাঠকের ওপরেই থাক!
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved