Robbar

কে কত ইংরেজি বলতে পারে, ক্রিকেটের তাতে কী যায় আসে?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 22, 2024 5:07 pm
  • Updated:December 22, 2024 5:07 pm  

রবীন্দ্র জাডেজাও মাতৃভাষার পরে যে ভাষাটি শিখেছেন, তা ক্রিকেটীয় ভাষা। সেই শিক্ষায় কোনও খাদ নেই। তৃতীয় টেস্টে, ব্রিসবেনে, অবলীলায় ব্যাট ঘুরিয়ে অর্ধশতরান উদযাপন করতে পারেন তাই। উদযাপন করতে পারেন পরাজয়ের হাঁ-মুখ থেকে টিম ইন্ডিয়ার ফিরে আসার রাস্তাটি। ক্রিকেট তাই যোগ্যতার খেলা। পারদর্শিতা। কনসেন্ট্রেশন। দক্ষতা। ফিজিক্যাল ফিটনেস। ধ্যানমগ্নতা। একে অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। কে কত উচ্চমার্গীয় ইংরেজি বলতে পারে, ক্রিকেটের কী-ই বা আসে যায়?

রোদ্দুর মিত্র

দার্শনিক মিশেল ফুকো একটি বিতর্কসভায় উপস্থিত। বিতর্কসভাটি ঐতিহাসিক। যেহেতু বিপরীতে, ভাষাতাত্ত্বিক এবং পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট নোয়াম চমস্কি। বিতর্কের বিষয়– মানবপ্রকৃতি। মানবসত্তা। মানবঅভিজ্ঞতা। ‘হিস্ট্রি অফ ম্যাডনেস’ প্রসঙ্গে যখন ফুকোর উদ্দেশে প্রশ্ন করা হয়, তিনি প্রথমেই বললেন: ‘আপনাদের যদি অসুবিধে না থাকে, তবে আমি এই বিতর্কসভার সকল প্রশ্নের উত্তর ফরাসিতে দিতে চাই। আমার ইংরেজি ভাষাজ্ঞান এতটাই দুর্বল যে…’

নোয়াম চমস্কি আমেরিকান। মাতৃভাষা ইংরেজি। তবু মিশেল ফুকো ফরাসিতেই জমাটি তর্ক জুড়েছিলেন। কোনও সাংবাদিক গাঁকগাঁক করে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেনি, ‘আপনি মশাই এত বড় পণ্ডিত, তবু ইংরেজি জানেন না?’ ভাষা একটি মাধ্যমমাত্র। মহার্ঘ বস্তুটি হল মেধা। জ্ঞান। প্রজ্ঞা।

Philomathean Society
বিতর্কসভায় মিশেল ফুকো-নোয়াম চমস্কি

অস্ট্রেলীয় মিডিয়া হাউমাউ করে উঠেছে। সম্প্রতি। বর্ডার-গাভাসকার ট্রফির চতুর্থ টেস্ট শুরুয়াতের ঠিক আগে। সমস্ত অস্ট্রেলীয় মিডিয়া বলছে, রবীন্দ্র জাডেজা কেন ইংরেজি ভাষায় উত্তর দিতে আপত্তি করবেন? এহেন দুর্ব্যবহার সইতে পারা কি সম্ভব? আপত্তি অবশ্য করেননি তিনি। যদি করেও থাকেন, বেশ করেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় কি তিনি শুদ্ধ ইংরেজির পাঠ দিতে গিয়েছেন? আচ্ছা, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নিশ্চয়ই রবীন্দ্র জাডেজাকে নির্বাচন করেছিল ইংরেজি ভাষার জ্ঞানের নিরিখে? আজ্ঞে না। তবে? পাতি কথায়, অস্ট্রেলীয় মিডিয়া তৈরি করতে চেয়েছে একটি ‘কন্ট্রোভার্সি’। যে কন্ট্রোভার্সির মধ্যে মিশে আছে অস্ট্রেলীয় ঔদ্ধত্য। মিশে আছে ঔপনিবেশিক চেতনা। প্রথম বিশ্বের দৃষ্টিকোণ।

রবীন্দ্র জাদেজা

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দল যখন ভারতে খেলতে এসেছে, প্রেস কনফারেন্স কি হিন্দিতে হয়েছে একটিবারও? না হওয়াটাই শোভনীয়। সমীচীন। ভারতীয় সাংবাদিককুল যদি স্টিভ স্মিথকে বলতেন, ‘হায়, হায়! আপনি হিন্দি জানেন না মশাই?’, বলুন তো, কেমন হত? সোশাল মিডিয়া উপচে পড়ত মিমে। আপনারাই কেউ কেউ নির্ঘাত বলে উঠতেন, ‘এই কি তাহলে ভারতীয় সংস্কৃতি? ভারতীয় রুচি? অতিথি আপ্যায়ন কবে শিখব আমরা?’

…………………………………….

ভাষার নিজস্ব একটা রাজনীতি আছে। যে ক্ষমতার চূড়োয়, হরবখত চাইছে প্রতিটি নাগরিক যেন এক ভাষাতেই কথা বলে। বহুস্বরের অস্তিত্ব সহজেই ঘুচে যায়। বহুস্বর না থাকলে, অতএব বহুমত থাকে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে যে ধারণা এখনও বেঁচেবর্তে আছে একুশ শতকে, সেটিও যায় ক্ষয়ে। এরপর তবে কী হয়? ‘এক দেশ এক ভোট’ অথবা ‘এক দেশ এক ভাষা’। একটা কন্ট্রোভার্সির অভিঘাত কী বিপুল, কত গভীরে তার শিকড়, কখনও ভেবে দেখেছেন?

…………………………………….

বৃষ্টিফোঁটার যেমন ভাষা আছে। চড়ুই পাখির যেমন ভাষা আছে। পবিত্র সরকার যেমন লিখেছিলেন নৈঃশব্দ্যের ভাষা। তেমনই ফ্যাসিস্টের ভাষা আছে। কুয়াশাঘেরা হিমরাতের ভাষা আছে। মনখারাপের ভাষা আছে। যৌনতার ভাষা আছে। বিপ্লবের ভাষা আছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভাষা আছে। যে ভাষা বহন করছে সকলেই। আপন আদরে। লালনে। শরীরে। রবীন্দ্র জাডেজাও মাতৃভাষার পরে যে ভাষাটি শিখেছেন, তা ক্রিকেটীয় ভাষা। সেই শিক্ষায় কোনও খাদ নেই। তৃতীয় টেস্টে, ব্রিসবেনে, অবলীলায় ব্যাট ঘুরিয়ে অর্ধশতরান উদযাপন করতে পারেন তাই। উদযাপন করতে পারেন পরাজয়ের হাঁ-মুখ থেকে টিম ইন্ডিয়ার ফিরে আসার রাস্তাটি। ক্রিকেট তাই যোগ্যতার খেলা। পারদর্শিতা। কনসেন্ট্রেশন। দক্ষতা। ফিজিক্যাল ফিটনেস। ধ্যানমগ্নতা। একে অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। কে কত উচ্চমার্গীয় ইংরেজি বলতে পারে, ক্রিকেটের কী-ই বা আসে যায়? প্রেস কনফারেন্স কিংবা মিডিয়া বাইট– ক্রিকেটের অনুষঙ্গ শুধু। চারপাশে ঘোরে। কিন্তু অন্তঃস্থলে? অকপট প্রতিভা।

Image
স্যর জাদেজা: টিম ইন্ডিয়ার ভরসার আর এক নাম

শুনুন, রবীন্দ্র জাডেজা ইংরেজি বলতে দ্বিধাবোধ করেননি। ভারতীয় সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন হিন্দিতে। সেটাই স্বাভাবিক। এবং প্রেস কনফারেন্সের কেন্দ্রেও ভারতীয় মিডিয়া। কিছু অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকের আমন্ত্রণ ছিল অবশ্যই। স্থান, কাল এবং পাত্র– তিনটিই রবীন্দ্র জাডেজার মাতৃভাষার পক্ষে। খামোখা ইংরেজিতে কথা বলতে যাবেন কেন? অজি মিডিয়ার এই অযথা হম্বিতম্বিতে আসলে প্রকট হয় ভাষার আগ্রাসন।

Image
ব্যাট হাতেও সাবলীল ‘টিম ইন্ডিয়া’র জাড্ডু

যেহেতু ভাষার নিজস্ব একটা রাজনীতি আছে। যে ক্ষমতার চূড়োয়, হরবখত চাইছে প্রতিটি নাগরিক যেন এক ভাষাতেই কথা বলে। বহুস্বরের অস্তিত্ব সহজেই ঘুচে যায়। বহুস্বর না থাকলে, অতএব বহুমত থাকে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে যে ধারণা এখনও বেঁচেবর্তে আছে একুশ শতকে, সেটিও যায় ক্ষয়ে। এরপর তবে কী হয়? ‘এক দেশ এক ভোট’ অথবা ‘এক দেশ এক ভাষা’। একটা কন্ট্রোভার্সির অভিঘাত কী বিপুল, কত গভীরে তার শিকড়, কখনও ভেবে দেখেছেন?

Like a steadfast horse ... ': Ravindra Jadeja announces retirement from T20Is | Cricket News - Times of India
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর জাদেজা

১৯৮৩। টিম ইন্ডিয়া বিশ্বকাপ জিতল। লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ কুপোকাত! ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন কপিল দেব। অলরাউন্ডার। ইংরেজিতে সড়গড় ছিলেন না। বিশ্বকাপ জয়ের বহুবছর পরে তিনি বলেছেন, শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় অপারদর্শিতার জন্যে ক্যাপ্টেন্সি থেকে বাদ পড়তে পারত তাঁর নাম! এমনও বলা হয়েছিল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কোনও প্রফেসরের কাছে তোমার ইংরেজি ভাষাটি ঝালিয়ে নাও। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিল দেবের যে ১৭৫ রানের অতিমানবিক ইনিংস, যে ইনিংসের ওপর নির্ভর করেছিল টিম ইন্ডিয়ার বিশ্বকাপ-ভবিষ্যৎ, সেটি কেবলমাত্র ক্রিকেটীয় দীক্ষায় দীক্ষিত। সে ইনিংসের মাতৃভাষা একটিই। ক্রিকেটীয়। রবীন্দ্র জাডেজা সেই ভাষাটিকে অতি যত্নেই ধারণ করেছেন। মাতৃভাষার মতোই। তাই ইংরেজি অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে অনেক জায়গায় আবশ্যিক ভাষা হয়ে উঠলেও, লিওনেল মেসি কিংবা জঁ-লুক গোদারের প্রতিভার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।

38 Years Of Haryana Hurrincane Kapil Dev 175* | Youth Incorporated
কপিল দেব, ব্যাট হাতে বিধ্বংসী মেজাজে

রবীন্দ্র জাদেজা হিন্দি বলতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়লে, প্রতিবাদ করব। আবার হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা– এই মহান গাজোয়ারি মিথ্যে বললেও প্রতিবাদ করব। যে কোনও প্রতিভাই, যেন নিজের ভাষায় কথা বলে যেতে পারে। এই আমাদের চাওয়া, আপনার ভাষা কি একথা সমর্থন করে না?

………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………