রোহিত-ধাওয়ান-বিরাট। ভারতীয় ক্রিকেটের টপ অর্ডারের স্তম্ভ ছিলেন দীর্ঘদিন। একসঙ্গে বহু ম্যাচ খেলেছেন, জিতেছেন। অসংখ্য ট্রফি ঢুকেছে টিম ইন্ডিয়ার ঝুলিতে। সেই জুটি ভেঙে গিয়েছে অনেকদিন। বিরাট-রোহিতরা এখনও ভারতের জার্সি গায়ে দেন। কিন্তু ২০২২ থেকে মানচিত্রে ধীরে ধীরে মুছে গিয়েছেন গব্বর। ফর্মের ওঠাপড়া ছিল, চোট-আঘাত ছিল। মহা ধুমধামে উঠে এসেছেন শুভমান, ঈশান কিষাণরা। অথচ তথ্য বলছে অন্য কথা। ২০১৯ থেকে ২০২২-র মধ্যে আইপিএলে ধাওয়ান প্রায় ২৫০০ রান করেছেন। জাতীয় দলের জার্সিতে ফিরতে খুব খারাপ পারফরম্যান্স?
‘কিতনে আদমি থে?’ পাহাড়ে ঘেরা গোপন ডেরায় হুংকার দিচ্ছেন গব্বর সিং। তাঁর আশপাশে তখন অনুগত দস্যুরা। কেউ-বা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে খেই ধরিয়ে দিচ্ছে অসমাপ্ত বক্তব্যের। আর ‘শোলে’ সিনেমার শেষে? খলনায়কের পরাজয় হবে এ তো ধ্রুব সত্য। দু’হাত হারানো গব্বরের যখন ক্লাইম্যাক্স লেখা হচ্ছে, তখন দস্যুদলের সকলেই পরাভূত। এক সময়ের দাপুটে নেতা নিঃস্ব, বিধ্বস্ত অবস্থায় এবার শেষের গান শুনবেন।
না, ক্রিকেটের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই। সিনেমার কাল্পনিক কাহিনি, বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় ভিলেনের সঙ্গে বাস্তবের মিল না খোঁজাই শ্রেয়। তবু নামমাহাত্ম্যে এক সারণিতে এসে পড়েন দুই ‘গব্বর’। যখন ব্রাত্য, নিঃসঙ্গ শিখর ধাওয়ানের ক্রিকেট কেরিয়ার চলে যায় অস্তাচলে। কয়েক বছরের বঞ্চনার পরিবর্তে শুকনো বিদায় সম্ভাষণ ছাড়া কিছুই তখন ফিরিয়ে দেওয়ার থাকে না ক্রিকেটবিশ্বের।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, অধিকাংশ ভারতীয় ক্রিকেটারের অপসারণ বড্ড নিঃশব্দে। শচীনের মতো রাজকীয় ফেয়ারওয়েল পান ক’জন! এক হতে পারে, আমাদের ক্রিকেটের সাপ্লাই লাইন। ভারতের আর পাঁচটা চাকরিক্ষেত্রের মতো এখানেও তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রতিদ্বন্দ্বীরা। পারফর্ম করো, নয়তো সরে যাও। আর দ্বিতীয়টা বলা যেতে পারে, নিজেকে নিংড়ে নেওয়ার মনোবৃত্তি। যতদিন মাঠে আছি, ততদিন মুখের ওপর আলো। নিজের শেষ লড়াই লড়ে যাব। কখন যে সময় ডালে পাতা ফুরিয়ে আসে, সেটা বোঝার আগেই জায়গা হয় দলের বাইরে।
সদ্য অবসর নেওয়া শিখর ধাওয়ানের ক্ষেত্রেও দু’টি যুক্তিই কমবেশি সাজিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু গোল বাঁধে অন্যখানে! তথ্য-পরিসংখ্যানের একরাশ খরখরে পাতা উড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আরও একটি প্রশ্ন। যেটা একক খেলোয়াড়ের কেরিয়ার ছাপিয়ে সার্বিকভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে। ঢাক গুড়গুড় করে লাভ নেই। আচ্ছা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সনৎ জয়সূর্য, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথু হেডেনদের মধ্যে মিল কোথায়? ক্রিকেটভক্তরা উত্তর দিতে দেরি করবেন না। এঁরা প্রত্যেকেই বাঁ-হাতি ওপেনার। তালিকায় গম্ভীর, গ্রেম স্মিথ, সাঙ্গাকারার নাম যুক্ত করা যায়। কিন্তু তারপর?
সেখানেই এসে পড়বেন শিখর ধাওয়ান। বাঁহাতি ওপেনারদের ঐতিহ্যের উত্তরসূরি। সঙ্গে পেতে পারেন ডেভিড ওয়ার্নারকে। নয়তো ক্রিকেটের এই সৌন্দর্যটা বড্ড ফিকে হতে শুরু করেছিল। যশস্বী জয়সওয়ালদের ভবিষ্যৎ কী, কেউ জানে না। ফলে ধাওয়ানের অবসর অর্থ, ক্রিকেটের একটা বিশেষ ক্ষেত্রেও শূন্যস্থান তৈরি হওয়া। আর এটাও যেন অলিখিত সত্য, বাহাঁতি ওপেনারের মধ্যে আগ্রাসন তুলনামূলকভাবে বেশি। সৌরভের বাপি বাড়ি যা-র উদাহরণ তো আসবেই। গিলক্রিস্ট, হেডেনরা রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখতেন বোলারকে। জয়সূর্য মানে ছিল একটা বিস্ফোরণ! ধাওয়ানকেও কিন্তু অনায়াসে ঢুকিয়ে নেওয়া সেই তালিকায়।
২০১০-এ তাঁর ভারতীয় দলে অভিষেক। কিন্তু সেরা ফর্মটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৩ পর্যন্ত। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও হন তিনি। তার পর ২০১৫-র বিশ্বকাপ ও ২০১৭-র চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। প্রতিটা টুর্নামেন্টে ধারাবাহিক তিনি। ধাওয়ানের নামই হয়ে গেল ‘মিস্টার আইসিসি’। ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছে রোহিত-ধাওয়ানের ওপেনিং জুটি। একসঙ্গে ১১৫টি ইনিংস খেলেছেন দু’জনে। ৪৪ গড়ে করেছে ৫১৪৮ রান। ওপেনিং জুটি থেকে রোহিত আউট হয়ে গেলে তিন নম্বরে নামতেন বিরাট কোহলি। দুই দিল্লির ক্রিকেটার একসঙ্গে কম রান করেননি। ৬০ ম্যাচে দু’জনে করেছেন ৩,৪৩০ রান। গড় ৬০ রানেরও বেশি।
রোহিত-ধাওয়ান-বিরাট। ভারতীয় ক্রিকেটের টপ অর্ডারের স্তম্ভ ছিলেন দীর্ঘদিন। একসঙ্গে বহু ম্যাচ খেলেছেন, জিতেছেন। অসংখ্য ট্রফি ঢুকেছে টিম ইন্ডিয়ার ঝুলিতে। সেই জুটি ভেঙে গিয়েছে অনেক দিন। বিরাট-রোহিতরা এখনও ভারতের জার্সি গায়ে দেন। কিন্তু ২০২২ থেকে মানচিত্রে ধীরে ধীরে মুছে গিয়েছেন গব্বর। ফর্মের ওঠাপড়া ছিল, চোট-আঘাত ছিল। মহা ধুমধামে উঠে এসেছেন শুভমান, ঈশান কিষাণরা। অথচ তথ্য বলছে অন্য কথা। ২০১৯ থেকে ২০২২-র মধ্যে আইপিএলে ধাওয়ান প্রায় ২৫০০ রান করেছেন। জাতীয় দলের জার্সিতে ফিরতে খুব খারাপ পারফরম্যান্স? নাকি যৌবরাজ্যকে আহ্বান জানাতে গিয়ে উপেক্ষা বরাদ্দ থাকে ধাওয়ানের জন্য? এর মাঝে রয়েছে বিরাট কোহলির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জল্পনাও।
………………………………………….
আরও পড়ুন রোদ্দুর মিত্র-র লেখা: সারা পৃথিবীতেই আন্দোলন ফুটবলের জন্মদাগ
………………………………………….
গব্বরের আচরণে যদিও কোনও দিন বিরক্তি ধরা পড়েনি। ২০২২-এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়ান’ডে সিরিজে অধিনায়ক ছিলেন ধাওয়ান। মূলত, একঝাঁক উঠতি ক্রিকেটারকে দেখা নেওয়া হয়েছিল সেই সিরিজে। ধাওয়ান সেখানে কী যুক্তিতে ছিলেন, বলা মুশকিল! কিন্তু সিরিজ জয়ের শেষে তরুণ ব্রিগেডের সঙ্গে ড্রেসিংরুমে নাচের ছন্দে মাতলেন তিনি। সিনিয়র-জুনিয়র ব্যবধান মুছে তিনিও হয়ে ওঠেন ‘গার্ডেন মে ঘুমনেওয়ালা বান্দা’।
ততদিনে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ধাওয়ানের। স্ত্রী আয়েষা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রায় ১০ বছরের সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে। ছেলে জোরাবেরের সঙ্গে দেখা করার অধিকার পর্যন্ত নেই। ব্যক্তিগত জীবন যখন তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, তখনও সদা হাস্যমুখ ধাওয়ান। উষ্মা নেই, কটূক্তি নেই। অপ্রাসঙ্গিক বিরক্তি নেই। মাঝেমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় হাস্যকর রিল পোস্ট। তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে চাপা দীর্ঘশ্বাস। ধাওয়ান হেসেছেন, গোঁফে তা দিয়েছেন। ক্রিকেট মাঠে ক্যাচ ধরে কবাডির চেনা সেলিব্রেশন করেছেন।
ব্যস, এটুকুই। কবেই তাঁর শরীর থেকে খুলে পড়েছে ‘মিস্টার আইসিসি’-র জোব্বা। তাঁকে ছাড়াই বিশ্বকাপ জিতেছেন রোহিত-বিরাটরা। কারওর জন্যই তো কোনও কিছু থেমে থাকে না। ধাওয়ান সেটা হয়তো সবার আগে বুঝেছেন। হার-জিতের পাওনাগণ্ডা ভুলে জীবনের স্পিরিটকে করেছেন তালুবন্দি। বিদায়বেলায় স্পটলাইট না-হয় একটু কম ওয়াটের হোক। পাশে না-হয় কেউ না থাকুক। এভাবেই হাসতে থাকুন ‘গব্বর’। সমস্ত বঞ্চনা ভুলে, সমস্ত তিক্ততাকে দূরে ঠেলে।
…………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………………………