সময়-সময় মনে হয়, ফুটবল খেলাটা যত জান্তব, তার সমর্থন ঠিক ততটাই বিদ্রোহী। আর ঠিক সেই কারণেই পৃথিবীর বাদবাকি খেলার থেকে ফুটবল এত স্বতন্ত্র, স্বতন্ত্র ফুটবল সমর্থন। লিখছেন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়।
১.
‘আর ইউ ফ্রম পাকিস্তান? গোয়িং টু ওয়েম্বলি? হুম ডু ইউ সাপোর্ট? সিটি অর ইউনাইটেড?’
জুলজুলে চোখ, উলোঝুলো চুল, ফোলা-ফোলা গাল ও যুতসই দশাসই চেহারার প্রশ্নকর্তা যিনি, মহাশয়কে এক পলক দেখলে টেনিদার ‘পেশোয়ার কী আমির’ গল্পের সায়েব-চরিত্র বিলক্ষণ মনে পড়বে! অবিকল সেই গল্পের ডার্কডেভিল সায়েব। গেঁটে বাতে অষ্টপ্রহর যে ভুগছে এবং অবশ্যই যে প্রবল হুমহুমে। সুড়সুড়িয়ে সাহেবকে শুধরে দিয়ে ‘ইন্ডিয়া’ বলামাত্র শুনলাম পরিষ্কার বাংলায় কানের কাছে কে বলছে, ‘ঢুকিস না রাজর্ষি, ঢুকিস না। খামোখা কথাবার্তায় যাস না, সামলানো যাবে না।’ বক্তা কে আর, ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে বেড়ানো ক্রিকেট সাংবাদিক দেবাশিস সেন! যে ভারত-অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল কভার করতে এসেছে বটে, কিন্তু আপাতত (আদতে গত জুন মাসের কথা) এই শর্মার সঙ্গে ট্রেনে চেপে ছুটছে ওয়েম্বলি। সিটি বনাম ইউনাইটেড এফএ কাপ ফাইনালের আবহের ওম নিতে। বাংলায় বিড়বিড়ের সঙ্গে যে নির্বিকার মুখে ভিডিও করে চলেছে সব কিছুর, সুন্দর দেঁতো হাসি ঝুলিয়ে!
পেশাগত সিনিয়রের সাবধানবাণীর কারণেই হোক কিংবা বছর সাত পূর্বের ইউরো-অভিজ্ঞতা, কামরার ইংরেজ ভদ্রলোকের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর আর সাহস হয়নি। সায়েব জার্সি পরেননি, আশপাশে তাঁর জনা চারেক বন্ধুবান্ধবরাও নয়, সিটি না ইউনাইটেড সমর্থক বোঝা যাচ্ছে না– এ হেন দোটানার মাঝে দুর্বলচিত্তে পছন্দের টিমের নামপ্রকাশের অর্থ, গিলোটিনে গলা তুমি গলিয়ে দিলে, বাকি তোমার কপাল। আসলে এ সমস্ত বিটকেল পরিস্থিতিতে বাঁচার শর্তই হল, ভোম্বল সেজে মিটিমিট হাসো, আর শেষে জল যে দিকে গড়াচ্ছে সুডুৎ করে সে দিকে গড়িয়ে যাও। নইলে সামান্য ভুলচুকে চোদ্দো পুরুষের তর্পণ নিমেষে হয়ে যাবে! ইউরোর প্যারিসে হয়েছিল যেমন। ফ্যান জোনে এক ইংরেজ ‘দোস্ত’-এর সঙ্গে কথার ফাঁকে পছন্দের ফুটবল টিমের নাম মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল। টিমের নাম মোটেও ইংল্যান্ড ছিল না এবং প্রতিদানে গালিগালাজের যে অকাতর ‘পুষ্পবৃষ্টি’ হয়েছিল, আজও দিব্য মনে আছে। বিশ্বাস না হলে যান না ডার্বির যুবভারতী। উল্টো গ্যালারিতে বসে প্রিয় টিমের নাম বলুন না একবার। কত ধানে কত চাল, হিসেব হয়ে যাবে!
তা, উত্তরে বিলম্ব দেখে সায়েবও আর কালবিলম্ব করলেন না। উল্টোদিকে ঘুরে গেলেন। মিনিট দুয়েকে পিঠের ব্যাগ থেকে সিটির নীল জার্সি বেরোল, সমবেত হেঁড়ে গলা তারস্বরে গান ধরল, কামরার দেওয়াল মুহূর্তে বদলে গেল মনোরম ‘বাদ্যযন্ত্রে’ (আসলে ফুটবল-পাগল দেশে খেলাটেলা পড়লে সমর্থকরা মেট্রো বা ট্রেনেই যতটা সম্ভব ‘হাতের সুখ’ করে নেন)। এবং শেষে শুরু হল নাচ। আর কী অলুক্ষুণে সেই নাচ! যা নকল করতে গেলে, স্বয়ং মাইকেল জ্যাকসনকেও বোধহয় বিড়ম্বনায় পড়তে হত! আর ট্রেন বাবাজীবন দাঁড়িয়েও পড়লেন কিছুক্ষণে। উপায় কী? পাশের কামরায় ততক্ষণে যে আবার উঠে পড়েছে লাল জার্সির দল, উঠে পড়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে, যারা আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ট্রেন থেকেই ছুঁড়ে চলেছে ‘ফ্লেয়ার!’ অগত্যা নামো ট্রেন থেকে, চলো ‘পয়দল’! স্টেশনেই মুখ শুকনো করে ঘোরা পুলিশ অফিসারের আর্তি লেখাটা লিখতে লিখতে ফের মনে পড়ল। যিনি বিধ্বস্ত ভাবে বলেছিলেন, ‘কী করব আমরা? পুলিশ দিয়েছে এক হাজার, আর এরা হাজার-হাজার!’ সত্যি। নিতাম্তই অসম্ভব। আর কতটা অসম্ভব, চাক্ষুষ করেছিলাম ওয়েম্বলি ঢোকার পর। বোমারু বিমানের গর্জন শুনেছেন? গোঁ-গোঁ শব্দে যা তেড়ে আসে? কিংবা বুনো হাতির দল দেখেছেন? গাছপালা মটমটিয়ে যা ধেয়ে আসে? ওয়েম্বলিতে ফুটবল ফাইনাল দেখতে আসা লাল-নীল সমর্থন-বাহিনী হুবহু এক। পারিপার্শ্বিকের তোয়াক্কা না করে যারা হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে আসছিল শয়ে-শয়ে, দলে-দলে, হাজারে-হাজারে, কাতারে-কাতারে। প্রতিপক্ষকে পিষে ফেলার ক্রুর বাসনা নিয়ে। ‘কর্ডন’ করে আবেগের যে বেলাগাম আতসবাজিতে লাগাম পরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিল কিছু উর্দিধারীর দল, যার নাম পুলিশ!
সময়-সময় মনে হয়, ফুটবল খেলাটা যত জান্তব, তার সমর্থন ঠিক ততটাই বিদ্রোহী। আর ঠিক সেই কারণেই পৃথিবীর বাদবাকি খেলার থেকে ফুটবল এত স্বতন্ত্র, স্বতন্ত্র ফুটবল সমর্থন। উইম্বলডনের স্ট্রবেরি অ্যান্ড ক্রিমের অভিজাত পৃথিবী সে নয়, ফুটবল সমর্থনের ভূখণ্ডে খেলার সঙ্গে মিষ্টি প্রেমিকার মতো খুনসুটি চলে না। লর্ডসের খানদানি লংরুমও সে দেশে নেই, যা ক্রিকেট নামক খেলাটার বাহ্যিক হইহুল্লোড় সত্ত্বেও অনবরত মনে করিয়ে দেয়, শিষ্টাচারই প্রথম, দিন শেষে খেলাটা ‘জেন্টেলমেন্স গেম।’
আসলে ফুটবল সমর্থনের দেশ যে হৃদয় দিয়ে তৈরি। যে দেশে প্রিয় টিম হারলে বুকফাটা কান্নায় ডুবে যায় লোকে, বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। যে দেশে প্রিয় টিম জিতলে পানশালা ভাঙচুরই দস্তুর, খালি গায়ে গাড়ির বনেটে শুয়ে তখন নিজেকে এরোপ্লেন ভাবতে বড় ইচ্ছে হয়। যে দেশে টিমের হার-জিত পরবর্তী প্রতিটা পদক্ষেপই প্রায় সামাজিক শিরঃপীড়ার কারণ। যে দেশে শোক ভুলে মাঠে চলে যায় শোকার্ত পিতা, সন্তানকে পুড়িয়ে। কী করা যাবে, প্রাণের টান বলে এক বস্তু আছে না? আর হ্যাঁ, ইংরেজি-বাংলা বা হিব্রু কিছুই চলে না সে দেশে। আলাদা এক ভাষা আছে তার। যে ভাষা সর্বত্র এক, মোহনবাগান থেকে ম্যাঞ্চেস্টার। যে ভাষা, ভাষার আগের ভাষা। মানুষের আদিম ভাষা। আবেগের ভাষা।
থাকতে ইচ্ছে করে না এরপর ও দেশে? বলতে ইচ্ছে করে না সে ভাষা? নাহ্, ট্রেনের লালমুখো সায়েবকে দু’দলের মধ্যে পছন্দের নাম বলে দেওয়াই যেত, কী বলেন? দু’একটা গালমন্দে কতটুকুই বা এসে-যায়!