ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট যখন জাঁকিয়ে বসেছে তখন আরামকেদারায় লিপ্ত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা এই দেশের জন্য চিন্তা ছেড়ে তথাকথিত টাকার পিছনে ছোটার জন্য কতটা গঞ্জনা দেন বর্তমান যুগের ক্রিকেটারদের। সেই তাঁরাই আবার কোনও ক্রিকেটার দেশের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলা না খেলে যদি সন্তান-জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থেকে সাহস যুগিয়ে এই বিরল অথচ সর্বাঙ্গীণ সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে চান তাহলেও সেই সব পরিবার সচেতন আধুনিক পুরুষদের ‘দেশদ্রোহী’ অ্যাখ্যা দিতে পিছপা হন না।
নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় বছর তখন। ভারত সরকার অনুভব করেছে যে, সন্তান-জন্মের সময় পুরুষদেরও ভূমিকা আছে। অথবা, থাকা উচিত। মহিলাদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি সেই ১৯৬২ থেকে আইনত থাকলেও পুরুষদের জন্য সামান্য ব্যবস্থা করতে ৫০টা বছর লেগে গেল!
মায়েরা সন্তানকে ধারণ করেন, দশমাস সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। একটা জীবন নিজের মধ্যে বাড়তে দেন। তারপর জন্মের পরেও মাতৃদুগ্ধ খাওয়ার সময়টার পরেও মায়ের মাধ্যমেই সন্তানরা পৃথিবী চেনে। কিন্তু বাবারা? সন্তানের জন্ম তাঁদের কাছে শুধুমাত্র গর্বের ব্যাপার। বংশবৃদ্ধি হবে, নিজের নাম পাবে, লোককে বড় মুখ করে বলে বেড়াবেন, ‘আমার ছেলে’! ‘আমার মেয়ে’-র জন্য গর্ববোধটা বোধহয় এখনও আনাচেকানাচে এক ফোঁটা চোনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এভাবেই বাবারা বাবা হয়। বাবা বাইরে যাবেন। দেশের ও দশের জন্য নিযুক্ত প্রাণ হবেন। অর্থ সংস্থান করবেন, আর বাড়িতে এসে পায়ের ওপর পা তুলে বসে হুকুম করবেন। ছেলেমেয়েরা মায়ের আঁচল জড়িয়ে বড় হবে, বাবাকে তারা দূর থেকে দেখবে একটা ভয়মিশ্রিত ভক্তি নিয়ে।
না, না, এরকম ব্যাপার এখন বিরল হলেও অপ্রতুল নয়। আসলে যৌথপরিবার ভেঙে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ‘হিজ হিজ, হুজ হুজ’ সংসার তৈরি হওয়ার পরে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের প্রতি বাবাদেরও দায়িত্বে রকমফের হয়েছে! আজকালকার বাবারা সংখ্যায় কম হলেও, মায়ের সমান না হলেও, সন্তানের জন্য রাত জাগছেন, ডায়পার পরিবর্তন করছেন, দুধের বোতল হাতের উল্টোদিকে সামান্য চিপে দুধের ফোঁটা ফেলে বুঝে যাচ্ছেন, তা সন্তানের খাওয়ার উপযোগী কি না!
তাহলে? দেশ আগে না পরিবার? দেশের সুরক্ষায় আঁচ আসার আগে পর্যন্ত আজকের বাবারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারকেই ভেবে নিচ্ছে, এটা ভাবতেও যেন ইচ্ছে করে। এমনকী সেনাবাহিনীতেও পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে না, যদি না জাতীয় সুরক্ষায় দাগ লাগার সম্ভাবনা থাকে।
আচ্ছা, খেলার মাঠে যাঁরা দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা কি এই ‘দেশসেবা’র মানদণ্ডে মানানসই হন? অন্তত আবেগসর্বস্ব ভারতীয়রা তেমনই ভাবতে ভালোবাসে। অলিম্পিকের মঞ্চই হোক বা ক্রিকেট বিশ্বকাপ, তেরঙ্গা ‘লেহরা’ দিলেই যেন দেশের জন্য আবেগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়।
দেখবেন, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট যখন জাঁকিয়ে বসেছে তখন আরামকেদারায় লিপ্ত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা এই দেশের জন্য চিন্তা ছেড়ে তথাকথিত টাকার পিছনে ছোটার জন্য কতটা গঞ্জনা দেন বর্তমান যুগের ক্রিকেটারদের। সেই তাঁরাই আবার কোনও ক্রিকেটার দেশের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলা না খেলে যদি সন্তান-জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থেকে সাহস যুগিয়ে এই বিরল অথচ সর্বাঙ্গীণ সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে চান তাহলেও সেই সব পরিবার সচেতন আধুনিক পুরুষদের ‘দেশদ্রোহী’ অ্যাখ্যা দিতে পিছপা হন না।
আচ্ছা, সত্যিই কি তারা দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ নন? আজকের ক্রিকেটাররা? আচ্ছা, ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলা আর দেশের হয়ে প্রাণ নিবেদন করার মধ্যে সম্পর্ক কোথায় জানাবেন? এ তো আর কার্গিলের মাইনাস ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সোজা দাঁড়িয়ে থাকা নয়, দেশের সুরক্ষার কারণে! নাহ্, সরলমতী ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থক ও তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের কাছে দুটো একই হয়ে যায়। শেষ বলে ছক্কা মেরে বিশ্বকাপের মঞ্চে জেতালে জাতীয় বীর যেমন হয়ে যান, তেমনই সন্তান জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে না থেকে পারথে টেস্ট খেলতে নামার মধ্যে এক অদ্ভুত পৌরুষ কাজ করে!
সাধারণ মানুষের কথা ছেড়েই দিন, প্রাক্তন ক্রিকেটাররা, যাঁরা একটা দুটো কি পাঁচটা প্রজন্ম আগে খেলেছেন, যাঁদের কাছে নারীদের উপস্থিতি শুধুমাত্র সংসার সামলানো এবং নিজস্ব যৌন তাড়না নিবারণের উপায়, তাঁরাই বর্তমান ক্রিকেটারদের পরিবারকে বেশি সময় দেওয়া নিয়ে সংবেদনহীন মন্তব্য করতে দু’বার ভাবেন না!
প্রাক্তন কিংবদন্তি, ক্রিকেটে ভারতের প্রথম বিশ্বমানের খেলোয়াড় হিসাবে যাঁকে বলা চলে, তিনি তো নিয়মিত ভিত্তিতে পিতৃত্বকালীন অবকাশের বিরুদ্ধে রীতিমতো ক্যাম্পেন চালান। ১৯৭৬-এ তাঁর নিজের সন্তানকে তিনি বহুদিন দেখতে পাননি। এই কথা বলে আজকের ক্রিকেটারদের থেকে একই ব্যাপার আশা করেন। কিন্তু আজ যদি কোনও ক্রিকেটার তাঁর মতো খেলাটা না বুঝে ৬০ ওভারে ৩৬ নট আউট খেলতেন, তা হলে তিনিই ছিঁড়ে ফেলতেন। খেলার সময় আধুনিক, অথচ জীবনধারণের ব্যাপারে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা!
……………………………………………….
আচ্ছা, খেলার মাঠে যাঁরা দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা কি এই ‘দেশসেবা’র মানদণ্ডে মানানসই হন? অন্তত আবেগসর্বস্ব ভারতীয়রা তেমনই ভাবতে ভালোবাসে। অলিম্পিকের মঞ্চই হোক বা ক্রিকেট বিশ্বকাপ, তেরঙ্গা ‘লেহরা’ দিলেই যেন দেশের জন্য আবেগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়।
……………………………………………….
শুধু কি তিনি? বাঙালির বিশেষ আইকন, ভারতের এক সময়ের প্রবাদপ্রতিম অধিনায়কও বর্তমান ভারতের অধিনায়কের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেন, ‘সন্তানের জন্ম হয়ে গেছে, আবার থাকা কেন? এবারে মাঠে গিয়ে নামলেই তো হয়!’ আশ্চর্য! নিজের সন্তান যখন সমাজের অবিচারে বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তখন সেই অবস্থান থেকে সরে গিয়ে নিজের সুবিধাবাদী অবস্থানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সন্তানের মুখ বন্ধ করান। নিজের স্ত্রীর শিল্পকলার প্রতি বিন্দুমাত্র সংবেদনশীলতা দেখান না। অর্থাৎ, তাঁর নিজেরই সেকেলে মানসিকতার উপর ভুষোকালি পড়ে যায়, লক্ষ্য থাকে না।
অথচ বিদেশে, বিশেষত ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ায় এই কাজ বারবার হয়েছে। কেভিন পিটারসন, কেন উইলিয়ামসন, রোরি বার্ন্স তো কয়েকটা নাম। ভারতে রাহুল দ্রাবিড়ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট থেকে সাময়িক ছুটি নিয়েছিলেন সন্তান-জন্মের সময়।
অবশ্য এই বিষয়ে শুধু ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হতে গেলে অন্য খেলাগুলো নিয়েও বলতে হয়। আমেরিকান ফুটবলে খেলোয়াড়ের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার সময়ই ফ্র্যাঞ্চাইজিরা তিনদিনের পিতৃত্বকালীন ছুটি দিতে সহমত হয়। যদি ক্রিকেটে আবার ফিরে যাই তাহলে পুরুষ বা নারী নির্বিশেষে উভয়কেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া অধিকতম ১২ মাসের ছুটি দেয়, এবং পলিসি অনুযায়ী বার্ষিক চুক্তিও সরাসরি নতুনভাবে সম্পন্ন করা হয় যে, পিতৃত্ব বা মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় যাতে আর্থিকভাবে সমস্যায় না পড়তে হয়, তা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া নজর রাখবে।
হকিতে ভারতের ললিত উপাধ্যায় যেমন কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত জার্মানির সঙ্গে টেস্ট ম্যাচে খেলেননি পিতৃত্বকালীন অবকাশ নেওয়ার কারণে। তখন কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। হকি ক্রিকেটের মতো জনপ্রিয় নয় বলে হয়তো এই নিয়ে হইচই হয়নি।
যদিও এই যে সামান্য আগেই ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার কথা বললাম, অন্য খেলার ক্ষেত্রে কিন্তু এতটা সংবেদনশীলতা দেখা যায়নি। বহুবার। কিছুদিন আগেই আয়ারল্যান্ডের রবি কিনের যখন সন্তান-জন্ম নিয়েছে, তখন আয়ারল্যান্ডের সহকারী কোচ এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি খেলোয়াড় রয় কিন ন্যক্করজনকভাবে বলেছিলেন, ‘রবি কিন তো আর সন্তানের জন্ম দেননি। তাই তাঁর খেলতে সমস্যা হবার কথা নয়। তাঁকে তো আর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে হচ্ছে না!’
যেদিন থেকে জমিজমা, সম্পত্তি ইত্যাদির ধারণা মানুষের মধ্যে চালু হয়, তখন নিছক বাহ্যিক শারীরিক শক্তির বলে বলিয়ান পুরুষ তার হুকুমতন্ত্র চালু করে। এবং মহিলারা দ্রুত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে রূপান্তরিত হন। বহু যুগ কেটে গেছে, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করি না। তা হলে রোহিত শর্মাকে বোর্ডের তরফ থেকে চাপ দেওয়া হত না সন্তান-জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে না থেকে পারথে টেস্ট খেলার জন্য। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা পরামর্শ দিতেন না যে, তিনি হলে স্ত্রীর পাশে না-থেকে খেলতে যেতেন।
সুখের কথা, আজকের খেলোয়াড়রা, বিশেষত ক্রিকেটাররা কে কী বলল, তার থেকে পরিবারকে অধিক গুরুত্ব অর্পণ করেছেন। একবার যদি সন্তানের জন্মের মুহূর্তের সাক্ষী হবার জন্য মনস্থির করে ফেলেন তখন স্বয়ং ক্রিকেট বোর্ডও তা নরমে ও গরমে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়।
……………………………………………….
আরও পড়ুন সৌরাংশু-র লেখা: এক যে ছিল রাফা
……………………………………………….
প্রার্থনা করি, নতুন পৃথিবীতে মানুষের কাছে আর কিছু না থাকুক, পরিবারের জন্য সংবেদনশীলতা যেন প্রাণ ভরে থাকে। শেষমেশ পরিবারে নতুন সদস্য আসা এবং তার যত্নের জন্য বাবা যেন সবার আগে এগিয়ে আসে। সন্তান ধারণ মায়েরা করলেও, বাবারা তো শুধুমাত্র পরিচয় প্রদান করেন না, তাঁরা সন্তানের লালন পালন করেন। আধার এবং লালনপালনকারী এই দুই নিয়েই সংসার সম্পূর্ণ হয়। প্রাক্তনরা সেটা বুঝতে না পারলেও বর্তমানের ক্রিকেটার বাবারা যে এই বিষয়ে কোনও আপস করতে রাজি নন, এটাই আশার কথা।
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………..