ক্রিকেটের মায়াকাননে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ব্যাট-বলের যুদ্ধ জনমানসে তখন কৌতূহলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে একধাক্কায়। সেই আবহে ইডেনে প্রথম টেস্ট আয়োজিত হয় ১৯৩৪-এর ৫ জানুয়ারি। ভারতের মাটিতে যদিও সেটাই প্রথম টেস্ট নয়। ইডেন টেস্ট ছিল সিরিজের দ্বিতীয় দ্বৈরথ। তার আগে প্রথম টেস্ট আয়োজিত হয়েছিল বোম্বের (অধুনা মুম্বই) জিমখানা গ্রাউন্ডে। তারপর সময়ের চাকা নিজের গতিতে গড়িয়েছে। জিমখানায় আর কখনও আয়োজিত হয়নি কোনও টেস্ট। ইডেন সেই ইতিহাসের স্মারক ধরে রেখেছে সবুজ-হৃদয়ে। ক্রিকেটের নন্দনকানন তাই এখন দেশের সবচেয়ে পুরনো টেস্ট-কেন্দ্র।
সে এক মজার ঘটনা। বিকেলের ম্লান আলো তখন ছুঁয়ে গিয়েছে ইডেনের সবুজ বুক। মরা রোদে আরও মায়াবী লাগছে ক্রিকেটের নন্দনকাননকে। সেই পড়ন্ত বিকেলে মাঠের ধারে অপেক্ষমাণ এক দীর্ঘদেহী সাহেব। ক্রিকেট খেলিয়ে হিসেবে দেশজোড়া তাঁর নামডাক। এমসিসির টিম নিয়ে এসেছেন এদেশে, বেসরকারি টেস্ট খেলতে। সেই সুবাদে ইডেনে পদার্পণ। ভদ্রলোক– আর্থার গিলিগান। ইডেন দেখে চমকে গিয়েছেন আর্থার! ভুল বললাম। ইডেন নয়। ইডেনের মাঠ। নন্দনকাননের ওই সবুজ-গালিচা দেখে চমকে গিয়েছেন ইংরেজ ভদ্রলোক। মুগ্ধ হয়ে বলেছেন, এ মাঠ তো লর্ডসের সমতুল্য। কার দ্বারা সম্ভব হল এই অসম্ভব সৃজন? সাহেব তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী।
ফাগুরাম! স্বর্গোদ্যানের মালি। আরও স্পষ্ট করে বললে, ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ পরিচর্যার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। সেই সুবাদে নন্দনকাননের প্রতিটি ঘাস তাঁর চেনা। ইডেন ফাগুরামের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসায় ইডেনকে গড়ে তুলেছেন, বছরের পর বছর ধরে। মখমলের মতো সেই চিরহরিৎ ইডেন দেখে মজেছেন গিলিগান। প্রশংসায় মেতেছেন ফাগুরামের। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটা ১৯২৬। তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে টেস্ট আয়োজিত হয়নি ইডেনে। হবে। বছর আটেক পর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আজকের ইডেন আর সেদিনের ইডেনের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। তফাত ময়দানেও। উত্তাল তিরিশে তখন ময়দান জুড়ে ফুটবল, হকির একচ্ছত্র দাপট। ব্রিটিশ আধিপত্যের প্রাচীর ভেঙে মোহনবাগান নামটা তখন আবেগের দ্যোতনা বহন করছে ফুটবল পাগল জনতার মনে। ভাবীকালের পথ ধরে উঠে আসছে ইস্টবেঙ্গল। মহামেডান? ’৩৪ থেকেই তো সাদা-কালোর স্বর্ণযুগের শুরু। ইডেন ছিল তখন অন্যরকম।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ততদিনে অবশ্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে টেস্ট খেলে ফেলেছে ভারত। যদিও সেটা বিলেতের বুকে। ১৯৩২-এ লর্ডসে তৈরি হয়েছিল সেই ইতিহাস, সিকে নাইড-মহম্মদ নিসারদের হাত ধরে। কিন্তু দেশের মাটিতে টেস্ট খেলার স্বাদ। তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে অনন্য। সেই আক্ষেপ মিটতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও দু’বছর। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এল ১৯৩৪-এ। ইংল্যান্ডের ভারত সফর। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। তাই খেলতে শক্তিশালী টিম নিয়ে ভারতে পা রেখেছেন ডগলাস জার্ডিন। ডগলাস জার্ডিন! সুখ্যাতি নয়, কুখ্যাতির জেরে নামটা তখন ক্রিকেট দুনিয়ায় বেশ পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাসেজে তাঁর বিতর্কিত ‘বডিলাইন’ গেমপ্ল্যান ততদিনে ক্রিকেট মহলে ‘হট-টপিক’। হারল্ড লারউড, গ্যাবি অ্যালেনদের শরীর তাক করা বিষাক্ত পেস-অ্যাটাকে তখন রক্তাক্ত অজি ব্যাটিংয়ের শৌর্য। যে ব্যাটিংয়ের গর্বের নাম স্যর ডন ব্র্যাডম্যানদের মতো কিংবদন্তি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ‘অন্যায় মেনে নিতে পারব না বলেই সরে যাচ্ছি’ একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন সাক্ষী মালিক
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
যাক সে কথা। সেই জার্ডিনের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড ভারতে। এমন একটা সময়, যখন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ টালমাটাল। বিপ্লবের আগুনে নতুন স্বপ্নের ভোর দেখা শুরু করেছে ভারতবাসী। কলকাতা? শহর তিলোত্তমাই তো সেই বিপ্লবের আতুঁড়ঘর। ক্রিকেটের মায়াকাননে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ব্যাট-বলের যুদ্ধ জনমানসে তখন কৌতূহলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে একধাক্কায়। সেই আবহে ইডেনে প্রথম টেস্ট আয়োজিত হয় ১৯৩৪-এর ৫ জানুয়ারি। ভারতের মাটিতে যদিও সেটাই প্রথম টেস্ট নয়। ইডেন টেস্ট ছিল সিরিজের দ্বিতীয় দ্বৈরথ। তার আগে প্রথম টেস্ট আয়োজিত হয়েছিল বোম্বের (অধুনা মুম্বই) জিমখানা গ্রাউন্ডে। তারপর সময়ের চাকা নিজের গতিতে গড়িয়েছে। জিমখানায় আর কখনও আয়োজিত হয়নি কোনও টেস্ট। ইডেন সেই ইতিহাসের স্মারক ধরে রেখেছে সবুজ-হৃদয়ে। ক্রিকেটের নন্দনকানন তাই এখন দেশের সবচেয়ে পুরনো টেস্ট-কেন্দ্র।
আজকের ইডেন আর সেদিনের ইডেনের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। তফাত ময়দানেও। উত্তাল তিরিশে তখন ময়দান জুড়ে ফুটবল, হকির একচ্ছত্র দাপট। ব্রিটিশ আধিপত্যের প্রাচীর ভেঙে মোহনবাগান নামটা তখন আবেগের দ্যোতনা বহন করছে ফুটবল পাগল জনতার মনে। ভাবীকালের পথ ধরে উঠে আসছে ইস্টবেঙ্গল। মহামেডান? ’৩৪ থেকেই তো সাদা-কালোর স্বর্ণযুগের শুরু। ইডেন ছিল তখন অন্যরকম। অদূরে রুপোলি আঁচল বিছিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। তার পাশে অকল্যান্ড সাহেবের (লর্ড অকল্যান্ড) দুই বোন ‘মিস ইডেন’-এর পরম পরিচর্যায় গড়ে ওঠা কলকাতার ফুসফুস ‘অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন’, পরবর্তীতে যাকে মানুষ চিনবে ‘ইডেন গার্ডেন্স’ নামে। ১৮৬৪-তে সেই ইডেনে স্টেডিয়ামের গোড়াপত্তন। ১৮২৫ থেকে এখানে ক্রিকেট খেলতেও কোনও স্থায়ী মাঠ ছিল না ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের। স্থায়ী মাঠ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করে তারা। তখন থেকেই ইডেন তাদের দুর্গ। কিন্তু ১৮৬৪ থেকে ১৯৩৪ – দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও কোনও স্থায়ী গ্যালারি ছিল না ক্রিকেটের নন্দনকাননে। শীতের মরশুমে কাঠের গ্যালারিতে বসে ক্রিকেট উত্তাপ নেওয়াটাই ছিল দস্তুর।
তেমনই এক জানুয়ারির শীত-সকালে ২২ গজে বল গড়িয়েছিল ইডেনে। জিমখানায় জিততে না পারলেও জার্ডিনের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এক কুম্ভ হয়ে লড়ে গিয়েছিলেন লালা অমরনাথ। দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর শতরান হার না বাঁচাতে পারলেও মান বাঁচিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দলের। টেস্টে প্রথম ভারতীয় শতরানকারীকে পেয়েছিল দেশ। আর ইডেন দিয়েছিল ভারতীয় দলকে লড়াইয়ের দীপ্ত সাহস, প্রতিস্পর্ধা। নন্দনকাননে ভারতকে ফলোঅন করিয়েও টেস্ট জিততে পারেনি ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ড। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের ৪০৩ রানের জবাবে ২৪৭ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় ব্যাটিং প্রতিরোধ। বিজয় মার্চেন্ট, ওয়াজির আলিরা লড়েছিলেন, তবে ফলোঅন বাঁচাতে পারেননি। কিন্তু ফলোঅনের লজ্জা নয়, ইডেনের টেস্ট ভারত মনে রাখবে অভিষেক টেস্ট খেলতে নামা দিলাওয়ার হুসেনের জন্য। লাহোরের দিলাওয়ার সেদিন বুক চিতিয়ে লড়েছিলেন ক্লার্ক, নিকোলস,হেডলি সমৃদ্ধ ইংল্যান্ড পেস অ্যাটাকের বিরুদ্ধে। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর হার না মানা হাফসেঞ্চুরি ভারতের টেস্ট ড্রয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সময় ইংরেজ পেসার স্ট্যান নিকোলসের লাফানো বলে মাথায় আঘাত পান হুসেন। যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সেই যন্ত্রণা উপেক্ষা করেই টেলএন্ডার দিয়ে মহাকাব্যিক লড়াই করেছিলেন ভারতীয় উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। দুই ইনিংস মিলিয়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ১১৬ রান। জয়ের জন্য স্রেফ আধঘণ্টায় ৮২ রান করতে হত ইংল্যান্ডকে। মহম্মদ নিসার, অমর সিংদের দাপুটে বোলিংয়ের সামনে সেই সাহস দেখাতে পারেনি জার্ডিনের ইংল্যান্ড। ঔপনিবেশিক উপমহাদেশে এগারোজন ভারতীয় ক্রিকেটযোদ্ধার এই লড়াই কি নিতান্তই সাধারণ। মোটেই নয়। ইতিহাসের তুলাযন্ত্রে তা অমূল্য।
আসলে এটাই ইডেন। তিলোত্তমার ফুসফুস, সাহসের বীজমন্ত্র দিয়েছে তার সন্তান, ক্রিকেটযোদ্ধাদের। তাই তো এককালের হুসেন ফিরেছেন কখনও বিশ্বনাথ হয়ে, কখনও আবার ভিভিএস লক্ষ্ণণরূপে। ক্রিকেট মহাযজ্ঞে তাদের আসা-যাওয়া শাশ্বত। জাতিস্মরের বেদিতে তাদের আবাহন করেছে ইডেন, করেছে ইডেনের ক্রিকেটপ্রেমী জনতা। একরাশ মুগ্ধতার ডালি নিয়ে।
শহরটা কিন্তু বদলাচ্ছে। প্রতিটি চুম্বনের সঙ্গে শহরটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। আর যত দিন যাবে, এই পরিবর্তনের কাহিনি আরও লেখা হবে।তোমাদের ভদ্রলোক-সংস্কৃতির দেওয়ালে ফাটল ধরছে, আর এই ফাটলের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসা।