ম্যাথিউ ডসন। যিনি হয়তো খেলার আসরের লোকগাথার জগতে চিরকালীন আসন করে নিলেন। অস্ট্রেলিয়া হকি দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়। গতবারের টোকিও অলিম্পিকে অস্ট্রেলিয়ার রুপো জয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। কী করেছেন তিনি? কয়েক দিন আগে খেলতে গিয়ে তাঁর ডান হাতের অনামিকা বা ‘রিং ফিঙ্গার’ ভেঙে গিয়েছিল। চোট গুরুতর। এদিকে সামনেই অলিম্পিক। মাঠে নামতে মরিয়া ম্যাথু ছুটলেন চিকিৎসকদের কাছে। তাঁরা দিয়েছিলেন দুটো বিকল্প। এক, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে চোটমুক্তি। হয়তো অনেকেই সে পথে হাঁটতেন। কিন্তু তিনি ম্যাথু ডসন বেছে নিয়েছেন দ্বিতীয় বিকল্প। কী সেটা? দ্রুত টার্ফ-এ ফিরতে আঙুলের অনেকটা অংশ কেটে বাদ দিয়েছেন তিনি।
হাল ছেড়ো না বন্ধু। সেই কবেই গেয়েছিলেন কবীর সুমন। তা প্রবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছে গত কয়েক দশকে। জীবনে, খেলার মাঠে– প্রতিদিন– তার উদাহরণ ফিরে ফিরে আসে। জীবনকে প্রভাবিত করে খেলা। খেলাও প্রভাবিত করে জীবনকে। টিকে থাকার, লড়ে যাওয়ার মানে বেঁচে থাকা। নিজেকে প্রমাণিত করা। “যদি না জিততে পারো তো জিতো না, কিন্তু তুমি হেরেও যেও না তা’ বলে।”– এই বাক্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ভাস্কর চক্রবর্তীর গদ্যবই ‘শয়নযান’। এই চিন্তার স্রোত খেলার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে পড়ে জীবন-মহাসাগরে।
খেলার জগতে লড়াইয়ের কথা উঠলেই অবধারিত কানে ভাসবে মতি নন্দীর খিদ্দার সেই বজ্রনির্ঘোষ, ‘ফাইট, কোনি ফাইট’। যতই তা সে কাল্পনিক চরিত্র হোক না কেন, লড়াইয়ের মূর্ত প্রতীক এই শব্দবন্ধ। আর মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের কথা উঠলে ভেসে ওঠে আর একজনের মুখ। চিরকালের ‘ফাইটার’ বড়ে মিঞা মহম্মদ হাবিব। যাঁকে ‘বর্ন ফাইটার’ মনে করতেন গৌতম সরকার। সাতের দশকের আমি ফুটবল ভক্তের কাছে লড়াইয়ের প্রতিরূপ। যিনি প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কাড়তে গিয়ে বহুবার অকুতোভয়ে বুটের সামনে মাথা পেতে দিয়েছেন। ১৯৭৭ সালে ইডেনে পেলের কসমস ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলা। ফুটবল সম্রাটের সঙ্গে ছবি তুলতে হামলে পড়েছেন সতীর্থ ফুটবলাররা। ব্যতিক্রম তিনি। কেন? তাঁর সাফ জবাব, ‘আয়সা কিউ? উও ভি প্লেয়ার, হাম ভি প্লেয়ার।’ যা কার্যত কলকাতা ময়দানে লোকগাথা হয়ে গিয়েছে।
১৯৮৪ সালের হেডিংলি টেস্টে ক্রিস ব্রডের শট আটকাতে গিয়ে বাঁ-হাতের আঙুলে চির ধরে ম্যালকম মার্শালের। সেই অবস্থায় এক হাতে ব্যাট করে ল্যারি গোমসকে সঙ্গ দেন। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় ইনিংসে বাঁ-হাত কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজ জড়িয়ে বল করে ৫৩ রানে ৭ উইকেট নেন তিনি। ২০০২ সালে অ্যান্টিগা টেস্টে ভাঙা চোয়াল নিয়ে বল করেছিলেন অনিল কুম্বলে। আউট করেন ব্রায়ান লারাকে। ২০০৯-এ ব্রিস্টলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পায়ের পাতা ভেঙে গেলেও ব্যাট করেন ইংল্যান্ডের ইয়ান বেল। সে বছরেই সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ বাঁচাতে ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাট করেন গ্রেম স্মিথ। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ বাঁচাতে না পারলেও তাঁর সেই ইনিংস ক্রিকেট ভক্তদের মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছে।
শুধু ফুটবল বা ক্রিকেট নয়, এভাবেই যুগে যুগে খেলার দুনিয়ার আলোড়ন তৈরি করেছেন অসংখ্য প্লেয়ার। কে ভুলতে পারে উলমা রুডলফকে! মাত্র চার বছর বয়সে পোলিওর শিকার। লাঠি ছাড়া চলতে পারবেন না, বলেছিলেন ডাক্তাররা। সেই উলমা ১৯৬০-এর অলিম্পিকে তিনটি সোনা জেতার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করে সবাইকে চমকে দেন।
আর কয়েক দিন পরেই শুরু হবে প্যারিস অলিম্পিক। অংশ নেবেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় দশ সহস্রাধিক ক্রীড়াবিদ। যাঁদের অধিকাংশ ‘চ্যাম্পিয়ন তৈরির কারখানা’গুলো থেকে তৈরি হয়ে এসেছেন। তাঁরা কি প্রত্যেকেই পদক জিতবেন? সকলেই কি ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর মঞ্চ থেকে কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারবেন? না, তা তো সম্ভব নয়। কেউ কেউ হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি। যেমন, পাভো নুরমি, এমিল জ্যাটোপেক, কার্ল লুইস, মাইকেল ফেল্পস, মার্ক স্পিটজ, ডালে থম্পসন, জ্যাকি জয়নার কার্সি, উসেইন বোল্ট, উলমা রুডলফ, ফ্যানি ব্ল্যানকার্স কোয়েন, কেটি লেডেকিরা।
বাকিদের চেয়ে কোথায় আলাদা এই কিংবদন্তিরা? অবশ্যই ব্যক্তিগত দক্ষতায়, স্কিলে। মানসিকতায়। নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার ক্ষমতায়। সাহসে। এবং সর্বোপরি ডেডিকেশনে। যে খেলার সঙ্গে তিনি বা তাঁরা যুক্ত, তাতে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছনোর জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তার জন্য যে কোনও আত্মত্যাগ করতে সদা প্রস্তুত। যার অনবদ্য নজির তৈরি করলেন ম্যাথিউ ‘ম্যাট’ ডসন। যিনি হয়তো খেলার আসরের লোকগাথার জগতে চিরকালীন আসন করে নিলেন। যাঁর কীর্তি শুনলে গায়ের রোম খাড়া হয়ে যেতে বাধ্য। অস্ট্রেলিয়া হকি দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়। গতবারের টোকিও অলিম্পিকে অস্ট্রেলিয়ার রুপো জয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। কী করেছেন তিনি?
কয়েক দিন আগে খেলতে গিয়ে তাঁর ডান হাতের অনামিকা বা ‘রিং ফিঙ্গার’ ভেঙে গিয়েছিল। চোট গুরুতর। এদিকে সামনেই অলিম্পিক। মাঠে নামতে মরিয়া ম্যাথু ছুটলেন চিকিৎসকদের কাছে। তাঁরা দিয়েছিলেন দুটো বিকল্প। এক, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে চোটমুক্তি। হয়তো অনেকেই সে পথে হাঁটতেন। কিন্তু তিনি ম্যাথু ডসন বেছে নিয়েছেন দ্বিতীয় বিকল্প। কী সেটা? দ্রুত টার্ফ-এ ফিরতে আঙুলের অনেকটা অংশ কেটে বাদ দিয়েছেন তিনি। কারণ, দেশের হয়ে অলিম্পিকে নামা তাঁর অগ্রাধিকার। স্ত্রী বলেছিলেন, তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত না নিতে। কিন্তু ডসন মনে করেছেন, তাঁর সামনে দুটো বিকল্প সম্পর্কে চিকিৎসকরা যথেষ্ট তথ্য দিয়েছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিশেষ সময় ছিল না। তাই দেশের স্বার্থে ‘আঙুল বলিদান’ই একমাত্র উপায়। ‘কোকাবুরা’ দলের কোচ কলিন বাখ মনে করেন, ‘প্যারিস অলিম্পিকে খেলার দায়বদ্ধতা থেকে ও এটা করেছে। তবে ওর জায়গায় আমি থাকলে বোধহয় এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না।’
…………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: না হাসি তো ফাঁসি
………………………………………………………………………………
চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় তৈরি করা যায় না। তাঁরা নিজেরাই তৈরি হন। ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা, ব্যক্তিগত মুনশিয়ানা নৈপুণ্যে আর পাঁচ জনকে পিছনে ফেলে তাঁরা উঠে আসেন শীর্ষে। একক ইভেন্ট হোক বা দলগত, তাঁদের সাফল্যের দীপ্তি বিচ্ছুরিত হতে থাকে এমনই যে, অন্যদের থেকে সহজেই তাঁদের আলাদা করা যায়। এভাবেই সতীর্থদের চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে থেকেছেন ধ্যানচাঁদ, পেলে, মারাদোনারা। আবার নিজেদের ইভেন্টে জেসি ওয়েন্স, মহম্মদ আলি, মাইকেল ফেল্পসরা। এঁদের কেউ কেউ উচ্চকিত স্বরে ঘোষণা করেছেন, ‘তিনিই সর্বোত্তম’। আবার কাউকে হৃদয়ের সিংহাসনে ‘গ্রেটেস্ট’-এর আসন দিয়েছে আমজনতা। এই সমস্ত কিংবদন্তির উজ্জ্বল উপস্থিতি সত্ত্বেও কিন্তু পৃথক মর্যাদার আসন পেয়ে থাকেন ‘ফাইটার’রাও। যাঁদের মরণপণ লড়াই বহু ম্যাচের রং বদলে দেয়। যাঁরা না থাকলে বিশ্ব ক্রীড়ার ইতিহাস এতটা রঙিন হত না, সম্পূর্ণ হতে পারে না।
রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে পশুর সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করা গ্ল্যাডিয়েটর বা দেশ-দশের সম্মান রক্ষায় অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া নাইটরা যে সহর্ষ অভিনন্দন পেতেন, খেলার জগতের এই ফাইটাররা তাঁদের চেয়ে কোন অংশে কম? প্রতিবারের মতো এবারও অলিম্পিক হকিতে পদক জয়ের অন্যতম ফেভারিট অস্ট্রেলিয়া। অজি দল যখন মাঠে নামবে, দর্শকদের বিপুল করতালি তাঁদের স্বাগত জানাবে। কিন্তু একটু বেশি করতালি, উল্লাস ও অভিনন্দন কি পাবেন ম্যাট ডসন? অবশ্যই এটা তাঁর প্রাপ্য। কারণ, তিনি সতীর্থদের চেয়ে, অন্য অনেকের থেকে আলাদা। বিরল ‘ফাইটার’ গোত্রের। অলিম্পিকে পদক আসুক বা না আসুক, ‘গ্রেট’দের তালিকায় তাঁর আসন পাকা। অনেকটা বাদ পড়া আঙু্ল নিয়ে ইতিহাস লিখতে তাঁর আশা করি, কোনও সমস্যা হবে না।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………