টেনিস ব্রহ্মাণ্ডের আসল আশ্চর্য তো তিনি নিজেই, খোদ নোভাক জকোভিচ। যাঁর বর্ণনায় নিক কিরঘিয়সের মতো টেনিসের ‘অবাধ্য ঘোড়া’ও নতশিরে বলতে বাধ্য হন, ‘দ্য আল্টিমেট ওয়ারিয়র’! অথচ কী আশ্চর্যের ব্যাপার, এই তো সেদিন, মাসদুয়েক আগে, উইম্বলডন ফাইনালে কার্লোস আলকারাজ নামক এক তরুণ্যে ভরপুর টেনিস ক্ষত্রিয়ের কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ‘জোকারের’ ললাট লিখন পড়ে ফেলেছিল তামাম টেনিস দুনিয়া।
নায়কোচিত ধীরোদাত্ত গুণ তাঁর জন্য নয়। প্রতিনায়কের স্বভাবসুলভ ঔদার্য তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বেমানান। টেনিসবিশ্বে তাঁর আবির্ভাব অনেকটা যোদ্ধার মতো। তাঁর কাছে টেনিসের ওই চতুর্ভুজীয় কোর্ট আসলে লড়াইয়ের রঙ্গমঞ্চ। সে সবুজ ঘাসে ঢাকা হোক, কিংবা লাল সুরকিতে রাঙানো। কিংবা হোক হার্ড কোর্টের পেলবতায় মোড়া। সেই বধ্যভূমিতে তিনি কেবল লড়তে জানেন। স্রেফ লড়তে জানেন, পরশুরামের কঠোর কুঠারের মতো উদ্ধত টেনিস র্যাকেট বজ্রমুষ্টিতে ধারণ করে।
নোভাক জকোভিচ আদপে তাই। তাঁর অস্থিমজ্জার অন্তঃসলিলে যেন এক ‘সামুরাই’ সদাজাগ্রত। জয় ছাড়া তাঁর তৃষ্ণা মেটে না। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে মার্গারেট কোর্টের গড়া ২৪টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের শৃঙ্গে যে তাই পা রাখবেন জকোভিচ, এতে আর আশ্চর্যের কী!
কিন্তু টেনিস ব্রহ্মাণ্ডের আসল আশ্চর্য তো তিনি নিজেই, খোদ নোভাক জকোভিচ। যাঁর বর্ণনায় নিক কিরঘিয়সের মতো টেনিসের ‘অবাধ্য ঘোড়া’ও নতশিরে বলতে বাধ্য হন, ‘দ্য আল্টিমেট ওয়ারিয়র’! অথচ কী আশ্চর্যের ব্যাপার, এই তো সেদিন, মাসদুয়েক আগে, উইম্বলডন ফাইনালে কার্লোস আলকারাজ নামক এক তরুণ্যে ভরপুর টেনিস ক্ষত্রিয়ের কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ‘জোকারের’ ললাট লিখন পড়ে ফেলেছিল তামাম টেনিস দুনিয়া। দাঁড়ি টেনে দিয়েছিল বিদগ্ধ টেনিসকুল ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ী সার্বিয়ানের কেরিয়ারের সোনালি অধ্যায়ে।
আড়াল থেকে কি সেদিন মুচকি হেসেছিল নোভাকের ভাগ্যলক্ষ্মী? নাকি হেসেছিলেন স্বয়ং জকোভিচ? ২৪ তমের আগে শেষ ২৩ গ্র্যান্ড স্ল্যামের সবক’টি তো অর্জন করেছেন সেই সময়, যখন প্রখর রুদ্রের মতো টেনিস-ভুবনে বিরাজ করছেন রজার ফেডেরার, মধ্যাহ্নের দীপ্তি উপচে পড়ছে রাফায়েল নাদালের খেলায়। সেই রাফা-রজার যুগেও সমান্তরালভাবে সাফল্যের স্বতন্ত্র ছায়াপথ তৈরি করেছেন জকোভিচ।
নোভাক খুব ভাল করেই জানেন, ফেডেরারের শৈল্পিক আভিজাত্য তাঁর নেই। নাদালের টপস্পিনের নান্দনিকতা কিংবা গতির সংমিশ্রণও তাঁর খেলায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রতিভার বিপরীতে দাঁড়িয়ে পরিশ্রম আর হার না মানা মনোভাবই হয়েছে ‘জোকারের’ সাফল্যের যষ্টিদণ্ড। নিজ অধ্যবসায়ে কালক্রমে ফেডেরার-নাদালের মতো যে ধ্রুবতারাদের ছাপিয়ে গিয়েছেন জকোভিচ, সেই সার্বিয়ানকে নিয়ে এত সহজে কি শেষ কথা বলে দেওয়া যায়? যায় না। কারণ অদম্য লড়াইটা যে জকোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বেড়ে ওঠার সেই আশৈশবে রক্তস্নাত হতে দেখেছেন তাঁর দেশমাতৃকা, যুদ্ধবিধ্বস্ত সার্বিয়াকে। বেঁচে থাকার তাগিদে প্রাণপাত জীবন সংগ্রামই হয়ে উঠেছে জকোভিচের জীবনের বীজমন্ত্র। তাই বিপর্যয়ের চিতাভস্ম থেকে সাফল্যের অন্তরিক্ষে স্কাইলার্ক হয়ে ফিরেছেন নোভাক। ব্যর্থতার দহনজ্বালা তাঁকে মুহ্যমান করতে পারেনি, চোট তাঁকে পারেনি দমিয়ে রাখতে। তিনি অফুরান প্রাণশক্তি নিয়ে বারবার ফিরে এসেছেন, প্রতিভাত হয়েছেন স্বমহিমায়।
কিন্তু সব ভাল-র যে শেষ আছে। কালের অমোঘ নিয়মে ফেডেরার আজ ‘প্রাক্তন’। নাদাল-সূর্য অস্তমিত প্রায়। শুধু অস্তরাগের অলক্তরাগ হয়ে এখনও সাফল্যের আঙিনায় আলপনা এঁকে চলেছেন ৩৬-এর নোভাক। কিন্তু কতদিন? উত্তর হল, যতদিন জকোভিচ নিজেকে এভাবে উজাড় করে দেবেন, ঠিক ততদিন।
সেই পরিসরে টেনিস অনুরাগী হিসাবে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কী? শুধু একটাই। জকোভিচের সাফল্যে রাঙানো প্রতিটি মহাজাগতিক দৃশ্য চাক্ষুষ করে যাওয়া। কে না জানে, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’