ভারত টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করে এবং রোহিত শর্মার প্রাথমিক হাল্লাবোলের পরে তিন উইকেট হারিয়ে যখন বিরাট কোহলি এবং কে এল রাহুল ইনিংস পুনর্নিমাণের কাজ করছেন– এমন সময় দেখা গেল, এক হাফপ্যান্ট সাদা টিশার্ট পরিহিত ব্যক্তি হাতে প্যালেস্তাইনের পতাকা নিয়ে মুখে প্যালেস্তাইনের পতাকা ছাপা মাস্ক পরে সুরক্ষা বলয় পেরিয়ে মাঠে ঢুকে সোজা বিরাট কোহলির দিকে ছুটে যাচ্ছেন। টিশার্টে স্লোগান ‘প্যালেস্তাইনে বোমাবাজি বন্ধ করো’ আর ‘প্যালেস্তাইনকে মুক্তি দাও’।
দু’বছর আগে, ইউক্রেনের ন্যাটোর (NATO) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধ এখনও চলেছে। যুদ্ধের রাজনীতির মধ্যে না ঢুকেও বলা যায়, এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। ইউক্রেনের নাগরিকদের কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি, কিন্তু তার সঙ্গে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট এবং জ্বালানি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রকোপ, তা সারা পৃথিবীর ওপরেই পড়ছে।
গত ৭ অক্টোবর, ২০২৩ প্যালেস্তাইনের উগ্রপন্থী সংগঠন হামাস হঠাৎ ইজরায়েলের দক্ষিণ প্রান্তে পরের পর মিসাইল আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে হামলা চালায়। বেসরকারি সূত্রে খবর যে, তাতে প্রায় ১৪০০ সাধারণ ইজরায়েলি নাগরিকের মৃত্যু হয়। জবাবে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা অঞ্চলকে লক্ষ্য বানায় ইজরায়েল। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘরে-বাইরে চাপের মধ্যে রণহুংকার ছাড়তে থাকেন। এবং অবশেষে মাত্র দিন দুই-তিন সময় দিয়ে গাজার উপর দানবিক হামলা শুরু হয়। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৪০০০ প্যালেস্তিনীয় মারা গেছেন ইজরায়েলের আক্রমণে। হাসপাতাল, স্কুল– কিছুই বাদ রাখা হচ্ছে না কারণ, হামাস নাকি প্যালেস্তিনীয় সাধারণ মানুষদেরই মানবিক ঢাল বানিয়ে রেখেছে। হামাসকে খতম করতে গেলে কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসাবে সাধারণ মানুষের বলি আবশ্যক।
এসবের মধ্যেই সারা পৃথিবীর ক্রীড়া সংস্থা, বিশেষত ‘ফিফা’ বা ‘আইওসি’ রাশিয়াকে বিশ্বকাপ ফুটবল বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া থেকে বহিষ্কার করে। যদিও আইওসি, ডোপিং সংক্রান্ত বিষয়ে রাশিয়াকে ইতোমধ্যেই বহিষ্কার করেছিল। যদিও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ফুটবলের ইউরো যোগ্যতা অর্জনকারী খেলাগুলিতে রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার সহযোগী বেলারুশ বা ইজরায়েলকে বহিষ্কার করার কোনও কথা শোনা যায়নি।
উপরন্তু ইংলিশ এফএ তাদের কাউন্সিলের সদস্য ওয়াসিম হককে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ট্যুইট করার জন্য সাসপেন্ড করেছে। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’ তাদের ছ’জন সাংবাদিককেও সাসপেন্ড করেছে। পশ্চিমি দেশগুলির যুদ্ধ সম্পর্কিত এমন দ্বিচারিতা তো রয়েইছে।
কিন্তু ভারত কী করছে? ভারত সরকারিভাবে রাশিয়ার ইউক্রেন হানার প্রতিবাদ করেনি, শুধুমাত্র ‘যুদ্ধ কারওরই ভালো করে না’ ধরনের একটি বার্তা দিয়ে দায় সেরেছিল। আর একই কথা হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধের ক্ষেত্রেও করেছে। অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বিতর্কিত পেগাসাস সফটওয়্যার ইত্যাদি সম্পর্কিত কারণে সাম্প্রতিক কারণে ইজরায়েলের সঙ্গে বেশ একটা মাখোমাখো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আর ইজরায়েল বা অন্যান্য চরম দক্ষিণপন্থীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হওয়ায়, উদ্বাস্তু সংক্রান্ত ভারতের দীর্ঘদিনের মনোভাবও বোধহয় পরিবর্তিত হয়েছে। মায়ানমারের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সরাসরি ‘উগ্রপন্থী’ বলে দিতেও ভারত পিছপা হয় না।
এ এক নতুন ভারত। তার পরিচয় সে পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত ‘ইন্ডিয়া’ নয়, প্রাচীন ইতিহ্যের প্রতিভূ। যে নাকি গণতন্ত্রের গর্ভগৃহ, সমানাধিকারের আকরস্থান। অবশ্য সমানাধিকার নিয়ে সরকারিভাবে অন্য ব্যাপার সামনে চলে আসে। জাতি, ধর্ম, স্থানিকতা তো ছেড়ে দিলাম। লিঙ্গ বৈষম্যের প্রমাণ হিসাবে উভলিঙ্গ মানুষ বা সমলৈঙ্গিক সম্পর্ককে ভারত পারলে অস্বীকার করে। প্রাচীন ভারতের শিক্ষায় দীক্ষিত নতুন ভারতে এগুলি মানসিক বা শারীরিক রোগের নামান্তর।
নবীন ভারতে স্বাধীনতা ২০১৪ সালে এসেছে এবং ভরকেন্দ্র আর নতুন দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা বা চেন্নাইয়ের মতো মহানগর নয়। নবীন ভারতের প্রশাসনিক এবং সামাজিক মডেল তৈরি হয় গুজরাত থেকে অথবা আরও স্পষ্ট করে বললে, গুজরাতের প্রধান শহর আহমেদাবাদ থেকে।
সেই আহমেদাবাদের বুকে নবীন ভারতের বাস্তবোত্তর ছাতির মাপে এক স্টেডিয়াম গঠন করা হয় আগের মোতেরা বা সর্দার প্যাটেল স্টেডিয়াম ধ্বংস করে আনুমানিক ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামে নামকরণ। এবং কোনওরকম ক্রীড়া-ঐতিহ্য না থাকলেও ২০২৩-এর পুরুষদের ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল স্থির করা হয় এই স্টেডিয়ামেই।
আর ১৪০ কোটি মানুষের আশা-ভরসাকে সম্মান জানিয়ে ভারত ফাইনাল খেলতে মুখোমুখি হয় শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার, যারা প্রথম দু’টি ম্যাচ হেরেও টানা আটটি ম্যাচ জিতে ফাইনাল খেলছে।
এই অবধি সব ঠিক। চিত্রনাট্য, মঞ্চ প্রস্তুত। ভারত টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করে এবং রোহিত শর্মার প্রাথমিক হাল্লাবোলের পরে তিন উইকেট হারিয়ে যখন বিরাট কোহলি এবং কে এল রাহুল ইনিংস পুনর্নিমাণের কাজ করছেন– এমন সময় দেখা গেল, এক হাফপ্যান্ট সাদা টিশার্ট পরিহিত ব্যক্তি হাতে প্যালেস্তাইনের পতাকা নিয়ে মুখে প্যালেস্তাইনের পতাকা ছাপা মাস্ক পরে সুরক্ষা বলয় পেরিয়ে মাঠে ঢুকে সোজা বিরাট কোহলির দিকে ছুটে যাচ্ছেন। টিশার্টে স্লোগান ‘প্যালেস্তাইনে বোমাবাজি বন্ধ করো’ আর ‘প্যালেস্তাইনকে মুক্তি দাও’। অবশ্যই কিছুক্ষণের মধ্যে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন।
এই ব্যক্তির নাম ওয়েন জনসন, অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা এবং টিকটক ভিডিও করে পরিচিত। কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মহিলাদের ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালেও ওয়েন পুতিনকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে বানানো এক টি-শার্ট পরে ইউক্রেনের সমর্থনে নেমে পড়েছিলেন এবং অনেকবারই এরকম করেছেন। ব্রিসবেনের কাছেই টুয়ং গ্রামের বাসিন্দা, ‘পাজামা ম্যান’ বলে টিকটক দুনিয়ায় পরিচিত ওয়েন। এক মিনিটের রিল আর পরিচিতি ওয়েনের জীবন। বন্ধুহীন, অন্তর্মুখী ওয়েন কিন্তু ইন্টারনেটে ‘সেলিব্রিটি’। নিত্যনতুন স্টান্টই তাঁর জীবনের রসদ।
কিন্তু যাই উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, বর্তমান ভারতের নির্লজ্জ বৈভব ও শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিপীড়িতদের কথা বলে তিনি এখন হয়ে গেছেন এক আপামর ভবিষ্যতের অন্ধকার দিনের চিন্তায় কাতর জনগোষ্ঠীর নায়ক। যাঁকে সিস্টেম বেঁধে ফেলতে পারে, কিন্তু ভেঙে ফেলতে পারে না।
আসলে আমাদের যে সমস্ত লড়াই আমরা সাহস করে লড়ে উঠতে পারি না, সেই লড়াই যদি আমাদের সামনে কেউ লড়ছে বলে উপস্থিত হয়, তাহলে তাদের আমরা হৃদয় সিংহাসনে স্থান দিই। এভাবে রাজনীতি চলে, এভাবেই বোধহয় সিনেমা, ক্রিকেট আর শিল্প– সবই চলে।
ওয়েন জনসনরা জানেন কী করলে আলোচনায় আসতে পারবেন। সমাজে তাঁরা আদৃত না হলেও আন্তর্জালে তাঁর পূজ্য। কিন্তু আমরা! দিন আনি দিন খাইয়ের পৃথিবীতেও স্বপ্ন দেখতে গিয়ে বারবার ঝটকা খেয়েও মানুষ স্বপ্ন দেখে সবার জন্য সমানাধিকারের। আর এই স্বপ্ন যারা বাস্তবে জিইয়ে রাখে, তাদেরকেই মানুষ রাখে মাথায় তুলে। রাষ্ট্রযন্ত্র যতই গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসুক না কেন, স্বপ্নে তো শিকল ছেড়া রামধনু আমরা।
মজার বিষয়, শ্যাম বেনেগাল যখন হঠাৎই 'বোস: দ্য ফরগটেন হিরো' বানাচ্ছেন, এনডিএ আমলের শেষ ও ইউপিএ আমলের শুরুর আবহে, তার আশপাশে ভগৎ সিংয়ের গোটা দুই বায়োপিক মুক্তি পেয়ে গেছে, একটিতে নায়ক অজয় দেবগণ, অন্যটিতে সানি দেওল। অজয় দেবগণ অভিনীত বায়োপিকটিই বেশি স্মর্তব্য হয়ে রইল, সানি দেওলের 'ঢাই কিলো কা হাত' এক্ষেত্রে অকেজো হয়ে গেল।