Robbar

জয় যখন উপশম, সোনার পদকের চেয়েও কাঙ্ক্ষিত

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 16, 2024 7:21 pm
  • Updated:August 16, 2024 7:21 pm  

বাইলসের এই সময়ে কী মনে হয়েছিল? আর পাঁচটা কামব্যাক স্টোরিতে বহিরাগত প্রতিকূলতা থাকে, এক্ষেত্রে তাঁর লড়তে হয়েছিল তাঁর নিজেরই মনের সঙ্গে। যে লড়াই বিশ্বের কোটি কোটি ক্যামেরা-ফ্ল্যাশলাইটের অগোচরে। নিঃশব্দে। একাকী। ক্রিকেটে ঋষভ পন্থের ফিরে আসার আগে রিহ্যাব সেশন, লিওনেল মেসির ফিরে আসার আগে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে যে কথিত চিত্রনাট্যের টুকরো সাজানো থাকে, সে কাহিনিবৃত্ত সম্পূর্ণ হতে পারে না সিমোনের ক্ষেত্রে।

অর্পণ গুপ্ত

প্যারিসে সিমোনে বাইলস ফিরলেন। ২৭  বছরের কিঞ্চিৎ পরিণত-শান্ত বাইলসের ফিরে আসা কোথাও গিয়ে ১৯ বছরের অপরিণত জলোচ্ছ্বাসের মতো আসা সে স্মৃতিকে উশকে দিল, ফিকে করল না, অথচ তার পাশে গড়ে নিল স্বতন্ত্র এক অবস্থান। এই ফিরে আসার জলের দাগ মেখে থেকে যাবে মাঝের সুদীর্ঘ অধ্যায়খানা– সিমোনে তখন তারকা, অলিম্পিকে মার্কিনিদের সবচেয়ে উজ্জ্বল পোস্টার গার্ল– ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে জিমন্যাস্ট দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণের পর যে কলোসাস ইমেজ তিনি গড়ে তুললেন মঞ্চে। তাঁর দু’হাত ছড়ানো উদ্ধত পদচারণা– অকল্পনীয় রুটিন, নিটোল সুইং– যা দেখে থমকে যেতে হয়েছিল ভাষ্যকারদের। সেই সবটুকু নিয়েই দস্তান হয়ে ছিলেন বাইলস; শুধু তো গ্রেস বা এলিগেন্স না– স্ট্যাটিস্টিক্সও একেবারে ইমারত গড়ে দিল তাঁর সপক্ষে।

রেকর্ড বলছে রিও অলিম্পিকে তিনটি সোনা ও একটি ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন তিনি। আমেরিকা তো বটেই, সমগ্র বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জিমন্যাস্ট তিনিই কি না, তাই নিয়ে শুরু হয়েছিল তরজা! ভেবে দেখা জরুরি, এ তরজা যে সময়ে শুরু হয় তখনও বাইলসের ঝুলিতে মাত্র একটি অলিম্পিক অভিজ্ঞতা। মার্কিনি বাজার-পুঁজিবাদের আঁতুড়ঘরে এহেন সিমোনে বাইলস যে রাতারাতি সর্বোচ্চ বিপণনযোগ্য প্রোডাক্ট হবেন, এ তো নতুন কিছু নয়! সত্যিই রিও অলিম্পিকের পর সিমোনে বাইলস হয়ে উঠলেন মহাতারকা। পত্রিকার প্রচ্ছদে, আমেরিকার বড় কনফারেন্সে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ড আম্বাসাডার হিসেবে উঠে আসছে একটাই নাম: সিমোনে বাইলস। যথারীতি এ বাজার তাঁর কাছে সাজিয়ে চলেছিল প্রত্যাশার পাহাড়।

Gymnastics-Simone Biles' unexpected Tokyo story | Reuters

কোভিডকালে টোকিও অলিম্পিকে কার্যত মার্কিন বাজারে বেটিং শুরু হয়েছিল বাইলস কতগুলি সোনা জিতবেন এই নিয়ে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাইলস প্রথম ভল্টের সময়ে আড়াই ট্যুইস্টের বদলে দেড় ট্যুইস্ট দিলেন এবং কোনওরকমে ল্যান্ড করলেন! বিশ্ব হতবাক– সে ক্ষণিকের স্তব্ধতা আরও বাড়ল যখন বাইলস ঘোষণাই করে দিলেন যে, তিনি আর টোকিওতে নামবেন না এবং সেই প্রত্যাহারের কারণ কোনও চোট নয়। তাঁর স্পষ্ট কথা, তিনি মানসিক কারণে নামছেন না। শূন্যে থাকার সময়ে তাঁর পায়ের অবস্থান বুঝতে পারছেন না তিনি। মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হচ্ছে। চোট লাগতে পারে। দেশের হয়ে পদকজয়ের প্রশ্নে তিনি কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। যে বিরাট বুদ্বুদের জন্ম দিয়েছিল বাজার, আচমকা তা ফাটল। বাইলস এই প্রথম আছড়ে পড়লেন বাস্তবের মাটিতে, মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে অলিম্পিকে এক নাম্বার জিমন্যাস্টের নাম প্রত্যাহার? সত্যি? প্রবল প্রগতিশীল ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার অন্দরেই কার্যত ব্রাত্য করে দেয়ার চেষ্টা হল বাইলসকে, মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার কথা বলে যেন অপরাধী হয়ে গেলেন বাইলস– আর তাঁর সোনার মুকুট পড়ল ধুলোয়।

ব্যক্তিগত জীবনে এন এফ এল তারকা জোনাথান ওয়েন্সের সঙ্গে প্রেম নিয়েও ভেসে আসছে পারিপার্শ্বিক কটূক্তি। সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা হল বাইলস টোকিও থেকে পালাচ্ছেন। এ সম্ভাবনাও গাঢ় হতে লাগল যে, এক অলিম্পিকের বিস্ময় হয়েই সম্ভবত কেরিয়ার শেষ করবেন বাইলস- কিন্তু ওই যে, বাংলা ছবির সে চেনা সংলাপ ‘বড় প্লেয়ারের আসল পরীক্ষা জিতে আসায় নয় ফিরে আসায় হয়’– সে মান্দাসে ভর করে প্যারিসে ফিরলেন সিমোনে বাইলস, আর শুধু ফিরলেনই না, জিতলেন তিন তিনটে সোনা– সিমোনে বাইলসের লড়াইয়ের বৃত্ত সম্পূর্ণ হল প্যারিসে। ৩০ খানা বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের মেডেল থাকলেও কোথাও গিয়ে সিমোনেকে প্রমাণ করতে হত ২০১৬-র রিও কোনও ফ্লুক ছিল না। রিও অলিম্পিকের চারখানা সোনার ক্রুশকাঠ নিয়ে বাইলস এসেছিলেন প্যারিসে।

প্যারিসে সোনা জয়ের পর সিমোনের বলা কথাগুলো আমাদের মনে রাখা জরুরি। সিমোনে বলছেন, আমার কাছে এই জয় ইউফোরিয়া না, কোনও উচ্ছ্বাস না, বরং আমার কাছে উপশম।

Olympics 2024: Simone Biles wins stunning gold in women's all-around gymnastics final | Olympics News | Sky Sports

বার্তাটি বহুমাত্রিক– প্রত্যাবর্তনের যে টেমপ্লেটকে বিশ্ব কার্যত শ্রেষ্ঠ ছাঁচ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে– সে রকি কিংবা ক্যারাটে কিডের মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে নায়কের ওপর এসে পড়া তিনভুবনের ভারকে ক্লাইম্যাক্সে সে ভাসিয়ে দিয়েছে সাফল্যের হাওয়ায় সেই ছাঁচের থেকে সিমোনে বাইলসের লড়াই ছিল একেবারে ভিন্ন। প্রথমত, বাইলসের বিরুদ্ধে ওঠা আঙুল শুধু টোকিওর ব্যর্থতার কারণে ওঠেনি, উঠেছিল সামাজিক রক্ষণশীলতার অন্ধকার থেকে, যেখানে রাষ্ট্রের পুতুল করে রাখতে চাওয়া অ্যাথলিটদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ফুৎকারে নস্যাৎ করে দিতে পারে সমাজ। ব্যক্তিজীবনে সিমোনের প্রেম হয়ে উঠেছিল চর্চার বিষয়, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ জিমন্যাস্টদের মুখ হয়ে ওঠা সিমোনেকে শুনতে হয়েছে বর্ণবৈষম্যমূলক কটূক্তি– সিমোনে বাইলস যে বাজারের মুখ হয়ে উঠেছিলেন, বা বলা ভালো যে বাজার তাঁকে গড়ে তুলেছিল বিপণনযোগ্য পোস্টার হিসেবে সে বাজারই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে টোকিও অলিম্পিকের পর। তাই তাঁর প্রত্যাবর্তনের কিসসার সামনে নতজানু হয়ে থাকে এক বিরাট সামাজিক তত্ত্ব।

When is Simone Biles' next event? Updated schedule, times for USA gymnastics star at 2024 Olympics | Sporting News

বাইলসের এই সময়ে কী মনে হয়েছিল? আর পাঁচটা কামব্যাক স্টোরিতে বহিরাগত প্রতিকূলতা থাকে, এক্ষেত্রে তাঁর লড়তে হয়েছিল তাঁর নিজেরই মনের সঙ্গে। যে লড়াই বিশ্বের কোটি কোটি ক্যামেরা-ফ্ল্যাশলাইটের অগোচরে। নিঃশব্দে। একাকী। ক্রিকেটে ঋষভ পন্থের ফিরে আসার আগে রিহ্যাব সেশন, লিওনেল মেসির ফিরে আসার আগে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে যে কথিত চিত্রনাট্যের টুকরো সাজানো থাকে, সে কাহিনিবৃত্ত সম্পূর্ণ হতে পারে না সিমোনের ক্ষেত্রে।

পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়া ডিঙোতে না পারা পশ্চিমি সমাজের সামনে দিয়ে বাইলস যখন দু’হাত মেললেন প্রথমবার, দর্শকের চিৎকারে তখন কান পাতা দায়; তিনবার ভল্টের পর দু’হাতের ফাঁকে মুখ চেপে হাসি আসলে অলিম্পিকের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জিমন্যাস্টের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের ওপর পরিয়ে দিল চিরন্তন অলিভ পাতার মুকুট। এই অলিম্পিক যেমন রাজনৈতিক প্রতিকূলতা ভেঙে বিনেশ ফোগটের ফিরে আসার সাক্ষী, তেমনই একান্ত নিজস্ব মননের কুঠুরির ভেতর নিজেকেই আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে, বহির্জগতের কোলাহলের মাঝে শান্ত আত্মকথনের জোরে নিজেকে বিশ্বের কাছে ফিরিয়ে আনলেন সিমোনে বাইলস, বিশ্বের চিরপরিচিত প্রত্যাবর্তনের টেমপ্লেটের পাশে এ এক স্বতন্ত্র আখ্যান…