আমরা আচমকা জেগে উঠে যে দেশের ভেতর নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম, সে দেশ মান্যতা দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল এতদিনের সাবলীল ভারত-পাক ক্রিকেটীয় আবেগকে। মাঠের ভেতরের খেলা, যার হিসেব রাখে স্কোরবোর্ড, তাকে সে টেনে নিয়ে চলে এল মাঠের বাইরে তার সাজানো অসংখ্য বিদ্বেষের খোপে।
কৈশোরে শোয়েব আখতার হতে চাওয়া ছিল এক মস্ত ব্যাপার! সকলের সে এলেম ছিল না। কারও কারও ছিল। কানের দু’পাশ দিয়ে অমন হাওয়া, রেলগাড়ি ছাড়া একমাত্র দিতে পারে শোয়েব-ই– এই ছিল আমাদের গড় বিশ্বাস। ‘এক্সপ্রেস’ শব্দটার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল ওঁর হাত ধরেই– ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’। এমন এক ট্রেন, যা ওয়াঘার এপার থেকে ওপারে ধোঁয়া ছেড়ে ছুটে যেতে পারে নির্দ্বিধায়– পাসপোর্ট লাগে না; সৌরভ-দ্রাবিড়ের ঢোলা জার্সির টিম ইন্ডিয়াকে মাঝেমধ্যেই মাঠের বাইরে পাঠানো ইনজামাম উল হকের ব্যাটখানা বিস্ময় জাগাত; ওঁর ব্যাটে নির্ঘাত লাগানো আছে কোনও ম্যাজিক স্প্রিং– এমন ভাবনা উড়ে বেড়াত টেস্টপেপারের পাতা এলোমেলো করে দিয়ে। আউট হওয়ার পর ক্লান্ত ইনজিভাই আর তাঁর শ্লথ পায়ে মাঠ ছাড়া দেখে এক অদ্ভুত আনন্দ হয়েছে আমাদের, যেমনটা হয়েছে শাহিদ আফ্রিদির মিডল স্টাম্প ছিটকে গেলে! অথচ, এই আফ্রিদির কপালের মাঝ বরাবর টেরিকাটা চুল, সলমন বাটের হাঁটুমোড়া স্টান্স কিংবা দানিশ কানোড়িয়ার অমন লাফমারা স্পিন বোলিং মধ্যবিত্ত পাড়ায় ঢুকে আসত দিব্যি। ট্রাম্পকার্ডে ইয়াসির হামিদ থেকে মইন খানের ছবিও গিলক্রিস্ট-পন্টিং-চন্দ্রপল-লারাদের সঙ্গে জহরমানি হয়ে থাকত কৈশোরের!
আমাদের দেশ বলতে তখন এমন কোনও ভূখণ্ড যাঁকে চিনতে গেলে আজকাল একটা স্মৃতিচশমা চাপাতে হয় চোখে। ভারত-পাক ম্যাচ মানেই মেজঠাম্মার টিপ্পনি– ‘অরা নামে গোরু খাইয়া, তরা নামস সাবু খাইয়া, জিতবি ক্যামনে?’ আমরা– যাঁরা প্রাণপণে চাইতাম সৌরভের সেঞ্চুরি, সচিনের স্ট্রেট ড্রাইভ, জাহির খানের বলে ছিটকে যাওয়া ইউসুফ ইউহানার স্টাম্প, তাঁরা সহজেই মেনে নিতাম– গোরু খাওয়া পাকিস্তানি প্লেয়াররা বোধহয় সত্যিই শক্তিশালী। আমাদের এ ছেলেমানুষি ভাবনা, মাঠ ও মাঠ পেরনো বিস্তীর্ণ চরাচরে উড়ে উড়ে বেড়াত কেবল। রবিবারের দুপুর, কলঘর থেকে ভেসে আসা লাক্স সাবানের গন্ধ, গরম মাংস-ভাতের আলসেমির ওপর তখনও রক্তচক্ষু পাকায়নি দেশ। আমরা দেশপ্রেমের লিকপিকে সেনারা কেবল ম্যাচের দিন ছাদে টাঙিয়ে দিতাম ঢাউস তেরঙ্গা। জিতে গেলে কালিপটকা, হারলে মনখারাপ পাকিয়ে ওঠা– এর বাইরে কোনও আবেগ আদৌ কি ছিল? মনে পড়ে না।
সোশ্যাল মিডিয়া পরবর্তী সময়ে, আরও স্পেসিফিকালি বললে, আমাদের সাবালকত্বের পরপরই যে দেশ এসে উপস্থিত হল, বা, আমরা আচমকা জেগে উঠে যে দেশের ভেতর নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম, সে দেশ মান্যতা দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল এতদিনের সাবলীল ভারত-পাক ক্রিকেটীয় আবেগকে। মাঠের ভেতরের খেলা, যার হিসেব রাখে স্কোরবোর্ড, তাকে সে টেনে নিয়ে চলে এল মাঠের বাইরে তার সাজানো অসংখ্য বিদ্বেষের খোপে। দিনকয়েক আগে নীরজ চোপড়া সোনা জিতলেন বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে। এই প্রতিযোগিতায় রুপো জেতেন পাকিস্তানের জ্যাভলিন থ্রোয়ার আর্শাদ নাদিম। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয় বহু ট্যুইট-পোস্ট, যেখানে নীরজ ও আর্শাদের ছবি দিয়ে লেখা হয় ইউরোপীয় আধিপত্য ভেঙে জ্যাভিলিনের দুনিয়ায় দাপট দেখাল দুই দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী! এর তলায় শুরু হয় বিষোদগার। ভারত ও পাকিস্থানের নাগরিকরা একে একে এসে কমেন্ট করে যান, যার মূল কাঠামো বিদ্বেষের। ঘৃণার। ক্রিকেটীয় ময়দানে যে সময়ে আমরা ভারত-পাক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যতিরেকে, শোয়েব-আক্রম-ইনজামামের ভক্ত হতে পারতাম, আজকের কিশোর তত সাবলীল ভাবে হতে পারে না বাবর আজম কিংবা মহম্মদ রিজওয়ানের ফ্যান। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরিতার সূক্ষ্ম প্রভেদকে গুলিয়ে দেওয়ার কাজ, যা শুরু হয়েছিল আগেই, তা কার্যত সম্পূর্ণ। ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ এখন আদতে ধর্মীয় মেরুকরণের জন্য দুই শিবিরে জমা ক্ষোভের অ্যাড্রিনালিনকে বের করে আনার কলসমাত্র। যেখানে মেজঠাম্মা আজ অশীতিপর কণ্ঠে যদি বা বলেও ফেলতেন, ‘অরা তো গোরু খাইয়া নামে…’ মুহূর্তে তা হয়ে যেত বিদ্বেষের রসদ– কারণ, আমরা মেনে নিয়েছি, ব্যক্তিগত রন্ধনশালায় রাষ্ট্র প্রবেশ করতে পারে, আমরা মেনে নিয়েছি দাড়ি বা পোশাক নির্ধারণ করে দিতে পারে কোনও মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থান– এই সমস্ত মেনে নেওয়ার অন্ধকার আদতে এসে পড়েছে মাঠ ও মাঠের বাইরে, অত্যাধুনিক ফ্লাডলাইটের আলোও যাকে মুছে ফেলতে পারে না আর। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ আবার শিয়রে। আমাদের কৈশোর-শৈশবের সেসব সারল্যের গায়ে এসেছে বদলে যাওয়া সময়ের চোখ ঝলসানো আলো। তবু, বিরাট কোহলির নায়কোচিত ইমেজের পাশে, বদলে যাওয়া ভারত-পাক ক্রিকেটীয় সমীকরণের পাশে, রাজনীতির উত্তপ্ত আবহের পাশে কোথাও তো দিনশেষে লুকিয়ে থাকবে আমাদের কৈশোরের সেই ভারত-পাক ম্যাচ, আমাদের সব বদলে যাওয়ার ভেতরেও যেটুকু আবেগ গুটিকয়েকের মনে আজও শাশ্বত…