১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে পা রেখেছিলেন ওয়াল্টার কাউফম্যান। মুম্বই শাখার কর্মকেন্দ্রে দুই দেশের বৌদ্ধিক আদানপ্রদান সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিচারে ফলপ্রদ হয়েছিল। ভারতীয় চলচ্চিত্র ও বেতারের সেই আদিযুগ থেকেই কাউফম্যান জড়িয়ে আছেন। হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রথম যুগের অন্যতম পরিচালক মোহন দয়ারাম ভবানীর ‘মজদুর’ (১৯৩৪) এবং ‘জাগরণ’ (১৯৩৫) ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে সফলভাবে কাজ করলেন। তরুণ কাউফম্যানের প্রতীচ্যনির্মিত কানে প্রথমদিকে ভারতীয় সংগীত অদ্ভুত ঠেকত, ক্রমে তা সয়ে এসেছিল।
ভোরবেলা ‘আকাশবাণী’ খুলতেই তানপুরার নেপথ্যবিস্তার এবং শিবরঞ্জনী সুরে তারসপ্তকে বেহালার ছড়টানা শুনে সকাল শুরু হয়নি, নিদেনপক্ষে সুরটুকুও শোনেননি– এমন ভারতীয় দুর্লভ! কিন্তু এ সুরের জন্মদাতা ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ শুনলে অবাক হওয়ার মতো ভারতীয় খুবই সুলভ। শ্বেতাঙ্গের সুরসৃষ্টিতে শিবরঞ্জনী রাগের উপস্থিতি তবু কথঞ্চিৎ অবাকভাব আনতে পারে; কিন্তু যদি বলা হয় তিনি খাস মুম্বইতে থেকে রেডিও স্টেশনে কাজ করেছেন ১৪ বছর, ভারতীয় মার্গ সংগীতের ওপর খানকতক তাত্ত্বিক বই লিখেছেন এবং পাশ্চাত্য সংগীতের একজন সফল কম্পোজার– তখন তাঁকে ‘কাল্টিভেট’ না করে উপায় থাকে না! ইনি ওয়াল্টার কাউফম্যান (১৯০৭-১৯৮৪)– আজ, ৯ সেপ্টেম্বর, তাঁর প্রয়াণদিবসে একবার সেই কাল্টিভেশনে শামিল হলে ক্ষতি নেই।
কিপলিং-এর কঠোরতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মাঝে মাঝেই সেতুবন্ধন করে থাকে। উনিশ শতকের শিকাগো-বিবেকানন্দ যোগ, গত শতকের বিশ্বভারতী, সত্যজিৎ, রবিশঙ্কর-জর্জ হ্যারিসনের অধ্যায়গুলিকে সেতুর মজবুত ধাপ ভাবলে ভুল হবে না। কিন্তু দিনের আলোর গভীরে কিছু রাতের তারা থেকে যাওয়াটা স্বাভাবিক; উপমা-নির্মাতার ভাষাতেই ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’। আছেন, তবু খেয়াল করা হয় না। যেমন কাউফম্যান সাহেব। সত্যিই যে আছেন, তার একটা প্রমাণ আকাশবাণীর উল্লিখিত কিংবদন্তি ‘সিগনেচার টিউন’– বাকিগুলি তাঁর বইপত্র ও নিজস্ব সুরসৃষ্টির তালিকা। রবিশঙ্করের বিশ্ববিজয় গত শতকে ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের আলাপ-পরিচয়ের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল সন্দেহ নেই, একই সময়পর্বে ওয়াল্টার কাউফম্যান সাগ্রহে ভারতীয় মার্গ সংগীতের গভীর স্তরে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন প্রতীচ্যের পাঠকবর্গকে। প্রশ্ন উঠবে ‘কী করিয়া মিলন হল দোঁহে?’
খাস জার্মান ইহুদি কাউফম্যানের পারিপার্শ্বিক প্রত্যাশিতভাবেই ইউরোপীয়। জন্ম ১৯০৭ সালে পূর্বতন চেকোশ্লোভাকিয়ায়। ২৩ বছর বয়সে বার্লিন থেকে সংগীতে সাম্মানিক ডিগ্রিলাভ, প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীততত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় যোগদান। সে বড় সুখের সময় নয়। তিনের দশকের জার্মানি নব্য নাৎসিমোহে আচ্ছন্ন। কাউফম্যান জানতে পারলেন তাঁর অন্যতম শিক্ষক গুস্তাভ বেকিং নাৎসি যুবসংগঠনের নেতা, ডিগ্রির মোহ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। নাৎসিপীড়িত স্বভূমি কাউফম্যানের জীবনে শাপে বর হিসেবে দেখা দিল পরের কয়েক বছরের মধ্যেই।
ব্রিটিশ ভারতে প্রাশিয়ান কনস্যুলেটের সুবাদে বার্লিন-বম্বে যোগ একছাতার তলায় এনেছিল বহু চিন্তাশীল মানুষকে। ড. হোমি ভাবা, পরিচালক হিমাংশু রাই বার্লিন থেকে বিদ্যার্জন করে এসেছিলেন; অন্যদিকে বহু জার্মান ইহুদি নিরাপত্তার তাগিদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে মুম্বইতে বাস করতে শুরু করেছিলেন। সেই তালিকায় ওয়াল্টার কাউফম্যানও অন্তর্ভুক্ত হলেন।
১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে পা রাখলেন তিনি। মুম্বই শাখার কর্মকেন্দ্রে দুই দেশের বৌদ্ধিক আদানপ্রদান সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিচারে ফলপ্রদ হয়েছিল। ভারতীয় চলচ্চিত্র ও বেতারের সেই আদিযুগ থেকেই কাউফম্যান জড়িয়ে আছেন। হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রথম যুগের অন্যতম পরিচালক মোহন দয়ারাম ভবানীর (১৯০৩-১৯৬২) ‘মজদুর’ (১৯৩৪) এবং ‘জাগরণ’ (১৯৩৫) ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে সফলভাবে কাজ করলেন। তরুণ কাউফম্যানের প্রতীচ্যনির্মিত কানে প্রথমদিকে ভারতীয় সংগীত অদ্ভুত ঠেকত, ক্রমে তা সয়ে এল। পাশ্চাত্য আঙ্গিককে কাজে লাগালেন সুরযোজনার ক্ষেত্রে; সম্পূর্ণ ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রর সমন্বয়ে অর্কেস্ট্রেশন গড়ে তুললেন চলচ্চিত্রের আবহনির্মাণের জন্য। কাউফম্যান কি জানতেন একই সময়কালে সুদূর মাইহারে দিব্যোন্মাদ সাধক বাবা আলাউদ্দীন খাঁ ‘মাইহার ব্যান্ড’ নামে একই কাজে ব্রতী? ইতিহাসের খেয়ালে পরবর্তীকালে দেখা যাবে, কাউফম্যানের সহকর্মী বেহালাবাদক মেহিল মেহতার পুত্র জুবিন মেহতার সঙ্গে মাইহার ঘরানার তারকা সেতারীর জুড়ি সাত-আটের দশকে সমন্বয়ের নতুন রাস্তা খুলে দিচ্ছে।
১৯৩৭ থেকে ’৪৬ সাল পর্যন্ত মুম্বই বেতারকেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সময়েই ঘনিষ্ঠভাবে ভারতীয় মার্গ সংগীত ও ওস্তাদি ঘরানার ঐতিহ্যকে কাছ থেকে দেখতে পেলেন কাউফম্যান। নিজ সংগীতে প্রশ্নাতীত দক্ষতা ও মার্গ সংগীতের দীর্ঘ অনুসন্ধানের ফল ফলল তিনটি বইতে– ‘দ্য রাগাস অফ নর্থ ইন্ডিয়া’, ‘দ্য রাগাস অফ সাউথ ইন্ডিয়া– আ ক্যাটালগ অফ স্কলার মেটিরিয়াল’ এবং ‘মিউজিক্যাল নোটেশনস অফ দি ওরিয়েন্ট’। পাশ্চাত্য স্বরলিপি পদ্ধতিতে প্রতি রাগের বিস্তারিত বিবরণ ও ইতিহাস-নন্দনতত্ত্বের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দুর্লভ। ছয়-সাতের দশকে ভারতীয় মার্গ সংগীত সম্পর্কে প্রতীচ্যের উৎসাহে এই বইগুলি সাহায্য করেছিল, ভাবলে ভুল হবে না। অবশ্য নব্যস্বাধীন ভারতের ‘সাহেবিয়ানা’-কে ভাল চোখে দেখেননি কাউফম্যান– শেষোক্ত বইয়ের ভূমিকায় কড়া স্বরেই বলেছেন ‘ভারতীয় সংগীত পাশ্চাত্য সংগীতের কিছু উপাদান আমদানি করে একধরনের মধ্যমানের শিকড়হীন সংগীতের জন্ম দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এখান থেকে আর ফেরার উপায় নেই”। (অনূদিত)
এই উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে কি এই বক্তব্যকে ফিরে দেখা ভুল হবে?