ঝকঝকে এক রবিবার সকাল। রোববার.ইন উপস্থিত হয়েছিল টালিগঞ্জ গলফ ক্লাব রোডে, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। যে বাড়ির গায়ের বোর্ডে লেখা শুধুই ‘RAMANANDA’. তিনি সইও করেন শুধু নামটুকুই। নিজের বাড়িতে, নিজের লম্বা আঁকার ঘরে কথা বললেন তিনি। হাস্যোজ্জ্বল, চঞ্চল, একের পর এক প্রশ্নের উত্তরে সপ্রতিভ, আন্তরিক। পুরনো ছবি আঁকার দিনগুলি, শান্তিনিকেতন, মাস্টারমশাই, নিজের ছবিজীবন, গান– কিছুই বাদ দিলেন না সেই সকালে। মাঝে তার প্রেশারও চেক করে গেলেন এক ভদ্রলোক, মেপে বললেন, ‘এক্কেবারে ঠিক আছেন।’ এক্কেবারে ঠিক থাকুন রামানন্দবাবু। রোববার.ইন-এর পক্ষ থেকে সেসব কথাবার্তাই শুনলেন সম্বিত বসু।
প্রচ্ছদের ছবি: ব্রতীন কুণ্ডু
কেমন আছেন?
ভালোই আছি, কারণ ছবি আঁকতে পারি এখনও। দিনের যখন খুশি, যা খুশি, এমনকী, যেখানে খুশি। কখনও নিচতলায়, আমার নিজস্ব ছবি আঁকার লম্বা ঘরে। যেখানে বইপত্র, খাতাপত্র, রং-পেনসিল ভরে আছে। আর এককোনায় আমি ও আমার টেবিল। বেশ কিছুদিন আগে হাসপাতালে ছিলাম যখন, হাতে স্যালাইন, তখনও এঁকেছি। বাড়ির লোকজন তাই দেখে চিন্তিত। জিজ্ঞেস করা হল চিকিৎসককে, ‘এভাবে ছবি আঁকায় সমস্যা হবে না তো?’ উত্তর এল, ‘না, ওঁর যা মন চায়, করতে দিন।’ আমি সায় পেয়ে পরের দিন, একটা বড় খাতা আর কিছু রং বাড়ি থেকে চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। আরেক চিকিৎসক একটা গণেশ এঁকে দিতে হবে বলে আবদার করেছিলেন ওই হাসপাতালেই। বুঝেছি, ছবি আঁকার থেকে আমার নিস্তার নেই। শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও না। এই নিস্তার আমি চাই না কখনও।
আপনার ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে? ছবির প্রতি এই টান তৈরি হল কী করে?
বিহারের জামালপুরে কেটেছে আমার ছোটবেলা। বাবা বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কাজ করতেন রেলে। খুব ভালো গান গাইতেন– রবীন্দ্রসংগীত, শ্যামাসংগীত, অতুলপ্রসাদ, আরও নানা ঘরানার। মা প্রতিভা দেবী, সারাক্ষণ একটা কথা বলতেন, যা আমি এখনও শুনতে পাই: ‘তোমাকে আর্টিস্ট হতেই হবে।’ মায়ের রান্নাঘরে আমি ছবি এঁকেছি। মা হলুদ, খয়ের, পানের রস বেটে দিয়ে রং তৈরি করেছেন। তা দিয়ে ছবি এঁকেছি আমি দিনের পর দিন। মা একদিকের দেওয়াল ছেড়ে দিতেন। আমি সেই দেওয়াল ছবি এঁকে ভরিয়ে দিতাম। একদিন সত্যিই আর্টিস্ট হতে চললাম কলাভবনে। বাইরে তখনও বলতে পারতাম না কী করি। কেউ ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছে, কেউ ব্যারিস্টার হচ্ছে, আমি শুধু বলতাম: ‘আর্টস’। যদিও কেউ কেউ জানত, তারা বলত, ‘বিশ্বদার ছেলেটার মাথা গেছে রে, ছবি আঁকছে!’
এখন কি এই পরিবেশ নেই? মানে, বাড়ি থেকে এই শিল্পী হয়ে ওঠার প্রতি জোর দেওয়া?
ছেলেমেয়েরা এখনও শিল্পমুখী, বিশ্বাস করি। তবে মনে হয়, বাড়ির এই পরিবেশ প্রায় নেই। আমি এ ব্যাপারে ভাগ্যবান। মায়ের নিরন্তর সহযোগিতা ছাড়া আমার শিল্পী হওয়া হত না। আর একটা ব্যাপার, আমি কখনও বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখিনি। আমার মনে হয়, সামগ্রিকভাবেই শিল্পিত পরিবেশের অবক্ষয় হয়েছে।
আচ্ছা, দেশ যখন স্বাধীন হচ্ছে, আপনার ৯-১০ বছর বয়স। কোনও স্মৃতি মনে আছে সেদিনের?
খুবই মজার স্মৃতি। আমরা, ছোট ছেলেপিলের দল জাতীয় পতাকা তৈরির কাগজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এদিকে উন্মাদের মতো আনন্দ। হইচই। কী আর করব, জাতীয় পতাকায় সবুজের বদলে নীল লাগিয়েছিলাম। সে নিয়েই দৌড়। যে যার মতো করে সেদিন নিজের রঙে রাঙিয়ে তুলেছিলাম আমাদের পতাকা। এতে ঐক্যের কোনও সমস্যা হয়নি। হিন্দু-মুসলমানের কোনও রায়ট সেদিন স্পর্শ করেনি আমাদের।
আপনার বাবা গান গাইতেন বললেন, আপনি গান গাইতেন?
হ্যাঁ। নানা সময় গান গেয়েছি, গানের চর্চা করেছি। এখনও প্রায় সবসময়ই গান শুনি। একবার তো পূর্ব-পাকিস্তানে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গানের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে বুঝেছিলাম আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ যা, তার তুলনায় ঢের বেশি রবীন্দ্রনাথ ছিল ওপারের সত্তায় ও বিশ্বাসে। পথেঘাটে রবীন্দ্রনাথ, নৌকা চলাচলে রবীন্দ্রনাথ, সে এক প্রবল ব্যাপার! মঞ্চে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় উঠতেই হইচই, সঙ্গে আমি। পাশাপাশি বসেছি। মোহরদি, আমার হাঁটুতে রাখা হাতটা চেপে ধরে বললেন, ‘সরে যাবে না।’ তারপর শুরু করলেন গান। সে কী গান! আজও কানে ভাসে। ছবি আঁকতে আঁকতেও গান গাইতাম। তার কারণ কিঙ্করদা। উনি কাজ করতে করতে গান গাইতেন। আমাদের বলতেন, ‘গান গাও, গান গাও। চুপ করে থাকবে না একদম।’ ছবি আঁকা আর গান গাওয়া চলত পাশাপাশি। সমান্তরাল দুই শিল্প। পথ দিয়ে যাচ্ছি, গান গাইতে গাইতেই চলেছি এমন হয়েছে বহুদিন। কলাভবনের শুধু ভেতরে নয়, তখন গোটা শান্তিনিকেতন জুড়েই এমনটা হত।
সেই শান্তিনিকেতন কি পাল্টে গিয়েছে খুব?
সেটা দেখার ওপর নির্ভর করে। আমি তো এখনও শান্তিনিকেতন গেলে সেই পুরনো শান্তিনিকেতনকেই অনুভব করি। মনে হয়, কিছুই বদলায়নি।
শান্তিনিকেতনের প্রথম দিনের ক্লাস মনে আছে?
আছে। বড় হলঘর। ডেস্ক পাতা। সেখানে যে-যার মতো করে ছাত্ররা বসে আছি। মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু এলেন। বললেন, ‘তোমাদের যেমন ইচ্ছে তেমন আঁকো। পরে বলব কার কেমন হল।’ আমি গ্রামের ছবি এঁকেছিলাম। সূর্য ডুবছে আঁকছিল কেউ কেউ। কেউ বৃষ্টি পড়ছে। আমরা ছিলাম মুক্ত। ফ্রি-মুভমেন্টের একদম প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলাম কলাভবনের প্রথম দিনই। আমাদের নিউড মডেল ছিল না। কোনও মডেল আমাদের সামনে স্থির বসে থাকবে, আমরা আঁকব– এমনটা কোনও দিনই হয়নি। গ্রামে গ্রামে ঘুরেই আমরা শিখেছি। ছবির উপাদান নিয়েছি। ড্রয়িং করে ফিরে এলে মাস্টারমশাইকে দেখালে ট্রেসিং দিয়ে ছবি ঠিক করে দিতেন প্রথমে। তারপর রাখতেন মূল ছবির পাশে– পার্থক্য বুঝতে পারতাম। বুঝতে পারতাম, ঠিক কোন কোন জায়গায় ভুল হচ্ছিল।
মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আপনার রসায়নটা জমল কী করে?
আমি যখন শান্তিনিকেতনে ভর্তি হলাম, তখন কিন্তু নন্দলালবাবু অবসর নিয়েছেন। তবুও ক্লাস নিতেন। ভাগ্যের ব্যাপার ওঁর সঙ্গ পাওয়া। ৪ বছর শেষে যখন কলাভবনের শিক্ষা শেষ হল, আমি মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবার কী করব?’ মাস্টারমশাই বললেন, ‘যদি দেশকে জানতে চাও, গ্রামে গ্রামে ঘোরো।’ নন্দলালের সেবা করতেও পেরেছিলাম। ওঁর বড়ছেলে বিশ্বরূপ বসুই সে সুযোগ করে দিয়েছিল। তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে দেওয়া, এমনকী, তারপর কাপড় পরিয়ে দেওয়াও। স্নানের পর এককাপ কোকো দিয়ে বসতাম ওঁর সঙ্গে। গল্প করতাম অনেকক্ষণ। কখনও ওঁর সঙ্গে ঘুরতাম সবাই মিলে। টেরাকোটা মন্দির দেখতাম। এ সময় আমার সঙ্গী ছিলেন কলাভবনের পরবর্তীকালের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ কাঞ্চন চক্রবর্তী। মন্দিরের স্কেচ করতাম। ফিরে এসে ড্রয়িংটা আরও ভালো করার চেষ্টা করতাম। ফাঁকি দিয়ে আসলে কোনও শিল্প হয় না। কোনও মিথ্যের মধ্যে আমরা ছিলাম না। গৌরী ভঞ্জ– নন্দলাল বসুর বড় মেয়ে– কী অপূর্ব ডিজাইনার! একটা ফুল, লতাপাতা, যাই ওঁকে দেওয়া হোক না কেন, তা দিয়ে কী আশ্চর্য সব কাজ করে দেবেন! মাস্টারমশাই আমাকে আবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিনোদদার (বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়) দেখাশোনা করার। সে-ও এক অভিজ্ঞতা বটে!
কীরকম সেই অভিজ্ঞতা?
বিনোদদার তো দৃষ্টিশক্তি ছিল না। কাগজ চাইতেন। তারপর কাগজে হাত বুলিয়ে বুঝে নিতেন কাগজটা কী কাগজ, কতটা লম্বা-চওড়া। এবং তারপর কী দ্রুত আঁচড়ে যে হয়ে উঠত ছবি– সে এক অকল্পনীয় ব্যাপার! মনে আছে, একবার বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বিনোদদা বললেন, ‘এই কাগজটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দে তো।’ দিলাম। সেই কাগজে জল পড়ার শব্দ শুনে বিনোদদা বললেন, ‘কী জোর বৃষ্টি হচ্ছে রে!’ দৃষ্টিহীন যেভাবে বৃষ্টি বুঝলেন, এভাবে কি কোনও দিন আমরা যারা সে-অর্থে চোখে দেখতে পাই বুঝতে পারলাম? বিনোদদা চা-ও বানাতেন নিজেই। প্রথমেই কাপে টি-ব্যাগটা দিতেন। তারপর নিজের একটা আঙুল ঢুকিয়ে গরম জল ঢালতে শুরু করতেন, যখন গরম জল এসে ঠেকত আঙুলে, থামিয়ে দিতেন। অতটা ছিল বিনোদদার চা খাওয়ার মাপ। ‘ইনার আই’ ছিল ওঁর। সত্যজিৎবাবুর নামকরণ সার্থক।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও তো আপনার সাক্ষাৎ হয়েছিল?
হয়েছিল। সে অনেক আগে। ১৯৮৪ সাল নাগাদ বোধহয়। আঁকা নিয়ে ওঁর বাড়িতেই গিয়েছিলাম। প্রণাম করতে দিলেন না সত্যজিৎ। বললেন, ‘আপনি তো খুব নামকরা লোক।’ আমি বললাম, “প্রথমে তো ‘আপনি’ বললেন, তারপরে ‘নামকরা লোক’ বললেন, তার মানে আপনি চাইছেন আমি কিছু না বলি?’ একথায় হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, ‘জানো, তোমার ড্রয়িংয়ে কোনও সিগনেচার লাগে না।’
আচ্ছা, নন্দলাল বসু যে বলেছিলেন, গ্রামে গ্রামে ঘোরো, ঘুরলেন? কেমন ঘুরলেন?
এই ঘোরা আমার দেশকে, আমার সংস্কৃতিকে আমার সঙ্গে জড়িয়ে তুলল। মানুষ দেখলাম। গাছপালা দেখলাম। সারল্য দেখলাম। দেখলাম কাকে বলে সহজাত, সহজিয়া জীবন। গ্রামের লোকজনই আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন। বলতাম, কলাভবন থেকে পাশ করে বেরিয়েছি। আজ হয়তো এমনটা হওয়া সম্ভব নয়। বা হয়তো সম্ভবও। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছেছিলাম বাঁকুড়াতেও। যামিনী রায়ের গ্রামেও গিয়েছিলাম। চমৎকার কথাবার্তা বললেন তিনি। যদিও শান্তিনিকেতনের শিল্পশিক্ষাকে তিনি খুব একটা পছন্দ করতেন না, বুঝেছিলাম ওঁর কথাবার্তায়। আজও আমি যে বাড়িতে থাকি, যে ঘরে থাকি, মনে করি, এ আমার গ্রাম। কলকাতার মধ্যে, একটা বাড়ির মধ্যে একটা গ্রাম। সেই মাস্টারমশাইয়ের বলা গ্রামে গ্রামে ঘোরা এখনও আমি বাঁচিয়ে রেখেছি।
কাকে আপনি শিক্ষাগুরু মেনে এসেছেন?
একজন নয়, অনেকেই। শুরুতে অবশ্যই মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু। কিঙ্করদা। বিনোদদা– বিনোদদার কী লাইন! ভেতর থেকে দেখতেন আর আঁকতেন। মিষ্টি করে হাসতেন। সোমনাথ হোরের কাজ দেখেছি বহুদিন। গ্রাফিক্সে ওইরকম কাজ! অনেক দুরন্ত শিল্পীকেই তো দেখেছি, তবে আমার ভালো শিল্পী হওয়া হল কি না, জানি না।
আপনার শিল্পজীবনের টার্নিং পয়েন্ট কোনটা?
পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে কাজ করতে আসা। সেখানেই আমার জগৎ তৈরি হল। কর্তৃপক্ষ অবাধ স্বাধীনতা দিলেন। গোটা বিদ্যাপীঠটাকে সাজালাম একেবারে নিজের মতো করে। কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। এই চাকরি ছেড়ে যে অন্য চাকরিতে চলে যাব, এমন ব্যাপার মাথায় কাজ করেনি কখনও। মাথায় রাখতাম, আমার সব কিছুই ছাত্ররা দেখছে। ফলে এমন কিছু করব না, বা বলব না, যাতে ওদের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে। আমি এই শিক্ষা পেয়েছিলাম আমার শিক্ষকদের থেকেও। মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু প্রতিদিন ছবি আঁকতেন। যখন উঠতে পারতেন না, তখনও। হয়তো শুধু নিজের জন্যই, কিন্তু আমি ছাত্র হিসেবে ভাবতাম এই হল ছবির প্রতি নিমগ্ন থাকা।
আপনার ছবিতে রেখার আধিক্য একেবারেই কম। সেটা কী করে এল?
অহেতুক রেখা ব্যবহারের বিপক্ষে আমি। আমার ছবিকে আমি মিনিমাল করেই রাখতে চেয়েছি। একটা রেখায় যদি বোঝাতে পারি, তাহলে দুটো রেখা আঁকব কেন?
টেম্পারা, জলরং, এবং পরবর্তীকালে ড্রাই প্যাস্টেলের দিকেই আপনার ঝোঁক, আপনি তেলরংয়ের দিকে গেলেন না কেন?
করে ওঠা হয়নি। করলে হত। জলরংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল কাজ করতে করতে। সে এমন নিবিড়ভাবে টেনে নিল আমার কিছু করার ছিল না।
গণেশের প্রতি আশ্চর্য টান আছে আপনার। আপনার ছবিতে বারবারই ঘুরেফিরে আসে। কেন এই টান?
ঠিকই। আসলে এত মোলায়েম ছেলে আর পাওয়া যায় না। আমার কখনও গণেশকে ‘হাতি’ মনে হয়নি। দুর্গার কোলে বসে আছে শান্ত হয়ে। শিল্পের শক্তি যে কত বড়, তা বোঝা যায় গণেশকে দেখলে। হাতি ও মানুষের মিলমিশ। অথচ কী নিটোলভাবে মিশে গিয়েছে। আমি গণেশের বয়সও বাড়াইনি কখনও। আমার গণেশ বৃদ্ধ হয়নি। সবসময়ই দৌড়োদৌড়ি করেছে। শিবের জটায় উঠছে, মায়ের কোল থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ছে– আমাদের সাধারণ সংসারে যা যা চলে, ছবি আঁকার সংসারেও তাই। তা একেবারেই আমাদের জগৎ-বিচ্ছিন্ন নয়।
গণেশের প্রতি তো বসন্ত চৌধুরীরও টান ছিল, আপনার সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব ছিল কি?
ছিল বইকি! সে আশ্চর্য এক বন্ধুত্ব! কোনও অনুষ্ঠানে গেলে আমার পাঞ্জাবি নিয়ে যেতেন বসন্ত। কোনও কারণে আমার পাঞ্জাবিগুলো ওঁর খুব পছন্দের ছিল। সিনেমার লোক যদি বলো, তাহলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আমার এক ছবির প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখি, সৌমিত্র এসেছেন। তখনই বুঝলাম যে, ছবির প্রতি ওঁর আগ্রহ রয়েছে। পরে আলাপ হয়। উনিও তো ছবি আঁকতেন। কবিতা লিখতেন। ফলে কথাবার্তা জমত ভালোই।
ভারতবর্ষের শিল্পচর্চা দীর্ঘকালের, আবার শিল্পের সংরক্ষণ একেবারেই দুর্বল, এমনটা কেন? কী মনে হয়?
মনে হয় ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা ভাবিত নই। আমরা শুধুই বর্তমান নিয়ে ভাবছি। আর রাস্তার রাস্তার একের পর এক মূর্তি বানাচ্ছি। কোনও শিল্পপ্রাজ্ঞ লোক এ নিয়ে কথা বলেন না কেন? কেন সংরক্ষণ হবে না, সেটাই তো বুঝতে পারি না। অথচ উপযুক্ত লোক কি নেই? যথেষ্টই রয়েছে।
সম্প্রতি এক প্রদর্শনীতে বহু জাল ছবি বিক্রি হচ্ছিল যামিনী রায়ের ছবি বলে, শিল্পজগতে জাল ছবিরও ইতিহাস তো কিছু কম নয়।
হ্যাঁ। নানা সময়ই দেশ-বিদেশের ছবিতে এ জিনিস হয়েই এসেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, ফেক ছবি দেখলেই ধরা যায়। শিল্পের যে স্ট্রেন্থ, তা থাকে না। শিল্পচর্চাকারীদের এটা খতিয়ে দেখা উচিত। আসল ছবিগুলো ভালো করে দেখলে, বিশ্লেষণ করলে, জাল ছবি ধরা সহজ হবে। নইলে এই নিন্দনীয় কাজগুলো চলতেই থাকবে।
২০২৩-এর পুজোয় এস.বি পার্ক সার্বজনীনের দুর্গাপ্রতিমা হয়েছিল আপনার ছবির ঢঙে। আপনার কেমন লেগেছিল?
চমৎকার হয়েছিল সেই প্রতিমা। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ক্লাবের পক্ষ থেকে। আমি সম্মানিত, আনন্দিত।
শেষ প্রশ্ন, আজকের তরুণ শিল্পীদের কী বলবেন?
বলব, লোভ করতে না। আর ছবি এঁকে যেতে। সত্যিকারের শিল্পীর লোভহীন হওয়া জরুরি।
কৃতজ্ঞতা: সঞ্জয় মজুমদার, কৃষ্ণেন্দু ঘোষ