নাট্যশাস্ত্র ও ভিক্টোরিয়ান প্রসেস অনুগামী গিরিশ বাবু, ভাব-অনুভাবে নিমজ্জিত হয়ে যে থিয়েটারের কথা ভাবছেন, তাতে তদানীন্তন খেউড়, কথকতা, যাত্রার প্রভাবও সম পরিমাণ। আর এই পথ ধরেই নব্য বঙ্গসমাজ নর্তকী, বাঈজি, যৌনকর্মী মহিলাদের কাছাকাছি আসছে, তাঁদের ‘সমাজোন্নয়ন’-এ। ‘ভদ্র’বাড়িতে ধ্রুপদ, ঠুমরি বেজে উঠছে। তার মানে নাট্যকুলাচার্য গিরীশ ঘোষ তৎকালীন বাংলা থিয়েটারে নব জাগরণের প্রবর্তন ঘটালেন কি? নাকি মিস্টার ও মিসেস জর্জ বেঞ্জামিনের নেক নজরে থাকা গিরিশ ঘোষ, দলের রিহার্সালে ব্যান্ডম্যান নাট্যদলের মিস বুডিথ-এর অধ্যাবসায় ও মননের প্রসঙ্গ তুলে, যে ভিক্টোরিয়ান মর্যালিটি ও হায়ারার্কি চালু করতে চাইলেন, তা আদতে নাট্যকার-ম্যানেজার নয়, এক পুরুষের পদ্ধতি?
Life is a stage. এই বাক্য কবে যে বেদবাক্য হয়ে গেল, নিজেরও মনে নেই। আসলে অভিনয়কে মন দিয়ে ফেলার নিরিখে থিয়েটারের মঞ্চে মনোযোগী ছাত্রী হয়ে দিন কাটানো আমি, বর্তমানে ওয়েব সিরিজ বা সিরিয়ালের ফ্লোরেও প্রাক্তন নাট্যকর্মীকে বলে উঠি, ‘আরে ও তো আমাদের থিয়েটারের লোক!’ বর্তমান সহকর্মীরা মজা করে বলে ওঠেন, ‘ওহ, তুই আমাদের লোক নোস?’
তবু প্রেম, হায় ভীরু প্রেম। কেন প্রেম? একটা বেঁচে থাকার বীজমন্ত্র সেই কোন ছোটবেলায় নাটকের পাঠশালায় বুনে দিয়ে গিয়েছেন গুরু। নয়ের দশকে বড় হওয়া, মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির মেয়ে, ‘ক্লিনিকাল ডিপ্রেশন’ শব্দবন্ধ তখনও না জানা আমি, মনের অসুখে ওষুধ খাওয়া মানে ‘মাথার দোষ নয়’ না জানা আমি, কোনও এক জাদুবলে রয়ে গেলাম যেন। কেন? সব গা সয়ে গেল? হরমোনের আঁকিবুঁকি? না তো। বরং থিয়েটার, মঞ্চ, রিহার্সাল, দর্শকের হাততালি নামক থেরাপিগুলো পরোক্ষে কাজ করতে শুরু করেছিল। আমার অজান্তেই। তখন রিহার্সালের দিন আর সময় আসলেই মনে হত, এই তো এরপর কয়েক ঘণ্টা আর আমার ‘মনখারাপ’ (তখনও জানতাম না এটাকে ডিপ্রেশন বলে) হবে না। একটু বড় হলাম। বিদেশি ছবির নাগাল পেলাম চৌর্যবৃত্তি করে। দুম করে মামাতো দাদার সূত্রে দেখে ফেললাম, বার্গম্যানের ‘পারসোনা’। ইউরেকা মেজাজে সব্বাইকে ছুটে গিয়ে বললাম, দেখো, এ শুধু আমার ছিল না। আর এ যে আমারই ছিল না দিনের পর দিন, তা বুঝিয়েছে কলকাতা শহরের রিহার্সাল রুম, মঞ্চ। আমি জানতাম আমার সব জমা ব্যথা, অপমান, যন্ত্রণা হুশ করে ভ্যানিশ হয়ে যাবে থিয়েটারের মঞ্চে। তাই কি?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: তোমার শেখানো পথেই প্রশ্ন করছি, প্রতিবাদ করছি, তোমার তো খুশি হওয়া উচিত লালদা
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
২০১৮-’১৯-’২০ জুড়ে একের পর এক তাবড় থেসপিয়ানদের নাম যখন উঠে আসছে ধর্ষক হিসেবে, প্রবঞ্চক হিসেবে, তখনও মনে বল এঁটে অ্যাকাডেমি থেকে শুরু করে লালবাজার– সমস্ত ধরনায় গেছি। তাঁদের নাম বলে আর শব্দ বাড়াচ্ছি না, সবাই জানে। এ ক’দিনে আরও প্রকট হয়েছে সে লড়াই। ততদিনে ‘ট্রিগার’, ‘ট্রমা’, ‘গ্যাস লাইটিং’, ‘স্লাট শেমিং’ শব্দগুলো জানি। বুঝি। যে প্রেমিকা অ্যাবিউজ বা টক্সিসিটি একদা না বুঝতে পেরে পরবর্তীকালে ‘কল আউট’ করার জোরটুকু পেয়েছে, যে বাচ্চা মেয়েটি থিয়েটারের ওয়ার্কশপের নামে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে, দলের মাথা হওয়ার দরুন যে ছেলেটি ও মেয়েটি বাকিদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে, এরকম আরও কত কী! ভয়! পুরুষতন্ত্র! নারী মানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক! সর্বোপরি সে শরীর এগিয়ে দিলে বেশ্যা, বাধা দিলে ‘ইনহিবিশন’-ওয়ালা।
ঝুপ করে উনিশ শতকে হেঁটে আসতে ইচ্ছে করে। পতিতাপল্লির মেয়ে বিনোদিনীকে নাটকে ‘জায়গা দিয়ে’ বা ‘ভদ্রলোকের নাট্যমঞ্চ’-এর ‘যোগ্য’ করে একপ্রকার মাথা কিনে নিয়েছিলেন বোধহয় গিরিশ ঘোষ মহাশয়। থিয়েটারকে মনপ্রাণ দিয়ে বসা বোকা মেয়েটি, বিনোদিনী যখন ‘স্টার থিয়েটার’-এর নাম ‘বি-থিয়েটার’ হবে এই মর্মে গুর্মুখ রায়ের রক্ষিতা হিসেবে নিজেকে বিক্রি করল, তারপর ভিক্টোরিয়ান প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পদ্ধতি মেনে চলা নাট্যাচার্য কী করেছিলেন? একেবারে হতবাক বিনোদিনীকে, তারই শরীর দিয়ে কেনা স্টার থিয়েটারে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, যৌনকর্ম পেশা যে নারীর, তাঁর নামে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হতে পারে, কিন্তু তাঁর নামে প্রেক্ষাগৃহ হলে ‘ভদ্দরলোক’-রা নাটক দেখতে আসবে না। তখনই বোঝা গিয়েছিল থিয়েটারে লোকশিক্ষে মোটেই হয়নিকো। সুমন্ত ব্যানার্জি তাঁর লেখায় বলছেন, নাট্যশাস্ত্র ও ভিক্টোরিয়ান প্রসেস অনুগামী গিরিশবাবু, ভাব-অনুভাবে নিমজ্জিত হয়ে যে থিয়েটারের কথা ভাবছেন, তাতে তদানীন্তন খেউড়, কথকতা, যাত্রার প্রভাবও সম পরিমাণ। আর এই পথ ধরেই নব্য বঙ্গসমাজ নর্তকী, বাইজি, যৌনকর্মী মহিলাদের কাছাকাছি আসছে, তাঁদের ‘সমাজোন্নয়ন’-এ। ‘ভদ্র’বাড়িতে ধ্রুপদ, ঠুমরি বেজে উঠছে। তার মানে নাট্যকুলাচার্য গিরিশ ঘোষ তৎকালীন বাংলা থিয়েটারে নব জাগরণের প্রবর্তন ঘটালেন কি? নাকি মিস্টার ও মিসেস জর্জ বেঞ্জামিনের নেক নজরে থাকা গিরিশ ঘোষ, দলের রিহার্সালে ব্যান্ডম্যান নাট্যদলের মিস বুডিথ-এর অধ্যাবসায় ও মননের প্রসঙ্গ তুলে, যে ভিক্টোরিয়ান মর্যালিটি ও হায়ারার্কি চালু করতে চাইলেন, তা আদতে নাট্যকার-ম্যানেজার নয়, এক পুরুষের পদ্ধতি? নইলে ‘আমার কথা’ ও ‘আমার অভিনয় জীবন’ বই ছেপে বেরনোর আগে কেন গিরিশ ঘোষ নির্দিষ্ট কিছু অধ্যায় বাদ দিতে বলেছিলেন? গোলাপসুন্দরী, জগত্তারিণী, এলোকেশীদের ‘উদ্ধারের দায়’ নিয়েছিল যে পুরুষেরা, তাঁরা কি মুখোশ খুলে পড়ার ভয় পেয়েছিলেন? নাকি জানতেন মেয়েদের দাবিয়ে রাখা যায়। তানিকা সরকার লিখছেন, তৎকালীন ভদ্রবাড়ির মেয়ে বিভিন্ন লেখায়, নাটকে নিজেদের গোপিনী ও কৃষ্ণকে সেই প্রেমিক ভাবতেন। লুকিয়ে। ঠিক সেই কারণেই কি চৈতন্যলীলা থেকে শুরু করে সব নাটকে ভক্তিরসই মুখ্য হয়ে উঠল নবরসের মধ্যে? নারীবাদের ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে জেনেই উচ্চারণ, শব্দচয়ন, চরিত্রায়ন নিয়ে আলোচনা হত পুরুষ অভিনেতা ও নির্দেশকের মধ্যে। কারণ নারীর ভাগ্যনির্মাতারা জানতেন, বিনোদিনীর কান্নার দাগ মুছে গেলে জ্বলজ্বল করবে স্টার থিয়েটারই। বেমালুম ভুলে যাবে সকলে ‘বি-থিয়েটার’-এর স্বপ্ন দেখা ‘বেশ্যা’ মেয়েটার কান্না। গিরিশ ঘোষ ক্ষমা চাইবেন না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: এই লেখা কোনও আত্মপক্ষ সমর্থন নয়, একটি খোলামেলা স্বীকারোক্তি
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সময় পালটেছে। নারীবাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ঢেউ পেরিয়ে এখন একটু পরত লেগেছে ঔদ্ধত্যের চেহারায়। তাই নাট্যজন সুমন মুখোপাধ্যায় ধর্ষণে অভিযুক্ত, জামিনে মুক্ত, আদালতে হাজিরা দিতে না পারা সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাটক করতেই পারেন। ওর মতো সুগায়ক হয়তো হয় না। আর একজন নাট্যকর্মীও নাটক করেছেন সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। আমরা জনা কয় প্রতিবাদ করেছিলাম। নিভে গিয়েছিল ক্ষমতার কাছে। আর এক সম্মিলিত প্রতিবাদে সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় মধ্যমগ্রামে এক কর্মশালা থেকে বহিষ্কৃত হন। সুমন মখোপাধ্যায় সময় নিয়ে জবাব দেন। উনি জানেন, সেদিনও বিনোদিনীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। আজও নির্যাতিতাকেই করা হবে। প্রশ্ন উঠে আসে অপরাধীর মানবাধিকারের। প্রশ্ন ওঠে নির্যাতিতা তখন কেন মুখ খোলেনি। ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা ক’জনের থাকে? সম্পর্ক যে টক্সিক– তা বুঝতে যে সময় লাগে দাদারা-দিদিরা। নির্যাতনের কথা প্রকাশ্যে আসলে অনেক ক্ষেত্রে ‘লিগাল নোটিশ’ পায়। শুনলাম এই ধমক-ধামক আরও অনেকে খেয়েছে। চুপ করে গেছে। মরমে মরেছে। কাউন্সেলিং করেছে। তারপর যখন থিয়েটারের সম্মাননীয় মঞ্চে এই লোকগুলোকে লাফিয়ে-দাপিয়ে বেড়াতে দেখছে, তখন সেই ভয়ানক স্মৃতি ময়াল সাপের মতো হাঁ করে খেতে আসছে। একে ‘ট্রিগার্ড’ হওয়া বলে। একজনকে দেখে সাহস করে আরও কিছু ভিতু চাউনি, দুরুদুরু বুকে এগিয়ে আসা ছলছল চোখ। না, সেদিন সে পারেনি। আর পারেনি বলে এই ‘বেশ্যা’ বলে মার্ক করছেন, সেখানেও গলদ রয়ে গেল যে। বেশ্যাবৃত্তি তো একটা পেশা। গতর খাটিয়ে কাজ করা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি আপনি সবাই-ই বেশ্যা তাহলে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: যৌন হেনস্তার প্রতি উদাসীনতা, অমনোযোগ ক্ষমতার ‘পুরুষোচিত ঔদ্ধত্যই’
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ে থাকে থিয়েটারের মঞ্চ। থ্যালাসেমিয়া, লিউকেমিয়া, ড্রাগ অ্যাবিউজে ভুক্তভুগী পথশিশুদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলাম ‘থিয়েটার’-কে থেরাপি ভেবে। আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি বেচারা বাংলা থিয়েটার ও মঞ্চ কতটা ধুঁকছে। কত বিনোদিনী বর্তমানে কাশীর বদলে অন্য শহরে চলে যাচ্ছে যন্ত্রণা ভুলতে। অন্য সবখানেই এই পিতৃতন্ত্রের রমরমা ব্যবসা। কিন্তু তারা তো লোকশিক্ষের কথা বলে না। অন্ধকার হলে হাততালি গুঞ্জরিত প্রেক্ষাগৃহের আড়ালে নারী অভিনেতার শরীরে হাত চালিয়ে দেওয়ার ইতিহাস কি থামবে? না বোধহয়। পুরুষতন্ত্র বারবার মাথা তুলিয়া প্রমাণ করিবে সে মরে নাই।