মার্শালের বাবা ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। তাই মার্শাল বাংলা শিখছিল ঠাকুমাকে বাংলা বলে চমকে দেবে বলে। মনে আছে, সেবারে বাংলাদেশ গিয়ে মার্শাল জানিয়েছিল ঠাকুমা খুব খুশি হয়েছেন মার্শালের সঙ্গে কথা বলতে পেরে। ভাষা দিয়ে পরিবারের, সমাজের, দেশের সেতুবন্ধন হোক। নববর্ষের শুভেচ্ছাকে সঙ্গী করে নতুন বছর ভালো কাটুক সবার।
১৪৩১-এর পয়লা বৈশাখ। নতুন চাদর, পরদা, ঘরে পরার পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে তাকানো হয় বাংলা ভাষার দিকেও। বাংলা সাল-তারিখ বলে, বাংলা অক্ষরে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। তবু আলপনার কলকার ভিতর থেকে শাঁখের মাথার মতো উঠে উঠে থাকে আশঙ্কা– বাংলা ভাষা বুঝি ফুরিয়ে এল। এমনকী, ফুরিয়ে এল বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখার দিনকালও। কিন্তু আমার এমন মনে হয় না, কারণ দীর্ঘ বছর ধরে আমি বাংলা ভাষাকে ঠোঁটে করে নিয়ে উড়ে যেতে দেখেছি পরিযায়ী পাখিদের। হ্যাঁ, সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, কখনও কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড কিংবা রাশিয়া থেকে, আবার কখনও বা চিন বা পাকিস্তান থেকে ছাত্রছাত্রীরা উড়ে আসে। বহু বছর একটি ইন্সটিউটে, পরবর্তী সময় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানোর এই কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, বাংলা ভাষা কীভাবে বেঁচে আছে দেশে-বিদেশে।
সাময়িক একটু বিরতি নিয়েছি বটে অন্যান্য লেখাপড়ার কারণে, কিন্তু এই কাজ জড়িয়ে গিয়েছে আমার জীবনের সঙ্গে। আজ নববর্ষের দিন তাই মনে পড়ছে তাদের সবার কথা, যারা অন্য দেশের মাটির গন্ধ নিয়ে এসেও এই দেশের, এই বাংলার সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিল। মুছে গিয়েছিল কাঁটাতারের বিভেদ এবং বাংলা ভাষা জেগে উঠেছিল ভিন্ন দেশের ভিন্ন মানুষের ওষ্ঠ-অধরে। আজ লিখতে বসে মনে পড়ছে আলেসান্দ্রোর কথা, ইতালিয়ান ছাত্র আলেসান্দ্রো ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে গবেষণা করবার জন্য শিখতে এসেছিল বাংলা। আর পশ্চিমবঙ্গের জল হাওয়ায় বসে বসে লিখতে শুরু করেছিল ইতালিয়ান ভাষায় এক উপন্যাস। ডিলান এসেছিল আমেরিকা থেকে, কুমোরটুলিতে ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াত আর তৈরি করত এখানকার দুর্গাপুজো নিয়ে এক তথ্যচিত্র। এখনও মনে আছে, ডিলানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই বাংলায় কী আছে, যা তোমাকে আকৃষ্ট করে? ডিলান বলেছিল– ‘শিকড়’।
পাকিস্তান থেকে এসেছিল তৈমুর, গালিব আওড়াতে আওড়াতে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল রবীন্দ্রনাথ থেকে শঙ্খ ঘোষে। এমনকী, এক রবিবার শঙ্খ বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎও করে এসেছিল তৈমুর। রেন চাও, সুদূর চিন থেকে এসেছিল। চিন ভাষার ব্যাকরণ বেশ কঠিন আর তাই সেই ভাষার দখল দারুণ থাকায়, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ খুব সহজেই ধরে ফেলেছিল চাও। এখানে, এক বছর মতো ছিল চাও আর সেই এক বছর সময়কালে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’, মধুসূদন, জীবনানন্দের কবিতা এবং বাদল সরকারের নাটক পড়েছিল আমার সঙ্গে। বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ পড়ে উৎসাহ পেয়ে যাওয়ায় এখানে থাকার শেষের ক’দিন চিনা ভাষায় তা অনুবাদ করতে শুরু করেছিল। ক্লাসের শেষে, খাবার সময়ে মাঝে মাঝেই শব্দ ধরে ধরে অনুভূতিগুলো বুঝতে চাইত। বুঝতে পারতাম, ঠিক ঠিক অনুভূতি অনুবাদ করতে চাইছে।
জন ফাহি দারুণ ছবি তুলত, ফটোগ্রাফার হিসেবে নামও করল আগামীদিনে। সেবারে ক্লাসে জনকে মিষ্টির নাম শিখিয়েছি, যতদূর মনে পড়ে কোনও গল্পের প্রসঙ্গে। জন শিখেছে ‘চমচম’ একটা মিষ্টির নাম। সেদিন বিকেলের দিকে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল, আমার এক সহশিক্ষক আমাকে বললেন ‘সম্রাজ্ঞী দেখেছ ? কেমন ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল?’ জন আস্তে আস্তে আমার দিকে এসে আমায় মৃদুস্বরে ডাকল। সাড়া দিতে বলল ‘সম্রাজ্ঞীদি, চমচম করে বৃষ্টিও পড়ে? চমচমে কি বৃষ্টির গন্ধ?’ আমরা হেসে কুল পাই না। কিন্তু বুঝতে পারি এইভাবেই কান তৈরি হয়। একসময় ঠিক শিখে যায় ‘চ’ আর ‘ঝ’ -এর পার্থক্য।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পাকিস্তান থেকে এসেছিল তৈমুর, গালিব আওরাতে আওরাতে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ল রবীন্দ্রনাথ থেকে শঙ্খ ঘোষে। এমনকী এক রবিবার শঙ্খ বাবুর সঙ্গে সাক্ষাতও করে এসেছিল তৈমুর। রেন চাও, সুদূর চিন থেকে এসেছিল। চিন ভাষার ব্যাকরণ বেশ কঠিন আর তাই সেই ভাষার দখল দারুণ থাকায়, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ খুব সহজেই ধরে ফেলেছিল চাও। এখানে, এক বছর মতো ছিল চাও আর সেই এক বছর সময়কালে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’, মধুসূদন, জীবনানন্দের কবিতা এবং বাদল সরকারের নাটক পড়েছিল আমার সঙ্গে। বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ পড়ে উৎসাহ পেয়ে যাওয়ায় এখানে থাকার শেষের ক’দিন চিনা ভাষায় তা অনুবাদ করতে শুরু করেছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সরিতা মিজিন, কেলিন ডাওলার এরা আমার বন্ধুই হয়ে গেছে। সরিতা গবেষণা করত বেগম রোকেয়া, রামাবাই এমন অনেককে নিয়ে। কেলিন গবেষণা করত সুন্দরবন নিয়ে। দু’জনকেই আমি পড়িয়েছিলাম মল্লিকা সেনগুপ্তর ‘রক্তচিহ্ন’ কবিতাটা সঙ্গে কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেনও। লরেন উইলক্স কাজ করত গৃহসহায়িকাদের নিয়ে, আর প্রত্যেকদিন অনেক সাক্ষাৎকার নিয়ে হাজির হত ক্লাসে। এরা তো সকলেই গবেষক, কিন্তু পরবর্তী সময়ে যাদের পড়াতে শুরু করলাম, তারা গবেষক নয়। বরং ব্যবসার কারণে বা শখে বাংলা শিখতে এসেছে। যেমন এসেছিল সামার। সামার ছিল জিমন্যাসিয়াম কোচ। সঙ্গে দুই সন্তানের মা। সব সামলে প্রতিদিনের লেখাপড়া করত মন দিয়ে। যেমন ক্লোয়ি বাংলা ভাষা শিখে তার সন্তানের নাম রেখেছিল ‘মায়া’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: বাংলা না জানলে ‘কথামৃত’ পড়া বৃথা
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সিওল এসেছিলেন কোরিয়া থেকে, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর স্ত্রীকে নিয়ে ভিন্ন দেশে গিয়ে গিয়ে ভাষা শিখছিলেন। এখানে এসেছিলেন বাংলা শিখতে। যেমন মনে পড়ছে ডেভিডের কথা। ডেভিডের বয়সও ছিল পঞ্চাশের ওপর আর বলতে পারত প্রায় দশ-বারোটা ভাষা। লিখতে গিয়ে দেখছি সকলের কথাই প্রায় মনে পড়ছে, কিন্তু সব লিখতে গেলে এ লেখা দীর্ঘ হয়ে যাবে। পরবর্তী সময় জাপানি ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে গিয়ে আরেক রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে, সবচেয়ে বেগ পেতে হয়েছে ওদের ‘ল’ আর ‘র’-এর তফাত বোঝাতে। আসলে যার ভাষায় যেমন উচ্চারণ, তার তেমন জিভের অভ্যেস। নতুন ভাষায় জিহ্বা তাই নতুনভাবে চলতে শিখতে সময় নেয়। এ একেবারে হাঁটতে শেখার মতো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: বর্ণপরিচয়-ই আমার পড়া প্রথম বাংলা বই
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আজ পয়লা বৈশাখের দিন, বাড়ির কাজ সেরে, স্নান সেরে বইপাড়ায় প্রকাশকদের দপ্তরে যাব বলে তৈরি হওয়ার আগে এই লেখা লিখতে বসে এক আশ্চর্য সুখের অনুভূতিতে মনটা ভরে গেল। নানা বৃত্তি নিয়ে আবার কখনও বা নিজের খরচায় এই যে পাখিদের মতো উড়ে এসে বাংলা ভাষা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায় এরা, আর আমার বাংলা ভাষা, আমাদের বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর কোণে কোণে, এর চেয়ে ভালো লাগা আর কী হতে পারে?
এখনও যত্ন করে রাখা আছে চাওয়ের বাংলা ভাষায় লেখা চিঠি। আর এই লেখা শেষ করি মার্শালের কথা দিয়ে। মার্শালের বাবা ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। তাই মার্শাল বাংলা শিখছিল ঠাকুমাকে বাংলা বলে চমকে দেবে বলে। মনে আছে, সেবারে বাংলাদেশ গিয়ে মার্শাল জানিয়েছিল ঠাকুমা খুব খুশি হয়েছেন মার্শালের সঙ্গে কথা বলতে পেরে। ভাষা দিয়ে পরিবারের, সমাজের, দেশের সেতুবন্ধন হোক। নববর্ষের শুভেচ্ছাকে সঙ্গী করে নতুন বছর ভালো কাটুক সবার। পরিযায়ী পাখিদের মতো আমাদের এখানকার পাখিরাও বাংলাকে আরও আপন করে নিক, এটুকুই চাওয়া।
যথাসম্ভব নো মেকআপ লুক নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায়। তরুণ চক্রবর্তী ঢুকল। অন্যান্য দিন কুশল বিনিময় হয়, আজ কেবল স্তব্ধতা। শুরু করলাম অধিবেশন, চিরাচরিত হাসিটি আজ মুখে নেই। তারপরেই তরুণের মুখে উচ্চারিত হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদ। ঘোষিত হল রাষ্ট্রীয় শোক।