ওয়েস্টার্ন-এর অজস্র শাখাপ্রশাখার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে ধরা হয় ‘ডেকয়েট ওয়েস্টার্ন’-কে। এই ডেকয়েট ওয়েস্টার্ন-এরই ভারতীয় নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কারি ওয়েস্টার্ন’, মূলত ১৯৭৫ সালে ‘শোলে’-র মুক্তির পর। এখানে অবশ্য-উল্লেখ্য ইন্দ্রজাল কমিকস-এর অন্যতম ভারতীয় নায়ক বাহাদুর-এর প্রসঙ্গ। আগেও বাহাদুর নিয়ে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, কীভাবে বাহাদুর ডাকাতের ছেলে হয়েও, পিতৃহন্তাকারী পুলিশ অফিসারের কাছেই বড় হয়ে, হয়ে উঠেছিল একপ্রকার ‘ভিজিল্যান্টে’ বা আইনের আওতায় না থাকা আইনরক্ষাকারী নায়ক।
১১.
সুধীর কাকর নীরবে চলে গেলেন। মনোবিশ্লেষণ তাঁর মূল ময়দান ছিল, তার সূত্রেই জনসংস্কৃতির যে মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বায়ন তিনি করেছিলেন, তাও স্মৃতিধার্য। আজকের গল্পে ঢুকব তাঁরই কথার সূত্রে। সুধীর বলিউড নিয়ে আলোচনায় প্রায় এক নতুন যুগ চিহ্নিত করেছিলেন যাঁর সূত্র ধরে, তাঁকে ঘিরে কয়েক প্রজন্মের অজস্র গল্প জমে। সুধীর তাঁকে ‘গুড-ব্যাড হিরো’ আখ্যা দিয়েছিলেন, এবং তার সূত্রে জাতির অবচেতনে সুপ্ত পৌরাণিকতার সোপানও খুঁজতে চেয়েছিলেন। মহাভারতে কর্ণর অবস্থানকে তিনি চিহ্নিত করলেন এই ‘গুড ব্যাড হিরো’-র সূচক হিসেবে, একই সঙ্গে, বললেন, প্রেমিক হিসেবে সেই নায়ক মজনু নয়, যে আত্মবলিদানে তৎপর, আবার কৃষ্ণ নয়, ভোগই যার কাছে শেষ কথা। এ এমন এক নায়ক, যে নিজের কামনাকে কায়েম রাখতে জানে। সুধীর দেখিয়েছেন, আধুনিকতা ও পরম্পরার টানাপোড়েনে থাকা ভারতীয়ই হয়ে উঠেছিল তাঁর দর্শক। এবং তাঁর হাত ধরেই বলিউড ঝুঁকেছিল ওয়েস্টার্ন-এর দিকে।
এই শেষ কথাটা নিয়ে চর্চা চলতে পারে। কারণ ওয়েস্টার্ন-এর অজস্র শাখাপ্রশাখার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে ধরা হয় ‘ডেকয়েট ওয়েস্টার্ন’-কে। এই ডেকয়েট ওয়েস্টার্ন-এরই ভারতীয় নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কারি ওয়েস্টার্ন’, মূলত ১৯৭৫ সালে ‘শোলে’-র মুক্তির পর। এর আগের কিছু লেখায় বলিউডে ডাকাত ও পুলিশের অবস্থান নিয়ে কথা বলা হয়েছে, বা, কীভাবে জাসুসি কাহিনির খলনায়ক ডাকাতরা বলিউডের পর্দায় আসছে, তাই নিয়েও কিঞ্চিৎ আলাপ হয়েছে। এখানে অবশ্য-উল্লেখ্য ইন্দ্রজাল কমিকস-এর অন্যতম ভারতীয় নায়ক বাহাদুর-এর প্রসঙ্গ। আগেও বাহাদুর নিয়ে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, কীভাবে বাহাদুর ডাকাতের ছেলে হয়েও, পিতৃহন্তাকারী পুলিশ অফিসারের কাছেই বড় হয়ে, হয়ে উঠেছিল একপ্রকার ‘ভিজিল্যান্টে’ বা আইনের আওতায় না থাকা আইনরক্ষাকারী নায়ক। আবিদ সুরতি-র বাহাদুর কিন্তু বলিউডের গ্রামীণ নায়ককল্প থেকেই কিছুটা উঠে এসেছিল, ‘শোলে’-র ঠিক পরের বছর, যখন সে আবির্ভূত হল রংচঙে পাল্পকাহিনির দৃশ্যরূপে।
অরুণা বাসুদেব সম্পাদিত ‘ফ্রেমস অফ মাইন্ড: রিফ্লেকশনস অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’ বইটির সম্পাদক-মণ্ডলীর তরফে পরিচালক রমেশ সিপ্পিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার দর্শক কারা, ভারতীয় না আন্তর্জাতিক? (এই একই প্রশ্ন আরও অনেক ভারতীয় পরিচালককেই করা হয়েছিল।) রমেশ বলেছিলেন, দর্শকের কিছু কিছু অনুভবের হয়তো সীমান্ত হয় না, তা আন্তর্জাতিক হিসেবেই বিবেচিত হয়। কিন্তু ভারতীয় দর্শককেই ধরতে হবে পরাকাষ্ঠা হিসেবে। তাদের চিনতে হবে, তাদের জন্যই সিনেমা বানাতে হবে। রমেশের এই চিন্তাসূত্র হয়তো বুঝিয়ে দেবে, তাঁর ‘শোলে’-র ডাকাত গব্বর সিং কেন উর্দু জাসুসি কাহিনির দুর্ধর্ষ, আন্তর্জাতিক ডাকাত না হয়ে, হল সেই ভারতীয় ডাকাত, পঞ্চাশ ক্রোশ দূরের গ্রামে যার নাম বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর ওষুধ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কাকতালীয়ভাবে, এই ১৯৭৫ সালে দুটো ছবি করলেন অমিতাভ বচ্চন, যাদের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়ে গেল। একটি ‘শোলে’, অন্যটি ‘দিওয়ার’। ‘শোলে’-র দ্বিতীয় নায়ক অমিতাভকে হয়তো উদযাপন করেছিল দর্শক, কিন্তু ‘দিওয়ার’-এর অমিতাভ বচ্চন হয়ে উঠলেন অবধারিত নতুন নায়ক। রাজেশ খান্না-র মেলডিতে চোবানো রোমান্টিক নায়ক সত্তাকে ছাপিয়ে গেলেন তিনি অবলীলায়। মনে রাখার, ‘দিওয়ার’-এর নায়ক বিজয়কে ব্যাটম্যানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল পরবর্তীতে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জেমস মোনাকো ওয়েস্টার্ন-কেই চিহ্নিত করেছিলেন হলিউডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জঁর হিসেবে। কারণ তা মার্কিন মুলুকের জাতিমানসের সবচেয়ে সংবেদনশীল কয়েকটি দরজায় কড়া নেড়েছিল। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জমির অধিকার, আইনশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের সূক্ষ্ম ভেদরেখা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র। ‘শোলে’-ও নিজস্ব জমির অধিকারে জোর দিয়েছিল, তবে তা ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। সেখানে আইনরক্ষক নিজেই আইন-ভাঙা দুই চোরকে নিয়োগ করে এক ঘাতক ডাকাতের বিরুদ্ধে লড়তে। ধর্মেন্দ্র-র ভীরুর পাশাপাশি জয়ের চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন নিজের জন্য এক ঐতিহাসিক সোপান তৈরি করলেন সেই ছবিতে। বচ্চন যুগ তৈরি হল, যা অচিরেই ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ যুগ বলেই পরিচিত হবে।
কাকতালীয়ভাবে, এই ১৯৭৫ সালে দুটো ছবি করলেন অমিতাভ বচ্চন, যাদের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়ে গেল। একটি ‘শোলে’, অন্যটি ‘দিওয়ার’। ‘শোলে’-র দ্বিতীয় নায়ক অমিতাভকে হয়তো উদযাপন করেছিল দর্শক, কিন্তু ‘দিওয়ার’-এর অমিতাভ বচ্চন হয়ে উঠলেন অবধারিত নতুন নায়ক। রাজেশ খান্না-র মেলডিতে চোবানো রোমান্টিক নায়ক সত্তাকে ছাপিয়ে গেলেন তিনি অবলীলায়। মনে রাখার, ‘দিওয়ার’-এর নায়ক বিজয়কে ব্যাটম্যানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল পরবর্তীতে। ‘ডিসি কমিক্স’-এর এই দুনিয়া কাঁপানো চরিত্রের মতোই কিন্তু তার গতিবিধি, সে অপরাধীর আড়ালে রক্ষক, প্রায় ‘ডার্ক নাইট’-এর মতো। তার গথাম হয়ে ওঠে বাণিজ্যনগরী। কিন্তু এই ছবির অন্যতর ঝোঁকটিও ভেবে দেখার। বিজয় এবং তার ভাই রবি (শশী কাপুর)– দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকে। বস্তি থেকে ডকের শ্রমিক হয়ে বৈভবে পৌঁছনো বিজয় আর আইনের উর্দিপরা মধ্যবিত্ত রবির ভেতরের দেওয়াল আদতে এক আর্থসামাজিক কাঁটাতার নির্মাণ করে। তাদের নিহত বাবা ছিল মিলশ্রমিকদের নেতা। আর মা তাদের যোগসূত্র। তাই সেই মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের চিরন্তন সংলাপ এই ছবি থেকেই অনুরণিত হয়ে চলেছে, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে আদর্শবাদী বাবার আদর্শচ্যুত হঠাৎ বড়লোক ছেলে বিজয় বাংলো, গাড়ির বড়াই করে, আর রবি শুধুই নম্র স্বরে জানান দেয়, ‘মেরে পাস মা হ্যায়’।
‘মাদার ইন্ডিয়া’ থেকেই ভারতীয় মাতৃকল্প একভাবে তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু এই ছবিতে তা এক অন্য চেহারা পেয়েছিল, শেষত দুই ভাইয়ের সংঘর্ষে মৃত বিজয় মায়ের কোলেই ঠাঁই পায়, আশিস নন্দী তাঁর নিবন্ধে যাকে প্রায় মাতৃগর্ভে ফিরে যাওয়া বলছেন। বহু পরে অনুরাগ কাশ্যপ তাঁর তির্যক নায়ক ফয়জল খানকে দেখাবেন মায়ের জন্য আকুল অমিতাভকে দেখে কাঁদতে, যেখানে মায়ের সঙ্গে নাসের চাচার অবৈধ যৌনাচারের আভাস তার শৈশব, কৈশোরকে ডুবিয়ে দিয়েছিল অন্ধকারে। এই হ্যামলেটীয় পরিণতির প্রতিনায়কের অমিতাভ বচ্চনের মতোই এক প্রতিনায়ক দরকার ছিল হয়তো। ‘এলান’, ‘জোরো’-র মতো হলিউডের নকলনবিশি, কল্পবিজ্ঞান, সুপারহিরোর গল্প আর নয়, আর নয় চাঁদফুল জোছনার গান, এবার গদ্যের কড়া হাতুড়িতেই যেন শ্রমিক থেকে অতিনায়ক হয়ে ওঠার গল্প বলতেই হত রমেশ সিপ্পি বা যশ চোপড়াকে। যেজন্য কমিকসের পাতায় উঠে এল ভারতীয় সুপারহিরো বাহাদুর, যাকে কিঞ্চিৎ অমিতাভ বচ্চনেরই চিত্রিত চেহারা বলা যেতে পারে।
যে ‘এলিট’ সিনেমা এখন ভাঙা পড়ছে, সেইখানেই ‘শোলে’ আর ‘দিওয়ার’ দেখেছিল এক ডালহৌসির নিত্য অফিসযাত্রী। অফিসের কাজে খানিক ফাঁকি মেরেই হিন্দি বায়োস্কোপ দেখার অভ্যেস ছিল তার। এই খুচরো পাপে সে আবার সঙ্গী করেছিল তার আরেক বন্ধুকে, যে তখন টিউশনি করছে, মাস্টারির চাকরি পাবে বলে অপেক্ষারত। গান্ধীবাদী পরিবারের সেই যুবকের মনে তখন বামপন্থী টলমলানি বাড়ছে। হিন্দি সিনেমা দেখা তার স্বভাববিরুদ্ধ, কিছুটা সময় নষ্টই মনে হয়।
কোথা থেকে যে কী হয়, এই দু’টি ছবি তার মনে কী ঘটাল কেউ জানল না, শুধু শিগগিরই তিনি বিবাহিত হলেন, দুই সন্তান হল কিছুদিন পর, সেই দুই সন্তানের নাম তিনি রাখলেন জয় ও বিজয়।
(চলবে)
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল