ফ্যাসিবাদ বিরোধী স্বপ্ন, প্রগতিমনস্কতা তথা মানুষের ভালবাসার প্রতি আস্থা এই কবির চালিকাশক্তি। ‘আলোপৃথিবী’ প্রকাশিত মণীন্দ্র রায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’য় ২৪টি কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা নির্বাচন করা হয়েছে। এছাড়াও তিনটি দীর্ঘকবিতা (আংশিক), একটি কাব্যনাটক (আংশিক) এবং অনুবাদ (শেক্সপিয়রের সনেট এবং রবার্ট ফ্রস্ট)। সংকলক কবিপুত্র অনিন্দ্য রায়। জরুরি সংকলনটি এই কবির ‘কী লিখব’ এবং ‘কেন লিখব’ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।
শহর কলকাতা। সন্ধে। শপিং মল। তার ঝকঝকে কাঁধে ম্লান চাঁদ! ব্যাটা রোহিঙ্গা চাঁদ, কিংবা গৃহযুদ্ধে ক্রমশ রোগা মেরে যাওয়া টঙ্গোর খেতে না পাওয়া শৈশব! ফ্যালফ্যাল চেয়ে আছে ফুটন্ত, ছুটন্ত শহরের দিকে। ভুল করে মোবাইল থেকে মাথা তুলে দেখা পাপ! ওমনি মনে পড়ল– এক চিঠিতে ভাই থিওকে ভ্যান গগ লিখেছিলেন, ‘ছবি আঁকব, স্বপ্ন দেখতাম, তারপর স্বপ্নকে ছবিতে আঁকলাম।’ যেমন জীবনপ্রান্তেও স্বপ্নের ঘোর কাটেনি বিংশ শতাব্দীর চারের দশকের বাঙালি কবি মণীন্দ্র রায়ের। ১৯১৯-এ জন্ম। ১৯৯৫ কালপর্বেও প্রশ্ন তোলেন, ‘সবই কি যাবে ভেসে/ কালের উজানে?/ উলটেরিল সিনেমার সিকোয়েন্স হারা/ হ য ব র ল র দেশে/ দুঃস্বপ্ন ইজারা?’ (বাশুলি আদেশ)
ঘোষিত ‘সাম্যবাদী’ কবি মণীন্দ্র রায়। পৃথিবীগ্রামের বেপাড়ার লোক পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট ভ্যান গগ। ওঁদের মধ্যে মিল নেই, কিন্তু আছে! সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরতন্ত্র বিরোধী কবির সঙ্গে ‘দৈব উন্মাদ’ ডাচ শিল্পীর ‘স্বপ্নালুতা’র মিল কোথায়? বেমক্কা ব্যর্থতার মিল! শিল্পী হিসেবে নয়, তবে কিনা জীবনানন্দ কথিত যে ‘বোধ’ বুকে-মাথায় চাপিয়ে ঘুরেছেন ওঁরা, নদী-প্রান্তরে, গ্রামে-নগরে, যে চেতনার বীজ রুয়ে দিতে চেয়েছেন সমকাল ও ভাবীকালের যৌথখামারে, কোথায় পৌঁছল তা?
ভ্যান গগের গমখেতে বাড়ি উঠেছে, সূর্যমুখী ভাল সেলফি আইটেম, রাতের আশ্চর্য নক্ষত্র কল সেন্টারের কর্মী। উষ্ণায়নের ওয়ান্ডারল্যান্ডে চোখের তলায় রাত জাগা কালি নিয়ে জন্মাচ্ছে শিশু! মেনে নিচ্ছি, সকলেই ‘পোট্যাটো ইটার্স’। অথচ বিপরীত স্বপ্ন দেখছিলেন মণীন্দ্র। প্রথম কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রেই ছিল আত্মঘোষণা, ‘স্বপ্নজালে ছেয়েছে মন বেদনা স্মৃতিবিন্যাসী/ সর্বহারা অভাগা যত আকাশে হানে প্রার্থনা/ পঞ্চসারে দগ্ধ ক’রে করেছ এ কী সন্ন্যাসী/ রুদ্ধরুতি কামনা খোঁজে কবিতা মাঝে সান্ত্বনা।’
ফ্যাসিবাদ বিরোধী স্বপ্ন, প্রগতিমনস্কতা তথা মানুষের ভালবাসার প্রতি আস্থা এই কবির চালিকাশক্তি। ২০২৩ সাল বলছে, সবটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই চেতনাকে প্রতি মুহূর্তে কটাক্ষ করছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্দির-মসজিদ দ্বন্দ্ব, মণিপুর, হরিয়ানা। তেল ও অস্ত্র রাজনীতি, রাশিয়া-ইউক্রেনের মতো কোটি কোটি ক্ষয়। গত এক দশকে দেশের রাজনৈতিক চিত্র হল– পারলে বামপন্থী দলগুলিও মন্দিরে পুজো দিয়ে ভোটপ্রচারে নামে! এদিকে ১৯৬৯ সালে ‘ইয়াসিন মিয়া’ কবিতায় মণীন্দ্র লেখেন, ‘দেখা হল সব্জির বাগানে।/ তখন বিকেল! ছোট চারাগুলি ইয়াসিন মিয়া একা/ দ্রুত পরিচর্যা করে। শূন্য দিকসীমা।/ অবনীর ডাকে ফিরে তাকাল যখন/ রৌদ্রবিচ্ছুরিত মুখে ঘামে-ভেজা জ্যোতির আভায়/ ফোটে যেন ঋষির মহিমা!’ তেভাগায় সন্তান হারানো গরিব চাষি ইয়াসিনকে ‘ঋষি’ সম্বোধন করেন কবি। কী দুঃসাহস!
‘আলোপৃথিবী’ প্রকাশিত মণীন্দ্র রায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’য় ২৪টি কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা নির্বাচন করা হয়েছে। এছাড়াও তিনটি দীর্ঘকবিতা (আংশিক), একটি কাব্যনাটক (আংশিক) এবং অনুবাদ (শেক্সপিয়রের সনেট এবং রবার্ট ফ্রস্ট)। সংকলক কবিপুত্র অনিন্দ্য রায়। জরুরি সংকলনটি এই কবির ‘কী লিখব’ এবং ‘কেন লিখব’ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। সমাজ সচেতন কবিকে সময়ই শিখিয়েছে ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা। সাক্ষী থেকেছেন স্বাধীনতা সংগ্রাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা পরবর্তী উদবাস্তু বিপর্যয়…। লেখেন– ‘সুশান্ত, তোমার মনে পড়ে/ সরলার মাকে, যে এখানে/ কাজ করত? হঠাৎ সেদিন/ শুনল সেই বন্যা পাকিস্তানে,/ বুড়ি গিয়ে বসল বারান্দায়,/ দেখি তার চোখে জল ঝরে।’ (চিঠি)। যদিও চারপাশ প্রতিবাদহীন। আশাবাদী কবি লেখেন– ‘বৈশাখে দারুণ দাহ,/ মনে হয় গুমোট, জীবন/ কেটে যাবে প্রতিবাদহীন।/ হঠাৎ তখনি ডালে ডালে/ দাউ দাউ জ্বলে কৃষ্ণচূড়া–/ আমাদের উদ্ধত মে-দিন।’ (মে-দিন)
পথে পথে জং ধরা ঘৃণার ব্লেড, সেই দুনিয়ায় ‘দাউ দাউ জ্বলা কৃষ্ণচূড়া’ মণীন্দ্র নিজেই। বেদের ভাষায় কবি ঈশ্বরের মুখপাত্র। দীর্ঘ কবিতা মোহিনী আড়াল শুরু হয়, ‘এক আমি, বহু হব,/ ঈশ্বরের মুখে/ মানুষ শুনেছে এই সাধ। মানুষেরই/ শ্রুতি সে তো! অনেক জড়াতে/ কত প্রত্ন শতাব্দীর সাম্রাজ্য, প্রসাদ’। উপনিষদের দর্শনে সাম্যের এই ভাবনা চমকে দেয় আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠককে। আলোচ্য গ্রন্থের প্রবেশিকা প্রবন্ধে সুমিতা চক্রবর্তী কবির সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দুই চোখ আর সমস্ত মন নিয়ে পৃথিবী-প্রিয়াকে আবাহন করে নিয়েছিলেন হৃদয়ে।’ প্রশ্ন ওঠে, জেহাদি তালিবান, উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের পাশে কেমন আছে সেই পৃথিবী? পুঁজিবাদের বন্যায় ভেসে গেল নাকি? দূরদর্শী কবি টের পেয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘কী তাদের জন্য রেখে যাচ্ছ? তাদের–/ যারা আসছে, যারা আসবে?’ (উত্তরাধিকার)
মানববোমার মতো এই তীক্ষ্ণ প্রশ্নের মুখে পড়া আমাদের শান্ত করেন আরেক বাঙালি কবি। তিনি লেখেন, ‘ব্যক্তির উত্তরণ মিথ্যা হতে পারে না। তাছাড়া কবিতায় সমাজ, দেশ পালটানো যায় কিনা, এ সব কথার মধ্যে অযথা না জড়িয়ে ভবিষ্যৎ আর আরো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গুপ্ত সাংকেতিক ইশারা কিছু রেখে যাওয়া, একজন কবির কাছে মনে হয় অনেক ভাল।’ (ডায়েরি, ভাস্কর চক্রবর্তী)। যেমন, অনন্তের গুপ্ত সংকেত শপিংমলের আড়ালে ঢাকা পড়া চাঁদ!
নির্বাচিত কবিতা
মণীন্দ্র রায়
আলোপৃথিবী। মূল্য ৩০০