বর্তমান সময়ে সোশাল মিডিয়া এক উপযোগী মাধ্যম। বিজ্ঞানের ‘অভিশাপ’ ও ‘আশীর্বাদ’-এর মতো তারও দু’টি ভিন্ন রূপ রয়েছে। আশীর্বাদের স্বরূপ যতটা সমাজ-উপযোগী, অভিশাপের রূপটা ততটাই কর্কশ। আর সেই শাপবর্ষণে একজন ছাপোষা মানুষের জীবন কতটা বিপর্যস্ত হতে পারে তার আলেখ্য নির্মাণ ঘটেছে এই গ্রন্থে।
‘…মানুষ মানুষকে পণ্য করে,/ মানুষ মানুষকে জীবিকা করে।/…পুরনো ইতিহাস ফিরে এলে, লজ্জা কি তুমি পাবে না?/ও বন্ধু…’
ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে কালজয়ী গানের চেনা শব্দবন্ধগুলো মনে আছে? মনুষ্যচরিত্রের এই বিকার, স্বার্থান্ধ মানসিকতা কোনও ব্যতিক্রম নয়। বরং সভ্যতার এক ধারাবাহিক ইতিহাস। সেই ঐতিহাসিক পরম্পরা আর্থ-সামাজিক পরিসরে মানুষের মনের অন্ধকারময় দিককে প্রতিফলিত করে। আর সেটা যখন হয়, তখন চেনা মুখকে অচেনা লাগে। বিশ্বাসযোগ্যকে মনে হয় অবিশ্বাস্য। দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘নির্দোষ আসামির ডায়েরি’ সেই মুখ আর মুখোশ বিচারের বিশ্বস্ত কাঠগড়া।
বর্তমান সময়ে সোশাল মিডিয়া এক উপযোগী মাধ্যম। বিজ্ঞানের ‘অভিশাপ’ ও ‘আশীর্বাদ’-এর মতো তারও দু’টি ভিন্ন রূপ রয়েছে। আশীর্বাদের স্বরূপ যতটা সমাজ-উপযোগী, অভিশাপের রূপটা ততটাই কর্কশ। আর সেই শাপবর্ষণে একজন ছাপোষা মানুষের জীবন কতটা বিপর্যস্ত হতে পারে তার আলেখ্য নির্মাণ ঘটেছে এই গ্রন্থে। সেই কাহিনির কেন্দ্রে ‘প্রোফেসর’ নামে এক সাংবাদিক ও এক প্রথিতযশা ভারতীয় ক্রিকেটার শুদ্ধমান লাহার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। বাঙালি সেই ক্রিকেটারের একটা টুইট ছারখার করে দিয়েছিল প্রোফেসরের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন। বিপর্যয়ের বান ডেকে এনেছিল তাঁর সুখী গৃহকোণে। যার আঁচে কেবল প্রোফেসর ‘অপরাধী’ হয়ে যাননি, দগ্ধ হতে হয়েছিল তাঁর পরিবার– অসুস্থ মা, দিদি থেকে স্ত্রী, এমনকী, একরত্তি মেয়েকে। সেই আগুনের নাম ‘মিডিয়া ট্রায়াল’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একদিকে নির্বাসনের জ্বালা অন্যদিকে সোশাল মিডিয়া ইউজারদের আক্রোশ ক্রমশ তিলেতিলে শেষ করছিল প্রোফেসরের স্বপ্নগুলোকে। পরিবারের উৎকণ্ঠা সাংবাদিকের জীবনকে করে তুলেছিল টালমাটাল। খাদের সেই সীমারেখা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটা কঠিন কাজ। কিন্তু প্রোফেসর সেই কঠিনকে সহজ করে তুলেছেন নিজ অধ্যবসায়, খেলার প্রতি ভালোবাসায়, অন্তরের টানে। পায়ের তলার হারিয়ে যাওয়া জমি তাই যত পোক্ত হয়েছে, ততই গাঢ় হয়েছে প্রোফেসরের অব্যক্ত যন্ত্রণাপ্রকাশের অভিপ্রায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বস্তুত গ্রন্থপাঠের শুরুতে যতই লেখকের সতর্কীকরণ বার্তা থাক: ‘এই বইয়ের সমস্ত নাম, চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক।…’ বাস্তবে তা নেহাতই এক আড়াল, ছদ্মনামের পর্দা সরালেই প্রকৃত চরিত্রধারীদের চিনতে সমস্যায় হয় না। পাশাপাশি এক সাংবাদিকের দু’বছরের নির্বাসনপর্ব ও যন্ত্রণা যাপনের জার্নাল হলেও এই গ্রন্থের উপস্থাপন কৌশল একটু অন্যধর্মী। পক্ষ-বিপক্ষের অবস্থান থেকে সরে এসে এক নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে কাহিনি নির্মাণ ঘটিয়েছেন লেখক। হয়ে উঠেছেন এই আখ্যানের তৃতীয় স্বর। ঘটনা পরম্পরা ও বাস্তব তথ্যের সঙ্গে তিনি মিশিয়েছেন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, স্বোপার্জিত উপলব্ধিকে।
‘নির্দোষ আসামির ডায়েরি’ একদিক থেকে নির্বাসিত বঙ্গ-সাংবাদিকের ৭৩০ দিনের জবানবন্দি, এক অনিমেষ অপমানের উপাখ্যান। সংবাদমাধ্যমে ‘এক্সক্লুসিভ স্টোরি’ বা বিশেষ সাক্ষাৎকার হল আসল চাঁদমারি। সময়ের তিথি-নক্ষত্র মিলিয়ে তাতে অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদ করতে পারলেই কেল্লাফতে। সেই অভিলাষ যোগ্য সাংবাদিকের বিশেষ সংলক্ষণ। প্রোফেসরও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু তা করতে গিয়েই বিপদের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। সাক্ষাৎকার দেবেন বলেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি ক্রিকেটার শুদ্ধমান। উপেক্ষা বহুলাংশে অপমানের জ্বালা ধরায়। সেই অপমান বিক্ষোভের সঞ্চার ঘটায়। রাগে-দুঃখে সেই ক্ষোভটাই সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটারকে মেসেজে উগরে দিয়েছিলেন প্রোফেসর। ফল হয়েছিল মারাত্মক। ক্রিকেটার নামক ‘সুপারপাওয়ার’-এর ইন্ধনে সোশাল মিডিয়ায় কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল সাংবাদিককে। ‘ট্রোলিং’য়ের কশাঘাতে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘দোষী’ রূপে, ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে বেআব্রু আক্রমণের শ্লেষ আছড়ে পড়েছিল তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর। আসলে যে দেশে ক্রিকেট প্রধান ধর্ম বলে বিবেচিত, সেই ধর্মের পৌরোহিত্য করেন যে ক্রিকেটার, তার অবস্থান-প্রভাব-প্রতিপত্তি এক সাংবাদিকের তুলনায় শতগুণে বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ফলে প্রোফেসরের দাবি, যুক্তি গ্রাহ্য হয়নি। ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’ ভোগ করতে হয়েছিল ‘আততায়ী’, ‘গুন্ডা’ তকমা সেঁটে যাওয়া সেই সাংবাদিককে। ভোগ করতে হয়েছিল দু’বছরের নির্বাসন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: টাইগার পতৌদির ক্রিকেটই ছিল একচোখের দৃষ্টি হারানো বিষণ্ণ রুশদির অনুপ্রেরণা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এমন বিরুদ্ধ সুনামিতে ভেঙে পড়াই সহজসাধ্য। একদিকে নির্বাসনের জ্বালা অন্যদিকে সোশাল মিডিয়া ইউজারদের আক্রোশ ক্রমশ তিলেতিলে শেষ করছিল প্রোফেসরের স্বপ্নগুলোকে। পরিবারের উৎকণ্ঠা সাংবাদিকের জীবনকে করে তুলেছিল টালমাটাল। খাদের সেই সীমারেখা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটা কঠিন কাজ। কিন্তু প্রোফেসর সেই কঠিনকে সহজ করে তুলেছেন নিজ অধ্যবসায়, খেলার প্রতি ভালোবাসায়, অন্তরের টানে। পায়ের তলার হারিয়ে যাওয়া জমি তাই যত পোক্ত হয়েছে, ততই গাঢ় হয়েছে প্রোফেসরের অব্যক্ত যন্ত্রণাপ্রকাশের অভিপ্রায়। সেই দহনজ্বালাকে কোনও সাংবাদিকের একক ভাষ্য হিসেবে না তুলে ধরে, তিনি ব্যক্ত করতে চেয়েছেন সাংবাদিককুলের প্রতিবাদীস্বর হিসেবে। এই প্রত্যাবর্তনের পথে মুখ আর মুখোশের তফাত অনুধাবন করতে পেরেছেন প্রোফেসর। সোশাল মিডিয়ায় ধারাবাহিক বিরুদ্ধাচারকে গড়ে তুলেছেন নিজ সাফল্যের পথে উপলখণ্ড রূপে। তাঁর এই ঘটনাবহুল মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রামকে লেখক দেখেছেন নিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে, এক শুভাকাঙ্ক্ষীর চেতনায়।
প্রসঙ্গত, বইয়ের শিরোনামে ‘নির্দোষ’ ও ‘আসামি’– শব্দদ্বয় অবস্থান একে অপরের বিপ্রতীপে। ফলে তাদের সহাবস্থান আসলে অবিচার ও পক্ষপাতিত্বের দিকটাকেই চিহ্নিত করে। পাশাপাশি এই গ্রন্থবয়নে ব্যষ্টির বদলে সমষ্টির লড়াইকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন লেখক। অভিপ্রায়টাও স্পষ্ট, এই বই পরাশক্তির বিরুদ্ধে অসহায়দের লড়াইদের বীজমন্ত্র হবে। যে লড়াইটা ২২ গজে নয়, লড়তে হয় ২২ গজের বাইরে থেকে, আবহমানকাল।