ছবির চরিত্ররা যেন সব পাকা অভিনেতা, তারা দলে মিলে একটা সমবেত অভিনয় এমন সুন্দর করে করত যেন সবাই জ্যান্ত হয়ে কাজ করছে মিরান্ডার নির্দেশে। সেখানে কোনও কমজোরি নেই মারিওর, জোচ্চুরি নেই কুশীলবদেরও। চরিত্ররা এত অস্থির, এত চঞ্চল, অথচ স্রষ্টা কত শান্ত। ঠিক যেমন মহম্মদ রফি মঞ্চে গান গাওয়ার সময় দর্শক শ্রোতারা নেচেকুঁদে একশা, গায়কের শরীর কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়ছে না।
সমীর মণ্ডল
ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনে নেমে প্রথম যেদিন পা রাখি বম্বেতে, সেদিন থেকে মাথার মধ্যে দুটো ছবি চিরকালের মতো গেঁথে গিয়েছিল– বম্বে লোকাল ট্রেন আর কল্পনাতীত মানুষের ভিড়। ঠিক যেমন মারিও মিরান্ডার ছবিতে দেখেছি সর্বদা। ‘মারিও মিরান্ডা’ নামটা বম্বে আসার অনেক আগে কলকাতা থেকেই জানতাম। ওঁর পুরো নামটা আট কামরার বম্বে লোকাল ট্রেনের মতো লম্বা। বাংলা হরফে সেটা লেখার চেষ্টাও করছি না। বরং আট কামরার প্রথম কামরা, যেটা কি না ওঁর নিজের নাম আর শেষ কামরা, যা কি না ওঁর পারিবারিক পদবি– জুড়ে নিয়ে তৈরি হল ছোট নাম, সবাই তাঁকে যে নামে চেনে।
একজন সত্যিকারের বড় মাপের ভারতীয় কার্টুনিস্ট, ইলাস্ট্রেটার এবং চিত্রশিল্পী ছিলেন মারিও। তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে বসে নানা মানুষ ভিড় করে আসছে মাথায়। মগজে গজিয়ে উঠছে অসংখ্য গল্পের অগোছালো ডালপালা। যেমন নটে গাছটি মুড়োলো বলতেই এসে পড়ে গরু, তারপর রাখাল, রাখালের বউ, ভাত রান্না, ছেলের কান্না, পিঁপড়ের কামড় ইত্যাদি।
এই লেখার কাজটার শুরুতে দু’-একটা জিনিস জেনে নেওয়া দরকার মনে হল। সুবোধের কথা মাথায় এল। ডা. সুবোধ কেরকার। গোয়ার মানুষ, ডাক্তারি না করে শিল্পকলায় মনোনিবেশ। আমাদের ঘনিষ্ট বন্ধু। গোয়া মিউজিয়াম বানানো ওর হাতে, ইনস্টলেশন শিল্পী, শিক্ষাবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট। গোয়ার লোক, তায় আমাদের লাইনের। গোয়ায় বহুবার গেলেও, শেষের দিকে লম্বা গ্যাপ। এখন ‘মারিও মিরান্ডা মিউজিয়াম’-এর নাম শুনছি, আবার কখনও শুনছি ‘মারিও মিরান্ডা গ্যালারি’। ব্যাপারটা ঠিক কী? মিরান্ডার অসাধারণ আভিজাত্যপূর্ণ গোয়ার বাড়িটি কি মিউজিয়ামে পরিণত হল? প্রসঙ্গত, শ্যাম বেনেগালের ১৯৮৫-এর বিখ্যাত ছবি, ‘ত্রিকাল’ ওঁদের ঐতিহ্যের বাড়ি এবং গ্রামে শুট করা হয়েছিল। শোনা যায়, মারিও মিরান্ডার পরিবারের পুরনো কিছু ঘটনাও এই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যা থেকে এই ছবি তৈরির কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন শ্যামবাবু।
ফোন করলাম। সুবোধ বলছে, ওর বসত বাড়িটির এখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি, ওটা ওঁদের পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবেই আছে, তবে সেটাও একটি দর্শনীয় জায়গা। যেটা হয়েছে সেটা একটি সুদৃশ্য বড় দোকান, যাকে বলে স্যুভেনির শপ। মিরান্ডার শিল্পকর্ম এবং ওঁর কাজের রেপ্লিকা, যেমন ছবির প্রিন্ট, পুতুল, টি-শার্ট ইত্যাদির প্রদর্শনী, সঙ্গে বাণিজ্য।
মিরান্ডার গোয়া দেখতে ভ্রমণকারীদের ভিড় সেখানে এখন সবসময় লেগেই আছে। আরও একটি জিনিস সুবোধের কাছে জানার– মারিওর পদবির বানানের ‘ডি’ বাংলায় কীভাবে উচ্চারণ করব। “ইজ ইট লাইক ‘মিরান্দা’ অ্যাজ ইন দাদা অর ‘মিরান্ডা’ অ্যাজ ইন ঠান্ডা?” সুবোধ বললো– ‘মিরান্ডা’, ‘অ্যাজ ইন ঠান্ডা, আন্ডা।’
কলকাতার শিল্প জগতে তখন উত্তেজনার সময়। গত শতাব্দীর সাতের দশক। ‘কার্টুন’ বলতে কলকাতায় কাফি খাঁ-এর পরে হাল ধরেছেন ডাকসাইটে কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী। আনন্দবাজারের ‘তির্যক’ ভীষণ জনপ্রিয়। চণ্ডীদার কাছেই প্রথম শুনি কার্টুনের দুটো ভাগের কথা। সামাজিক কার্টুন আর রাজনৈতিক কার্টুন। চণ্ডীদার খ্যাতি ছিল সামাজিক কার্টুন করার জন্য, ঠিক যেমনটি পরে জেনেছিলাম মারিও মিরান্ডার ক্ষেত্রে বম্বেতে। চণ্ডীদার হাত ধরে আমার প্রথম আনন্দবাজারে ঢোকা। পূর্ণেন্দু পত্রী তখন আনন্দবাজারের আর্ট ডিরেক্টর, পরে বিপুল গুহ। কার্টুন ছাড়াও সাহিত্যের সঙ্গে অলংকরণের কাজের একটা সুন্দর সময় চলছে তখন। সুধীর মৈত্র, সমীর সরকার, সত্যজিৎ রায়ের মতো বাঘা বাঘা ইলাস্ট্রেটার কাজ করছেন তখন আনন্দবাজারে বাইরে থেকে ফ্রিল্যান্স হিসেবে। মাইনে করা একগাদা শিল্পীদের নিয়ে সচিত্রকরণ ও সাহিত্যের অলংকরণ শুরু হয়নি তখনও। কারণ তখনও অফসেট প্রিন্টিং চালু হয়নি। চণ্ডীদা শুধু কার্টুন করছেন না, তিন-চারজনের ছোট একটা টিম বানিয়ে অ্যানিমেশন ফিল্ম মেকিংয়ের ইউনিট খুলে বসেছেন। আমিও সেই ইউনিটের একজন। কলকাতা ছাড়ার আগে ৭-৮ বছর ছিলাম চণ্ডীদার সঙ্গে। কলকাতার বিজ্ঞাপন জগৎ, কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া, ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’ ইত্যাদির আবহে আমরা তখন গরম। আরও কিছু নামের সঙ্গে পরিচিত হলাম। শৈল চক্রবর্তী, অমল চক্রবর্তী কলকাতায়। দিল্লিতে রেবতীভূষণ, বম্বেতে আর. কে. লক্ষ্মণ আর মারিও মিরান্ডা।
বম্বেতে আমাদের আরেকজন কার্টুনিস্ট বন্ধু ছিল– বিজয় এন শেঠ। তাকে আমরা ‘ভিন্স’ বলে চিনতাম। সে রাজনৈতিক কার্টুন করত। তার কাছে মারিও-র কাজের ভূয়সী প্রশংসা শুনেছি। ছাত্রাবস্থায় মাঝে মাঝেই কলেজ কেটে ভিন্স ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র অফিসে গিয়ে মারিও মিরান্ডার কাজ হাতে-কলমে দেখতে যেত। ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর ইন্ডিয়ান এডিশনের প্রথম ভারতীয় কার্টুনিস্ট ভিন্স। মারিওকে ও গুরু বলে মানত।
মিরান্ডার শিল্পকর্মে সেক্স, টেক্সট, টেক্সচার, টাইপোগ্রাফির সুষম বণ্টন। স্ফীত বক্ষ, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্বের রমণীরা হাসি যেন আর থামাতে পারে না পার্টির ভিড়ে। তাদের ফ্রক কিংবা শাড়িতে কেমন পোলকা ডট। চূড়ান্ত গ্রাফিক। ছবির রেখার একঘেয়েমি দূর করতে ঠিক সময় মতো ভরাট কালো ব্যবহারের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা দেখতাম। জায়গা মতো টেক্সচারের ব্যবহার এবং ছবির ফাঁকা জায়গায় নানান প্রপের আয়োজন সাংঘাতিক সুন্দরভাবে করতে পারতেন মারিও।
মারিও মিরান্ডা কথা বলতেন খুবই কম, তবে তাঁর ছবির চরিত্ররা এত বেশি কথা বলত যে, তাতে মারিও-কে খুব বেশি বলতে হত না। ছবির চরিত্ররা যেন সব পাকা অভিনেতা, তারা দলে মিলে একটা সমবেত অভিনয় এমন সুন্দর করে করত যেন সবাই জ্যান্ত হয়ে কাজ করছে মিরান্ডার নির্দেশে। সেখানে কোনও কমজোরি নেই মারিওর, জোচ্চুরি নেই কুশীলবদেরও। চরিত্ররা এত অস্থির, এত চঞ্চল, অথচ স্রষ্টা কত শান্ত। ঠিক যেমন মহম্মদ রফি মঞ্চে গান গাওয়ার সময় দর্শক শ্রোতারা নেচেকুঁদে একশা, গায়কের শরীর কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়ছে না।
আমরা প্রায়ই বলতাম, মারিও মিরান্ডার ছবির দেশে জনসংখ্যা খুব বেশি। মিরান্ডার শিল্পকর্মে সেক্স, টক্সট, টেক্সচার, টাইপোগ্রাফির সুষম বণ্টন। স্ফীত বক্ষ, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্বের রমণীরা হাসি যেন আর থামাতে পারে না পার্টির ভিড়ে। তাদের ফ্রক কিংবা শাড়িতে কেমন পোলকা ডট। চূড়ান্ত গ্রাফিক। ছবির রেখার একঘেয়েমি দূর করতে ঠিক সময়মতো ভরাট কালো ব্যবহারের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা দেখতাম। জায়গা মতো টেক্সচারের ব্যবহার এবং ছবির ফাঁকা জায়গায় নানা প্রপের আয়োজন সাংঘাতিক সুন্দরভাবে করতে পারতেন মারিও।
টেক্সট আর ড্রইং একই রেখার ধরনে, একই সুর, একই রস। সচিত্রকরণের নিজস্ব চিত্রভাষা।
বিশাল পর্দায় কোরাসে জাতীয় সংগীত গাইছে যেন নানা চরিত্রের অসংখ্য মানুষ। চলচ্চিত্র পজ করে দেখুন, চরিত্রদের বয়স আলাদা, চেহারা আলাদা, আলাদা তাদের অবস্থান। অথচ সবমিলিয়ে এক সম্মিলিত সুর। অথবা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের গোপুরম যথা, সহস্র মূর্তিকলা একসঙ্গে সহাবস্থান, সাউন্ডটি যেন মিউট করা আছে।
গোয়ার মানসিকতায় ছবির চরিত্ররা সব মহা মিলনক্ষেত্রে। তখন মানুষগুলোকে দেখলে মনে হবে তারা যেন সবাই সবাইকে চেনে, যদিও দু’-চারজন অচেনা তাহলেও তাদের কৌতূহলী দৃষ্টিটাও একটি অদ্ভুতভাবে মিলিত সম্পর্কের। মারিও-র ছবির আর একটি বৈশিষ্ট্য হল, ছবির কোনায় কোনায় আনাচে-কানাচে খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে হবেই। সেটাই আমরা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। কে কাকে জানে, কে কে দেখছে, কে কাকে দেখছে, কে কার দ্বারা বিরক্ত, কে কার দ্বারা মোহিত ইত্যাদি। বম্বের পটভূমিতে আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে থাকে ভীষণ ব্যস্ততা। উৎসাহ, উদ্দীপনা আর উৎসবমুখর পরিবেশ। একটা উদযাপন, সবসময় যেন একটা সেলিব্রেশন।
চণ্ডী লাহিড়ীর কাছে শুনেছিলাম কার্টুনে মানুষের চেহারার ক্যারিকেচার করে একটি নিজস্ব ঢং তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু সেই একই মেজাজে বাড়ি ঘর গাছপালা এমনকী, পশুপাখি আঁকা খুবই কঠিন। সেই কাজটি অসাধারণ করতেন মারিও মিরান্ডা। একই স্টাইল। ঠিক পায়ের কাছটি ঘেঁষে আদরের বেড়াল কিংবা ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকা কুকুর। যথাযথ জায়গা অনুযায়ী তাদের উপস্থিতির কোনও ভুল ছিল না। পোষা, না পোষা কুকুর-বিড়াল, পাখি, সাপ, এমনকী, গান-বাজনার ছবিতে পাশে ল্যাম্পপোস্টের ওপর ঢুলুঢুলু চোখে প্যাঁচাটি ঠিক বসে আছে।
‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ এবং ‘দ্য ইকনমিক টাইমস’-সহ মুম্বইয়ের অন্যান্য সংবাদপত্রের সঙ্গে নিয়মিত যুক্ত ছিলেন মিরান্ডা। যদিও তিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’-তে প্রকাশিত তাঁর কাজের মাধ্যমে। আমাদের সময়ে ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ খুশবন্ত সিং-এর হাতবদল হয়ে এসেছে প্রীতীশ নন্দীর হাতে। প্রচণ্ড চঞ্চল এই প্রীতীশ নন্দী মানুষটি। দারুণ দাপট! ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র সমস্ত ম্যাগাজিনের একযোগে পাবলিশিং ডিরেক্টর। বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খাওয়াচ্ছেন। যা কিছু ভালো, যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তা এক্ষুনি চাই। এতই অস্থির যেন বিশ শতক এই বুঝি শেষ হয়ে যাবে। বিচিত্র মানুষের সমাবেশে জনারণ্য সৃষ্টির আর এক কারিগর এই প্রতিষ্ঠান, ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’। কখনও ভিক্টোরিয়া টারমিনাস স্টেশনের মধ্যে জনবহুল যাত্রী এবং ট্রেন চলাচল সমেত বিশাল চিত্র প্রদর্শনী। স্টেশন ভরা পরিযায়ী যাত্রীর দল, নিত্যযাত্রীরা, অফিস যাত্রী আর দেশি-বিদেশি দর্শক। কতরকম মানুষ, তাদের বিচিত্র চেহারা, সাজ-পোশাক। শারীরিক ভঙ্গিতে তারা আলাদা আলাদা। তারই মাঝে দেওয়ালে দেওয়ালে, কখনও ওপর থেকে ঝুলছে জনপ্রিয়, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের শিল্পকর্ম। আবার কখনও জাহাজের মাথায় বিদেশি নিলাম ঘরকে দিয়ে আমাদের হোমরা-চোমরা শিল্পীদের কাজের অকশন। সেখানে আবার দেখেছি ভারতীয় সাহেব, মেমরা বিচিত্র সব আধুনিক পোশাকে। সুন্দরী রমণীদের হাতে সরু ডাঁটার ফ্ল্যুট গ্লাসের মধ্যে শ্যাম্পেনের মাথায় বুদ্বুদ নয়, ক্যাভিয়া ভাসতে দেখেছি। কখনও খেলার মাঠ কখনও রেসকোর্স, ফিল্মস্টারদের নিয়ে বিশাল ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ফাংশন। কথায় কথায় পার্টি। কত না বিচিত্র চরিত্র। কত ড্রেস কোড। কোথাও ড্রেস কোড নর্মাল কোথাও বা ফরমাল। হাঁ করে দেখছি আমরা। চোখ দিয়ে গিলছেন বুঝি মারিও মিরান্ডা, কারণ সেই রাতেই তাঁকে বসতে হবে হয়তো কালি-কলম নিয়ে পরের দিনের সংবাদপত্রের দাবি মেটাতে।
আমিও কাজ করছিলাম, ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’-তে। প্রীতীশ নন্দীর জমানায়। সেই সুবাদে পত্রিকার মধ্যে আমি মারিও-র প্রতিবেশী। নিয়মিত কভার পেইন্টিং ছাড়াও আমার একটা কলাম ছিল। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প নিয়ে মিনি কমিক্স, তার সঙ্গে একটি ফুল পেজ পেন্টিং। ‘দেশ’ পত্রিকার চেয়ে কিছুটা বড়, অদ্ভুত সুন্দর একটা সাইজ। সাধে কি বলে– সাইজ ম্যাটার্স! গল্পের বিষয়ের গন্ধ নিয়ে একটি করে ছবি আঁকতাম জলরঙে। বলা যেতে পারে, সেই প্রথম আলাদা করে জলরঙের ছবির কলাম। আমার রঙের ব্যবহার তখনকার পাঠক দর্শকদের মনে ধরেছে। এটা এত বড় মঞ্চ আর এত সোচ্চার যে অচিরেই আমি স্থানীয় শিল্পীদের ভালোবাসার অথবা ঈর্ষার পাত্র হয়ে দাঁড়ালাম। প্রথম যেদিন মারিও মিরান্ডার কাছে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কলাম নিয়ে কথা হয়েছিল, উনি সরলভাবে বলেছিলেন– ‘তোমার জলরঙের ব্যবহার ভীষণ সুন্দর, আমি তো বারবার দেখি।’ সেটা ছিল আমার কাছে পুরস্কারের মতো।
আরেকটি জনবহুল অনুষ্ঠানের কথা না বললেই নয়। প্রীতীশদার ইচ্ছে হল তাঁর আত্মজীবনীমূলক কবিতাগুলো পেইন্টিংয়ের সঙ্গে প্রদর্শনী করা। আমাকে বলা হল ছবি আঁকতে। পোয়েট্রি-পেইন্টিং টুগেদার। আমন্ত্রণপত্রটি ছিল আমাদের প্রদর্শনীর পোস্টার, রোল করে মেইলিং টিউবে ভরে সবাইকে পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য, শহরের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে এই অনুষ্ঠানে হাজির করা। ‘বিশেষ’ বলতে কে আসেনি সেদিন, সেই অনুষ্ঠানে। অমিতাভ বচ্চন, জয়া বচ্চন, অনুপম খের, কিরণ খের সমেত সিনেমা জগতের আরও অনেকে। নাটকের ডলিঠাকুর, আলেক পদম্সী, ক্রিকেটার, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গায়ক, রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, সাংবাদিক। লিস্ট লম্বা। প্রচুর জনসমাগমে যাঁদের আসার কথা ছিল না, তেমন মানুষও এসে হাজির। যেমন এসেছিলেন কুখ্যাত হাজি মাস্তান, যিনি অপরাধ জগতের লোক, যাকে কি না পুলিশের নজর থেকে লুকিয়ে থাকার কথা। তিনি তো এলেন এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার, একটি সবুজ রঙের উর্দু-ইংরেজি মেশানো ভিজিটিং কার্ডও বিলি করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। হঠাৎ গ্যালারির ঠাসা ভিড়ের মধ্যে আমাকে একজন গ্যালারির এককোণে স্টোররুমের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। ঠিক যেমন কাজের বাড়িতে ভীষণ ব্যস্ত মানুষটিকে কোনও ভালোবাসার মানুষ কোণের রান্নাঘরের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেন– বড্ড খাটুনি যাচ্ছে, দুটো সন্দেশ খেয়ে একটু জল খা, কাজ শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তারপর ভদ্রলোক পকেট থেকে আমন্ত্রণপত্রের সেই মেইলিং টিউবটি বের করে তার থেকে পোস্টারটি নিয়ে টেবিলে রেখে হাত দিয়ে সমান করে ধরে বললেন– চট করে এইখানে তোমার অটোগ্রাফটা দিয়ে দাও, এটা আমি রেখে দেব। ব্যক্তিটি– মারিও মিরান্ডা। আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।
বেড়াতে এবং খেতে ভালোবাসতেন, সংগীতের ওপর মারিও-র ছিল অগাধ ভালোবাসা। বম্বে, গোয়া এবং অন্য জায়গায় বড় বড় নামকরা ক্যাফে, বার এবং রেস্তোরাঁতে অনেক ম্যুরাল আছে মিরান্ডার। ইউরোপ-আমেরিকা চষে বেড়িয়েছেন। পৃথিবী বিখ্যাত বাঘা বাঘা কার্টুনিস্টের সঙ্গে গা-ঘষাঘষি। ‘ম্যাড’, ‘লিলিপুট‘, ‘পাঞ্চ’-এর মতো কত না নামীদামি কাগজে কাজ করেছেন। অন্তত ২০-৩০টি দেশে ছবির প্রদর্শনী হয়েছে আর বহু হাজার ছবি এঁকেও শান্তি হয়নি। আক্ষেপ ছিল, প্রকৃত শিল্পী হিসেবে তাকে কেউ চিনল না। হালকাভাবে কার্টুনিস্ট বা ইলাস্ট্রেটর হিসেবে দেখল। অথচ স্বীকৃতি এবং জনপ্রিয়তার কোনও অভাব হয়নি। দেশ-বিদেশের নানা পুরস্কারও জলপানি। বম্বের রাস্তার মোড় ওঁর নামে। গোয়া তো মারিওকে মাথায় করে রেখেছে। ভারত সরকার আগেই সম্মানিত করেছে পদ্মশ্রী আর পদ্মভূষণ দিয়ে। পরে ২০১২ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণ (মরণোত্তর)।
শেষ জীবনে অবসরের পর বম্বে ছেড়ে পাকাপাকি গোয়ায় বসবাসের সঙ্গে প্রবল ইচ্ছা ছিল ফরমায়েশি কাজ আর করবেন না। বাকি সময়টুকু ছেলেবেলার গোয়ার স্মৃতি নিয়ে লিখবেন। নিজের মতো ছবি এঁকে কাটিয়ে দেবেন, আঁকবেন জলরঙে। তবে খুব বেশি সময় আর হাতে ছিল না। এই দু’টি ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি।
কাজের মানুষের কথা বলতে গিয়ে শুধু কাজের কথাই হল। তাঁর ব্যক্তিগত মানসিকতার কথা বলা হল না এখানে। সারাটা জীবন খ্রিস্টধর্ম পালন করেছেন। সহধর্মিনী ‘হাবিবা’ ছিলেন মুসলিম এবং শেষইচ্ছায় হিন্দুমতে মিরান্ডার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। অর্থাৎ আবার শিকড়ে ফেরা। কমপ্লিট ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন। জাতীয় সংহতির চূড়ান্ত উদাহরণ। যেদিন তিনি চলে গেলেন, বম্বের আকাশে ‘আমূল’-এর বিলবোর্ডে দেখলাম তাঁরই সৃষ্ট, মিস নিম্বুপানি, মিস ফন্সেকারা চোখের জলে বিদায় দিচ্ছে মারিও মিরান্ডা-কে।