আমাদের কেমন যেন একটা সাংস্কৃতিক দায় রয়েছে বলে আমরা বোধ করি, ফলে এমনভাবে নিজেদের সমাজের সামনে পেশ করার চেষ্টা করি, যার সঙ্গে আমার ভিতরটার কোনও মিল নেই। আমরা প্রত্যেকে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গিটার নিয়ে বইমেলায় পুলিশের লাঠি খেয়েছি, শক্তি-সুনীলদের জেল থেকে ছাড়িয়েছি, আর অবশ্যই মানিকদার বসার ঘরে বসে তাঁর শিঙাড়া খেয়েছি। বাঙালির বৌদ্ধিক সমাজে প্রতিষ্ঠা না হলে তার জীবনে শান্তি নেই, রাতবিরেতে চোঁয়া ঢেকুর ওঠে, সেই ঢেকুরের ম্যানিফ্যাস্টেশন হচ্ছে এই মানিকদা-সিন্ড্রম।
মানিকদা ধোঁকার ডালনা খেতে ভালোবাসতেন।
মানিকদা চিত্রভাষার নিরিখে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-কে অন্য অনেক ছবির থেকে এগিয়ে রাখতেন।
ঋত্বিক, মৃণাল– দু’জনেরই পছন্দের ছবি ‘অপরাজিত’– তাঁরা একথা বারবার মানিকদাকে বলতেন।
মানিকদা ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ দেখে ছবি বানানোর কথা ভাবেন।
মানিকদা ছোটবেলায় প্রথমবার আইসক্রিম যেবার খেয়েছিলেন দাঁতে ঠান্ডা লাগায় আইসক্রিম গরম করে আনতে বলেছিলেন।
বুঝলেন? সবে পাঁচটা পয়েন্ট বললাম, এরকমভাবে টানা পাঁচ হাজারটা পয়েন্ট দিয়ে যেতে পারব সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে, এবং এটা আশ্চর্যের কিছুও নয় একজন বাঙালি পাঠক/দর্শক হিসেবে এটা সবাই না হলেও, অনেকে পারবেন। কারণ এইসব তথ্য সত্যজিৎ রায়ের বহুল প্রচারিত বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, জীবনী, আত্মজীবনীতে ছড়ানো। কিন্তু মুশকিলটা তো সেটা নয় জনাব, মোহতরমা– মুশকিল হচ্ছে এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে একজন হিমালয়সমান মানুষকে ডাকনামে ডেকে তাঁকে যদি কাছের প্রমাণ করার উদগ্র বাসনা জাগে, মুশকিল হয় তখন। ২২ শ্রাবণ আর ২৩ এপ্রিল-এর মধ্যে বড় মিল হচ্ছে গুরুদেবের তথাকথিত ভক্তরা গুরুদেব চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে শবযাত্রায় তাঁর শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাড়ি, চুল উপড়ে নিল ‘স্মৃতিচিহ্ন’ হিসেবে কাছে রাখবে বলে। আর ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় চোখ বোজার পর অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘মানিকদা মানিকদা’ করে। এরা পারলে সত্যজিৎ নামটাকেই উপড়ে ফেলে!
কী বলছেন? উনি তো সত্যিই মানিকদা। অবশ্যই, আদি ও অকৃত্রিম মানিকদা। কিন্তু কারও কারও, সক্কলের নন। একজন বেস্টসেলিং শিশুসাহিত্যিক (শুধু যা নিয়ে পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া যায়), নিজের বইয়ের তো বটেই অন্য অনেকের বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ, ‘সন্দেশ’ সম্পাদনা এবং সর্বোপরি পরবর্তী কালে একটা ছবির বেশিরভাগ বিভাগ নিজে সামলান, পৃথিবীর ছবি দেখা, তাদেরকে নিজের ছবি দেখানো, গোটা পৃথিবীর চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছনো, এই স-ব-ব কিছুর পর আপনার মনে হয় অকারণ খেজুরের বিশেষ সময় সত্যজিৎ রায়ের ছিল? আমার তো মনে হয় না। অথচ যতজন মানিকদার সঙ্গে তাঁর বাড়িতে শিঙারা খেয়েছে বলে, তাতে অ্যাকিউট অ্যাসিডে মধ্য-চল্লিশেই চলে যাওয়ার কথা।
আসলে কী জানেন? গোখেল তো বটেই, গোটা ভারত বাঙালির বুদ্ধি নিয়ে নাচনকোঁদন করে সাড়ে সর্বনাশ করে দিয়েছে! বাঙালির বৌদ্ধিক সমাজে প্রতিষ্ঠা না হলে তার জীবনে শান্তি নেই, রাতবিরেতে চোঁয়া ঢেকুর ওঠে, সেই ঢেকুরের ম্যানিফ্যাস্টেশন হচ্ছে এই মানিকদা-সিনড্রম। একটা জিনিস দেখবেন অনেক সময়, সিনেমাহল থেকে বেরনোর পর যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘ছবি কেমন লাগল?’ অনেক ভেবেচিন্তে সে বলবে, ‘আমার ভালো লেগেছে, কিন্তু এ ছবি সবার জন্য নয়।’ মানেটা কী? দাবিটাই বা কী? ওঁর ভালো লেগেছে, কিন্তু ‘সবার জন্য’ নয়? দেখবেন এই কনফিডেন্স শুধুমাত্র বাঙালির আছে। কেন জানেন? ও-ই– মানিকদা। সকালে ময়দানে পায়চারি করতে করতে সত্যজিৎ রায় সবার কানে কানে বলে গিয়েছেন, ‘মনে রেখো, তুমি কিন্তু আলাদা।’ এই একই সিনড্রমের আরেকটা দিক দেখতে পাওয়া যায় খালাসিটোলা নিয়ে। সবাই নাকি কমলকুমারের হাত থেকে বাংলা খেয়েছে, সব্বাই শক্তিকে শান্ত করেছে!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে আরও লেখা: দুপুরের বইমেলায় ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে’ শুনে আকাশের দিকে তাকালেন সত্যজিৎ রায়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মৃণাল সেনের ছেলের এক বন্ধু শুটিং দেখতে আসবে বলে বায়না করেছে। ছেলে কখনই কিছু চায় না, এইটুকু চেয়েছে। মৃণাল সেন বারণ করেননি। কিন্তু শুটিংয়ে পৌছে সে প্রবল আঁতলামো শুরু করে। এবং তার আচার-ব্যবহার দেখে মৃণাল সেন মনে মনে বিরক্তই হচ্ছিলেন। দুপুরের ব্রেকে মৃণাল সেন খেতে বসেছেন। ছেলেটি এসে সামনে দাঁড়ায়। নিজের মনে খেতে খেতে মৃণাল প্রশ্ন করেন, ‘খাওয়া হয়েছে?’
ছেলেটি উত্তর দেয়, ‘নাহ, লাঞ্চে শুধু কফি খাই।’
মৃণাল খেতে খেতে, ‘অ।’
ছেলেটি: ‘শুনেছি গদারের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?’
মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে মৃণাল সেন: ‘তা আছে।’
‘তা শেষ কবে দেখা হয়েছিল গদারের সঙ্গে?’ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে ছেলেটি।
মৃণাল চোখ বুজে মাছ খেতে খেতে তৃপ্তি-সহকারে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ত্রুফোর ছেলের পইতেতে।’
শোনা যায়, বাকি শুটিং ছেলেটি আর মৃণাল সেনের ধারে-কাছে যায়নি।
এর পরের ঘটনা আরেক কিংবদন্তিকে ঘিরে। উৎপল দত্ত শুটিংয়ের কাজে কয়েক দিন নিজের নাটকের দলে যেতে পারেননি। দলে এসে শোনেন, দলে একটি নতুন ছেলে এসেছে যে নাকি প্রভূত পড়াশুনা করেছে। শুনে উৎপলবাবু খুশিই হলেন, একজন পড়াশুনা করেছে– এ তো ভালো কথা! কিন্তু দলের কয়েকজন বললেন, সবটা সত্যি না-ও হতে পারে। উৎপলবাবু হাসলেন। মহড়ার পর ছেলেটিকে ডেকে বল্লেন, ‘শুনেছি আপনি প্রচুর পড়াশুনা করেছেন?’ ছেলেটি লজ্জা পেয়ে বলল, ‘ওটা নিয়েই তো আছি।’ ‘‘বেশ বেশ, তাহলে ক’টা প্রশ্ন করি?” উৎপলবাবু বলেন, ছেলেটিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
‘‘আপনি কামুর ‘আউটসাইডার’ পড়েছেন?’’ উৎপলবাবুর প্রশ্ন।
‘পড়েছি।’
‘‘কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ পড়েছেন?’’
‘পড়েছি।’
‘‘দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ পড়েছেন?’’
‘পড়েছি।’
‘মার্কেজ-এর ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড’ পড়েছেন?’’
‘পড়েছি।’
‘‘উয়োকহারড-এর ‘বেটনোভেট’ পড়েছেন?’’
‘পড়েছি।’
‘ওটা পড়েননি, ওটা মেখেছেন। ওটা একটা মলমের নাম।’
উৎপল দত্তের কথা শেষ। সম্ভবত সামনের ছেলেটিরও।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তথ্যের উপর ভিত্তি করে একজন হিমালয়সমান মানুষকে ডাকনামে ডেকে তাঁকে যদি কাছের প্রমাণ করার উদগ্র বাসনা জাগে! মুশকিল হয় তখন। ২২ শ্রাবণ আর ২৩ এপ্রিল-এর মধ্যে বড় মিল হচ্ছে গুরুদেবের তথাকথিত ভক্তরা গুরুদেব চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে শবযাত্রায় তাঁর শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাড়ি, চুল উপড়ে নিল ‘স্মৃতিচিহ্ন’ হিসেবে কাছে রাখবে বলে। আর ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় চোখ বোজার পর অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘মানিকদা মানিকদা’ করে। এরা পারলে সত্যজিৎ নামটাকেই উপড়ে ফেলে!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এই উদাহরণগুলো কেন দিচ্ছি? আমার মনে হয়, আমাদের কেমন যেন একটা সাংস্কৃতিক দায় রয়েছে বলে আমরা বোধ করি, ফলে এমনভাবে নিজেদের সমাজের সামনে পেশ করার চেষ্টা করি, যার সঙ্গে আমার ভিতরটার কোনও মিল নেই। আমরা প্রত্যেকে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গিটার নিয়ে বইমেলায় পুলিশের লাঠি খেয়েছি, শক্তি-সুনীলদের জেল থেকে ছাড়িয়েছি, আর অবশ্যই মানিকদার বসার ঘরে বসে তাঁর শিঙাড়া খেয়েছি। আমার হয়েছে আরেক বিপদ, আমি কুইজে জিতি, কাগজে লিখি, চ্যানেলে বক্তৃতাও দিই। আমাকে দেখলে সবাই কত সাংস্কৃতিক সেটা প্রমাণ করতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। আমি ডেন্টিস্টের সামনে লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া নিয়ে মুখ হা করে কেলিয়ে পড়ে আছি। ওদিকে ডেন্টিস্টের তখন তোড় এসে গিয়েছে, সে হাত-পা ছুড়ছে, কৃত্তিবাস থেকে হাংরি– সব আলোচনার নিষ্পত্তি সেদিনই করবে সে। কী কষ্টে নিজের প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিলাম, তা কেবল আমিই জানি। একেবারে ‘দন্তরুচি কৌমুদি’ যাকে বলে আর কী!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে আরও লেখা: সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, গণেশ আদতে কর্মবিঘ্নের দেবতা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমি আবার বলছি, আপনারা ভুল বুঝবেন না, এমন একজন বিশাল মানুষ– তাঁকে প্রচুর লোক অবশ্যই চিনতেন। কিন্তু সবাই তাঁকে ‘মানিকদা’র পরিসরে চিনতেন না। আড্ডার সম্বন্ধে তাঁর নিজের কী ধারণা, তা তিনি ‘আগন্তুক’-এ বলেই গিয়েছেন। যে আড্ডায় বুদ্ধির চর্চা হয় না, কোনওরকম মানসিক বিকাশ হয় না সেই আড্ডা ওঁর কাছে অর্থহীন। এরপরও যে তিনি এতজনের ‘মানিকদা’, তা ত্রুফোর ছেলের পইতের মতোই এক বিস্ময়। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে এতে খুব রাগেরও কিছু নেই। এরকম মানুষকে কাছের ভাবতে কার না ভালো লাগে? আমাদের শৈশব, কৈশোর আচ্ছন্ন করে রাখা মানুষটা কি আদৌ দূরের কেউ? আমরা তো এক শহরে শ্বাস নিয়েছি। আমাদের আত্মীয়তার জন্য এটুকুই কি যথেষ্ট নয়? মানিকদার নাম করে এক পেয়ালা চা যদি সন্ধের দোকানে কেউ খাইয়ে দেয়, তাহলে মানিকদার তো কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। মানিকদা এমন একটা পরশ পাথর, যা আমরা গিলে নিয়েছি। এখন তা আর ছোট হচ্ছে না। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে সত্যজিৎ রায় নামটা আরও জ্বলজ্বল করে উঠছে। মানিকদা আমদের গরিব-গেরস্ত বাঙালির পিদিমের আলো, তার চৌকাঠ আমাদের হৃদয়টুকুই। সেখানেই সে নিজের মতো থাকুক, সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে, আমরা আবিষ্কার করি আমাদের মানিকদাকে, পৃথিবী চিনুক সত্যজিৎ রায়কে। ক্ষতি কী?
অভিনেতা হিসেবে অভিনয়ের যে জায়গাগুলো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা আমি আগেও বলেছি, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা, জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সাধারণ মানুষ যা প্রকাশ করতে পারে না চট করে। মনোজ মিত্র তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তাকে বড় করে দেখিয়েছেন।