ধরণী কান্ত লাহিড়ী চৌধুরী ১৩১৭ সালে ‘ভারত ভ্রমণ’ নামে একখানি বই প্রকাশ করেন। নানা তীর্থ পর্যটন করে যে অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে জমা পড়ে, তারই কথা সরল ভাষায় লিখেছিলেন। বিন্ধ্যাচল ভ্রমণ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা খুবই আকর্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘কংস হস্তভ্রষ্ট দেবীই তিনি– সে দুর্গম স্থানে ভক্তেরা সর্বদা যাইতে পারিবেন না বলিয়া দেবী ভক্তের প্রতি কৃপা করিয়া এই সমতল ক্ষেত্রের নিকটে এই স্থানে আবির্ভূতা হইয়া আছেন’।
১২.
‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’।
নিজের অসামর্থ্যকে আড়াল করতেই এমন কথা বলতে আমরা অভ্যস্ত। অথচ যে ঘটনাকে ঘিরে এমন কথার সূত্রপাত, কিংবা যার মুখে এমন কথা বসানো আছে, সেই ‘কংস হস্তভ্রষ্ট যশোদা গর্ভ সম্ভবা যোগমায়া’ কিন্তু আদ্যাশক্তি মহামায়া। বিষ্ণু অনন্ত শয়ানে যোগনিদ্রায় নিদ্রিত থাকাকালীন ইনিই দেবতাদের প্রার্থনায় ব্রহ্মাকে উদ্ধার করতে মধু-কৈটভ নামের অসুরদ্বয়কে নিধন করে সুরলোক ও তামাম সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি নিত্যা হয়েও দেবতাদের আহ্বানে বারবার নব নব রূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন, সেই অসীম শক্তিময়ী জগন্মাতা কিন্তু কংস নিধনেও অক্ষম ছিলেন না, তবু দেবকী গর্ভে আগত ভগবান বিষ্ণুর লীলা প্রকটের উদ্দেশ্যে আত্মসংযম দেখিয়ে এমন উক্তি করেছিলেন মাত্র।
কংস ছিলেন দেবকীর কাকার ছেলে। খুবই স্নেহের সম্পর্ক ছিল দু’জনের। খুব ধুমধামের সঙ্গে বোনের বিয়েতে আনন্দ করতে করতে হঠাৎ দৈববাণী শুনলেন কংস, ‘দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তান হবেন কংসের বিনাশের কারণ’। সঙ্গে সঙ্গে বন্দি করলেন বোন-ভগ্নীপতিকে। তারপর এক একবার গর্ভবতী হন দেবকী, আরও কঠোর হয়ে যান কংস। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই হত্যা করেন তাকে। কোনও ঝুঁকিই নিতে চাননি কংস। কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে, কারাগারে থেকেও কীভাবে গর্ভবতী হতেন দেবকী!
শশীভূষণ বিদ্যালঙ্কারের অবলম্বনে রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণ অভিধান’ থেকে জানা যায়, ‘দেবকী সপ্তমবার গর্ভধারণ করলে যোগমায়া সেই গর্ভ আকর্ষণপূর্বক রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করিলেন। যথাকালে রোহিণী বলরামকে প্রসব করিলেন। এদিকে দেবকীর সপ্তমগর্ভ নষ্ট হইয়াছে বলিয়া প্রচার করা হইল’। তার মানে কি ভ্রূণ প্রতিস্থাপন? হতেই পারে। এরপর দেবকীর অষ্টম গর্ভ ও একই কালে যশোদাও গর্ভবতী ছিলেন। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমী তিথির মধ্যরাতে জন্ম হল উভয় গর্ভস্থেরই। সে রাতে দুর্যোগের ঘনঘটা, প্রহরীরা নিদ্রাভিভূত, দেবকী ও বসুদেবের শৃঙ্খল আপনা আপনিই খসে গেল, কারাগারের দুয়ার হল উন্মুক্ত। বসুদেব কারাগার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে চললেন পথে, উত্তাল যমুনা হল দ্বিধাবিভক্ত, পথ যেন আপনিই দেখা দিল অপর পারের। নাগরাজ বাসুকী ছত্র বিস্তার করে শিশু ও শিশুর জনককে করকাপাতের থেকে রক্ষা করতে লাগলেন। নন্দ গোয়ালার বাড়িতেও কেউ জেগে নেই, বসুদেব ঢুকলেন আঁতুড়ঘরে, বদল করে নিলেন যশোদার কন্যাকে কোলে তুলে নিয়ে, পাশে শুইয়ে দিলেন নিজেদের সদ্যোজাত পুত্র কৃষ্ণকে। তারপর ফিরেও এলেন একই পথে, কারাগারের অন্তরালে।
পরদিন ভোর হতেই খবর গেল রাজ অন্তঃপুরে, দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ছুটে এলেন কংস, এখনই বিনাশ করতে হবে সেই সন্তান। কেড়ে নিলেন দেবকীর কোল থেকে, ধেয়ে গেলেন এক পাহাড় চূড়ায়, আছড়ে মেরে ফেলতে হবে সেই সন্তানকে নিজের হাতে, কাউকে বিশ্বাস নেই। মাথার ওপর তুলে আছাড় দিতে গেলেন, আর তখনই সেই আশ্চর্য ঘটনা, হস্তভ্রষ্ট হল শিশু, উড়ে চলল আকাশ পথে, যেতে যেতে বলে গেল, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’। হতভম্ব কংস কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলেন তার দিকে। দেবী যোগমায় সেই যে আকাশ পথে চললেন, তারপর এসে প্রকট হলেন বিন্ধ্যাচলে, বলেই কথিত।
একদিকে কাশী, আরেক দিকে ত্রিবেণী প্রয়াগের মধ্যে সুরধনী গঙ্গার তীরে বিন্ধ্যাচলের অবস্থান। অতি প্রাচীন এক শক্তিপীঠ, এখানে সতীর কোনও অঙ্গ বিশেষ পড়েনি, তবু মহামায়া এখানেই প্রকট হয়েছিলেন, আর তাই এটি এক অতি পবিত্র শক্তিপীঠ। বহু প্রাচীন হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে উল্লেখ আছে এই তীর্থের। রামায়ণ, মহাভারত, বামন পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, দেবীভগবত– এমন আরও অনেক বইতেই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী ও বিন্ধ্যাচলের উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত– দেবী মহিষমর্দিনী এখানেই বধ করেছিলেন মহিষাসুর আর তার সাঙ্গপাঙ্গ, সেনাপতি-সহ অগণ্য সেনাকে। প্রতিটি সেনাপতিকে হত্যা করার সময় তিনি পরিগ্রহ করেছিলেন ভিন্ন ভিন্ন রূপ। মহিষাসুরের সেনাধক্ষ্য শুম্ভ-নিশুম্ভকে হত্যা করেন দেবীর দেহকোশ-সঞ্জাত মূর্তি কৌষিকী, আবার মণ্ড ও মুণ্ডের বিনাশকারী দেবী চামুণ্ডা নামে পরিচিতা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একদিকে কাশী, আরেক দিকে ত্রিবেণী প্রয়াগের মধ্যে সুরধনী গঙ্গার তীরে বিন্ধ্যাচলের অবস্থান। অতি প্রাচীন এক শক্তিপীঠ, এখানে সতীর কোনও অঙ্গ বিশেষ পড়েনি, তবু মহামায়া এখানেই প্রকট হয়েছিলেন, আর তাই এটি এক অতি পবিত্র শক্তিপীঠ। বহু প্রাচীন হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে উল্লেখ আছে এই তীর্থের। রামায়ণ, মহাভারত, বামন পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, দেবীভগবত– এমন আরও অনেক বইতেই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী ও বিন্ধ্যাচলের উল্লেখ পাওয়া যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিন্ধ্যাচলে দেবী মহাকালী রূপে পূজিতা হয়ে থাকেন। কালীখোহ মন্দিরে তাঁর সেই মূর্তির অধিষ্ঠান। এই মন্দিরে দেবী মুখব্যাদন করে আছেন। গল্পটা হল, রক্তবীজকে হত্যা করে তার রক্ত যাতে মাটিতে না পড়ে, তাই দেবী বদন বিস্তার করে একটানা সেই শোণিত পান করতে হয়। এই রক্তপান করে দেবীর শরীরে তীব্র প্রদাহ জন্মায়। ভক্তেরা দেবীর বিস্তৃত মুখ বিবরে শীতল পানীয়, নারকোলের জল দিয়ে তাঁর দাহ প্রশমন করেন। দশভূজা মহিষমর্দিনী, অষ্টভূজা কালী ও সরস্বতী এই পরিক্রমা অত্যন্ত পবিত্র কৃত্য বলেই মনে করেন ভক্তদল।
কবে এবং কে এই মন্দির প্রথম গড়ে ছিলেন তা অবশ্য জানা যায় না, তবে অতীতে যে এই অঞ্চলে বহু সংখক মন্দিরের অবস্থান ছিল, তা অবশ্য জানা যায়। মুসলমান আমলে একাধিকবার ওইসব মন্দির আক্রান্ত ও বিনষ্ট হয়। অথচ ঐতিহাসিক ভাবে জানা যায়– হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ওই মন্দিরে, বিশেষ করে কালীখোহ মন্দিরে পূজা দিতেন। ধরণী কান্ত লাহিড়ী চৌধুরী ১৩১৭ সালে ‘ভারত ভ্রমণ’ নামে একখানি বই প্রকাশ করেন। নানা তীর্থ পর্যটন করে যে অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে জমা পড়ে, তারই কথা সরল ভাষায় লিখেছিলেন। বিন্ধ্যাচল ভ্রমণ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা খুবই আকর্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘কংস হস্তভ্রষ্ট দেবীই তিনি– সে দুর্গম স্থানে ভক্তেরা সর্বদা যাইতে পারিবেন না বলিয়া দেবী ভক্তের প্রতি কৃপা করিয়া এই সমতল ক্ষেত্রের নিকটে এই স্থানে আবির্ভূতা হইয়া আছেন’। বিধর্মীদের হাতে প্রায় সমস্ত মন্দিরই ধ্বংস হয়ে গেলে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে রানি অহল্যাবাই বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করিয়ে দেন।
এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথাও তিনি জানিয়েছেন, অতি বীভৎস ভাবে প্রচুর সংখ্যায় এই মন্দিরে ছাগ বলি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ছোট্ট ছাগ শিশু বলি দেওয়ার প্রথা, এবং সেইজন্য কোনও যূপের ব্যবস্থাও ছিল না। ‘পান্ডারা বলিলেন, দেবী শিশু মাংসেরই লোলুপা, তাঁহারই প্রত্যাদেশে স্মরাণাতীত কাল হইতে এই মন্দিরে এই প্রথা চলিয়া আসিতেছে’। শিশু বলতে অবশ্যই ছাগ শিশুর কথা বলা হয়েছে, এমনকী মাত্র দু’দিন আগে জাত ছাগ শিশুও এখানে বলি দেওয়া দেখেন তিনি। এমনিতে পর্বত (আদতে টিলা বলাই ভালো) ওপরে, গঙ্গা নদীর সন্নিকটে মন্দিরটির অবস্থান বলেই প্রাকৃতিক দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। তবে এক সময়ে এই অঞ্চলে ঠগীদের প্রাদুর্ভাব ছিল বলেই জানিয়েছেন লাহিড়ী মশাই।
এই কথার সমর্থন মেলে উইলিয়ম স্লিম্যানের লেখাতেও। খুব অদ্ভুত এক তথ্য পাওয়া যায় স্লিম্যানের, ‘The Thugs or Phansigars of India’ বইতে। তিনি লিখেছেন, ‘Though the Phansigars are almost all Mussulmans, they have nevertheless universally adopted, on certain occasions, the idolatrous worship of Hindu deities, Cali or Marriatta (the goddess of small pox of the Carnatics) is regarded as their tutelary deity and is the object of their adoration’. মুসলমান হয়েও শুধু দস্যুরাই যে কালীভক্ত ছিলেন এমনটাই নয়, অনেক সাধারণ মুসলমানও কালীভক্ত ছিলেন, কারণ দু’-তিন প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষদের অনেকেই হিন্দু ছিলেন। সংস্কারগতভাবে হিন্দু দেবতাদের সম্পর্কে তাঁদের ভয়ভক্তি পুরোপুরি উধাও হয়ে যেতে আরও বেশ কয়েক প্রজন্ম লেগে গিয়েছিল। তবে একথাও সত্যি যে, যে কোনও ডাকাত বা দস্যুদলের সদস্যদের কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা ও বলিদান-সহ কালীপূজার ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। নরবলি দেওয়াও বিশেষ ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল না।
নিয়মিত ভাবে কাশী বিশ্বনাথ দর্শন করে যাত্রীরা বিন্ধ্যাচলে বিন্ধ্যবাসিনী ও এলাহাবাদে প্রয়াগতীর্থ দর্শন করার রীতি হিন্দু তীর্থযাত্রীদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। তবে এই স্থানটির গুরুত্ব শুধু তীর্থক্ষেত্র হিসেবেই নয়। ১৯২৫ সালের ৯ জুন মহাত্মা গান্ধী এখানে এসে এক জনসভায় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অহিংস আন্দোলনের ডাক দিলে ক্রমে মির্জাপুর ও সংলগ্ন অঞ্চলে অদ্ভুত উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। তবে সেই অতীত স্মৃতির চেয়েও এই এলাকার ধর্মীয় আকর্ষণ আজও অমলিন। বিষ্ণুপূজন থেকে কৃষ্ণ ভজনার পথে একদা ভারত এগিয়ে গেলেও তার প্রাচীন মাতৃকা পূজার রীতির সঙ্গে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে যে উদ্যোগ নানা সময়ে নেওয়া হয়েছিল, তারই সাক্ষ্য বহন করে চলে এই মন্দির।
(চলবে)
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১১। বৈজু গোয়ালা যেভাবে পেয়েছিল শিবের দর্শন
পর্ব ১০। নবদ্বীপ বরাবর সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র, সেই সমাহার আজও বর্তমান
পর্ব ৯। দেবী কামাখ্যার পুজোর নেপথ্যে রয়েছে আদিবাসীদের কৃষিকাজের উৎসব
পর্ব ৮। শতবর্ষ আগে বাংলার প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারকেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে
পর্ব ৭। বামাক্ষ্যাপার টানে তারাপীঠে এসেছিলেন বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
পর্ব ৬। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন যাত্রীরা
পর্ব ৫। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে ‘শতমুখী’ হয়েছিল গঙ্গা
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব