মা দিবসের পরের দিন চোখে পড়ল সংবাদমাধ্যমে এক প্রতিবেদন– তৃতীয় সন্তানের জন্মের পর মেটারনিটি লিভে না, সমালোচনার মুখে এএআই (এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া)। খবরটি পড়ে একদমই চমকে যাইনি, অত্যন্ত স্বাভাবিক নিত্যনৈমিত্তিক এক স্ট্রাগল চাকুরিরত মায়েদের জীবনে। নিজে ভুক্তভোগী বলেই জানি, মেটারনিটি ও চাইল্ড কেয়ার লিভ হল দুটো বিষম বস্তু অফিস, স্কুল, বা যেকোনও প্রতিষ্ঠানের বসদের ক্ষেত্রে, এতটাই বিষম যে, কোনও মহিলা কর্মচারী গর্ভবতী শুনলে তাদের নিজেদের মধ্যে পীড়া শুরু হয়।
প্রচ্ছদ: সোমোশ্রী দাস
গত ১২ মে সামাজিক মাধ্যমে আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হল ‘মা দিবস’। সামাজিক মাধ্যমের সুকল্যাণে এখন মা, বাবা, খুড়ো, খুড়ি, চুমু, সহবাস– সব দিবস ফেসবুকীয় উন্মাদনায় উদযাপিত হয়। তাতে অবশ্য সেই দিবসগুলো সম্পর্কে মানুষের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় হয় কিংবা কেক কাটা হয়, কিন্তু প্রদীপের নিচে যে অন্ধকার তা যে তিমিরে, সেখানেই পড়ে থাকে। সে অন্ধকার আরও ঘন হয়।
মা দিবসের পরের দিন চোখে পড়ল সংবাদমাধ্যমে এক প্রতিবেদন– তৃতীয় সন্তানের জন্মের পর মেটারনিটি লিভে না, সমালোচনার মুখে এএআই (এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া)। খবরটি পড়ে একদমই চমকে যাইনি, অত্যন্ত স্বাভাবিক নিত্যনৈমিত্তিক এক স্ট্রাগল চাকুরিরত মায়েদের জীবনে। নিজে ভুক্তভোগী বলেই জানি, মেটারনিটি ও চাইল্ড কেয়ার লিভ হল দুটো বিষম বস্তু অফিস, স্কুল, বা যেকোনও প্রতিষ্ঠানের বসদের ক্ষেত্রে, এতটাই বিষম যে, কোনও মহিলা কর্মচারী গর্ভবতী শুনলে তাদের নিজেদের মধ্যে পীড়া শুরু হয়। অতি পীড়িত পুরুষ বস কিংবা পুরুষ কলিগ তো বলেই ফেলেন– ‘ইসস, যদি মহিলা হতাম, ছয় মাস বাচ্চা হওয়ার ছুটি পেতাম আর তারপর বাচ্চার ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত চাইল্ড কেয়ার লিভ তো আছেই!’ ভাবখানা এমন– এসব ছুটি নিয়ে চাকুরিরত মায়েরা যেন হাওয়া খেয়ে বাড়িতে আরাম করেন।
‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভ’-এর এক রিপোর্ট (২০১৯) অবশ্য বলছে, একজন পুরুষ যেখানে বাচ্চার দেখাশোনার জন্য ব্যয় করেন ৭৪ মিনিট, সেখানে একজন মহিলা ব্যয় করেন ১৩৪ মিনিট। এ তো গেল আনপেইড লেবার, আর সেই মহিলা যদি বেতনভুক্ত কর্মচারী হন, তবে সেই সময় নিঃসন্দেহে হবে বহুগুণ বেশি। নিচে ‘দ্য প্রিন্ট’-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টের ডাটা তুলে দেওয়া হল:
দুটো সন্তানের বা একটি সন্তানের মা হিসেবে যেখানে ছুটি চাইতে এই দশা, সেখানে তিন সন্তানের মা হলে ছুটি পাওয়া এই পিতৃতান্ত্রিক দেশে মুশকিল হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কনকাবলি রাজা আরমুগম নামে এএআই-এর এক মহিলা কর্মী মামলা করেছিলেন এই মর্মে যে, তৃতীয় সন্তানের জন্মের সময় তিনি মেটারনিটি লিভ চেয়েও পাননি। এএআই-এর নিজস্ব নিয়মে দু’জন সন্তানের অধিক সন্তানের জন্মের সময় মেটারনিটি লিভ পাওয়া যায় না। যদিও কনকাবলি জানিয়েছেন, তাঁর প্রথম পক্ষের বিয়েতে একটি সন্তান থাকলেও তিনি সেই সন্তানের জন্মের সময় মাতৃত্বকালীন ছুটি নেননি। স্বস্তি একটিই যে, কোর্ট কনকাবলির পক্ষে রায় দিতে গিয়ে বলেছে–
“সংবিধানের ৪২ নং ধারায় মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে মানবিক ব্যবহার ও মেটারনিটি লিভ নিশ্চিত করা হয়েছে। কনকাবলি যেহেতু একটিই মেটারনিটি লিভ নিয়েছেন তাই আরেকটি তাঁর প্রাপ্য ছিল। এক্ষেত্রে তাঁর ক’টি সন্তান ও ক’টি বিয়ে সেটি দেখা কর্তৃপক্ষের কাজ নয়।”
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: স্বামীর পদবি ব্যবহার না করতে চাইলে লাগবে স্বামীরই অনুমতিপত্র!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রশ্ন থেকেই যায়, তাহলে কোনও মহিলা কর্মচারীর তিনটি সন্তান হলে তিনি কি তিনটের জন্যই মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন না?
একটি পিতৃতান্ত্রিক দেশে যেখানে এখনও বাচ্চা পালন থেকে গৃহস্থালির সমস্ত দায়দায়িত্ব ‘মহিলাদের কাজ’ বলে মনে করা হয়, সেখানে বেতনভোগী কর্মরতা মহিলাদের ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও চাইল্ড কেয়ার লিভ হল কাজ চালিয়ে যেতে পারার জন্য অত্যন্ত জরুরি দুটো ছুটি। বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে গালভরা ভাষণ দেওয়া রাষ্ট্র যখন একজন কর্মরতা মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরিতে ব্যর্থ। কর্মক্ষেত্রে কাজ আর তারপর বাড়িতে ফিরে গৃহস্থালির কাজ– বেতনভোগী কর্মরতা মহিলারা দ্বিগুণ শোষিত। সঠিক পরিকাঠামো তৈরি না করে মহিলাদের বাইরের কাজের বাজারে প্রবেশ মানেই তাকে দ্বিগুণ শোষণের দিকে ঠেলে দেওয়া। তাই অফিস ফেরত মহিলা লোকাল ট্রেনেই রাতের খাবারের জন্য সবজি কাটতে বসেন। কেউ কেউ না পেরে কাজটাই ছেড়ে দেন। আর কোনও পুরুষ কলিগ চাকুরিরত মহিলাকে বিয়ে করেছে শুনে অন্য পুরুষ কলিগের মন্তব্য ভেসে আসে, ‘বাহ্, দুধেলা গাই পাচ্ছ তো!’ হ্যাঁ, এই মানসিকতা নিয়েই কর্মস্থলে কাজ করেন মহিলারা। এঁদের অনেকেরই এটিএম কার্ড থেকে টাকার হিসেব সবই থাকে তাঁদের স্বামীদের কাছে। পাঠক চমকে যাবেন না, এটাই বাস্তব।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এএআই-এর নিজস্ব নিয়মে দু’জন সন্তানের অধিক সন্তানের জন্মের সময় মেটারনিটি লিভ পাওয়া যায় না। যদিও কনকাবলি জানিয়েছেন, তাঁর প্রথম পক্ষের বিয়েতে একটি সন্তান থাকলেও তিনি সেই সন্তানের জন্মের সময় মাতৃত্বকালীন ছুটি নেননি। স্বস্তি একটিই যে, কোর্ট কনকাবলির পক্ষে রায় দিতে গিয়ে বলেছে– “সংবিধানের ৪২ নং ধারায় মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে মানবিক ব্যবহার ও মেটারনিটি লিভ নিশ্চিত করা হয়েছে। কনকাবলি যেহেতু একটিই মেটারনিটি লিভ নিয়েছেন তাই আরেকটি তাঁর প্রাপ্য ছিল। এক্ষেত্রে তাঁর ক’টি সন্তান ও ক’টি বিয়ে সেটি দেখা কর্তৃপক্ষের কাজ নয়।”
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই শোষিত মহিলাদের কাছে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও চাইল্ড কেয়ার লিভ হল টিকে থাকার অক্সিজেন। কোনও লাক্সারি নয়। আর যেখানে নিজের কষ্টার্জিত টাকার হক মেয়েদের থাকে না, সেখানে মেয়েদের ক’টি সন্তান হবে সেটার সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারও মেয়েদের থাকে না সবসময়। সংসার, পরিবারের পাওয়ার পলিটিক্সের বিরুদ্ধে স্বর ওঠানোর ক্ষমতা রাষ্ট্রের গালভরা ক্ষমতায়ন শব্দটি দেয় না। ক্রেশের অভাবে কর্মরতা মহিলাদের, তাঁদের অনুপস্থিতিতে বাচ্চা দেখাশোনার জন্য নির্ভর করতে হয় বাড়ির লোকজনদেরই ওপর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ঋতুকালীন সবেতন ছুটি মহিলাদের উৎপাদনমূলক শ্রমেরই অংশ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এমবিএ অর্থাৎ মেটারনিটি বেনিফিট এক্ট-এ (২০১৭) ৫০ জনের বেশি কর্মচারী থাকা কোম্পানিগুলোর জন্য কর্মস্থলে ক্রেশ-এর ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু ২০২৪-এ পৌঁছে কতগুলো কোম্পানি এই আইন মেনেছে? আমরা জানি না। আর যাঁরা কোম্পানিতে চাকরি করেন না, দূরদূরান্তে কোনও গ্রামে বা শহরে চাকরি করেন, তাঁদের বাচ্চাদের দেখবে কে? আর যাঁরা সিঙ্গল মাদার? সেই একাকিনী মায়েদের বাচ্চাদের জন্য ক্রেশ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমাদের কথা শোনার জন্য রাষ্ট্র এবং তার বসদের না আছে মন, না আছে সংবেদনশীলতা। ছুটি চাইতে গেলেই কর্মচারীদের শুনতে হয়, ‘আপনি ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকলে, কর্মস্থলে কাজ করবে কে?’ খুবই জরুরি প্রশ্ন। একজন কর্মী দীর্ঘদিন ছুটিতে থাকলে তাঁর প্রভাব কাজের জায়গায় পড়বে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটার দায় তো শুধু ছুটি চাইতে আসা কর্মচারীর হতে পারে না। সেটা নিয়ে আলোচনা হোক। রাষ্ট্র বিকল্প ভাবনা ভাবুক, কিন্তু মহিলা-কর্মীদের ছুটির অধিকার থেকে বঞ্চিত না করে।
আসলে মহিলা-কর্মীদের ছুটি না দেওয়া, ছুটি না দিতে চাওয়া, ছুটি চাইতে এলে উষ্মা প্রকাশ করা একটি মানসিকতা। এই মানসিকতা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, চলছে চিরকাল। পিতৃতন্ত্ৰ এর সঙ্গে এর দারুণ বোঝাপড়া। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অধিকার ও সেই মহিলাদের শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু সেই রাষ্ট্রই যদি ডুবে থাকে পিতৃতন্ত্ৰ এর আফিমে? সে রোগ সারাবে কে?