কী ছবি আঁকতেন জয়নুল আবেদিন? এঁকেছেন মানুষ। জীবনযাপন, প্রকৃতি, প্রাচুর্য, দারিদ্র। কৃষি কাজ, নৌকা, গরুর গাড়ি, গরু-ছাগল, ঝড়ের ছবি আর আগুন। এঁকেছেন জীবনসংগ্রামের ছবি আর বাঙালির স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা। মন্বন্তরে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কঙ্কালসার মানুষ অথবা ডাস্টবিনে খাবারের সন্ধানে কাকেদের সঙ্গে। একটাই শর্ত, ছবিকে হতে হবে ঐশ্বর্যময়। মরা পাখিটিও যদি আঁকো, তাকে যেন সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা যায়।
গত শতকের চারের দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সারা পৃথিবী বেসামাল। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বাংলা সাহিত্যে সূচিত হল এক বিপুল পরিবর্তন। সাহিত্যকর্মের সীমানা নির্দিষ্ট পরিসরের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে গেল। সাহিত্যের এলাকায় উঠে এল দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ। ধনীদের রাজনীতি। সাধারণ মানুষেরও রাজনীতি চেতনা। রবীন্দ্রনাথ নেই। তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতি– এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তখন বাংলা সাহিত্যের দায়িত্বভার। অন্যদিকে শিল্পকলার এলাকায় যাঁদের নাম প্রথম সারিতে তাঁদের থেকে একটা নাম বেছে নিলাম, তিনি শিল্পী জয়নুল আবেদিন। আজকের আলোচনার নায়ক। তেতাল্লিশের মন্বন্তর প্রসঙ্গে আজ জয়নুল আবেদিনের কথা বলব, যার বহু ছবিতে ধরে রাখা আছে সেই মন্বন্তরের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণা। তাঁর শিল্পের আলোয় আমরা আর একবার পিছনে ফিরে দেখে নিতে চাই ছবির নান্দনিকতা, বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিত আর দর্শকের অনুভূতির খুঁটিনাটি।
টেবিলে আমার সামনে প্লেটে টেম্পুরা ব্যাটারে ভাজা সার্ডিন মাছ আর ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। ডানদিকে আইপ্যাড। পশ্চিমে আরব সাগরের কাছে, স্বচ্ছল পরিবেশে পড়ন্ত বিকেলে আমি আইপ্যাডে লিখতে বসেছি তেতাল্লিশের মন্বন্তরের কথা। মানে সেই সময়টার ছবিটা আর একবার ধরতে চেষ্টা করছি বলা ভালো। সময় কত দ্রুত আলাদা হয়ে যায়। তেতাল্লিশের মন্বন্তর বলতে ১৯৪৩ সালে বাংলার সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বাংলায় সেটা ১৩৫০, তাই ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামেও পরিচিত। ৩০ লক্ষেরও বেশি (যদিও দুর্ভিক্ষের সময় মারা যাওয়া ব্যক্তির সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে নানা মত রয়েছে) সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ যখন মারা যাচ্ছে অনাহারে, তখনকার সেই বিষয় সাহিত্য, শিল্পকলার ফ্রেমে এনে চিন্তা করাও তো চট করে হয় না। একটু কেমন যেন গুরুচণ্ডালী মনে হয়। তবে আমাদের অনুভূতি এখনও অনেকটা ভোঁতা হয়ে যায়নি আর কৌতূহলেরও শেষ নেই।
………………………………………………………………………..
আজকাল আমরা অবাক হতে ভুলে গিয়েছি। সহজেই আর অবাক হই না সব কিছুতে। আনন্দ হয় না আনন্দের গান শুনে। হাসিও পায় না সহজ কৌতুকে। রাগমালা সিরিজের ছবি দেখলে দর্শকের মনে কি সংগীতের সুর আসে কিংবা মনে আসে ভোরবেলা, আধো অন্ধকার, রৌদ্রদগ্ধ দুপুর কিংবা গোধূলি অথবা মধ্যরাতের নীরবতা? ‘মেঘ মল্লার’ নামটা শুনলে কি বৃষ্টি নামে মনে? কখনও বা শীতলতা কিংবা আগুন?
………………………………………………………………………..
আজকাল আমরা অবাক হতে ভুলে গিয়েছি। সহজেই আর অবাক হই না সব কিছুতে। আনন্দ হয় না আনন্দের গান শুনে। হাসিও পায় না সহজ কৌতুকে। রাগমালা সিরিজের ছবি দেখলে দর্শকের মনে কি সংগীতের সুর আসে কিংবা মনে আসে ভোরবেলা, আধো অন্ধকার, রৌদ্রদগ্ধ দুপুর কিংবা গোধূলি অথবা মধ্যরাতের নীরবতা? ‘মেঘ মল্লার’ নামটা শুনলে কি বৃষ্টি নামে মনে? কখনও বা শীতলতা কিংবা আগুন? একটা কেমন ভার্চুয়াল রিয়ালাটির মধ্যে আমরা আপাতত। টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদে রিয়াল টাইমে একটি মানুষকে হত্যা করার দৃশ্য দেখেও সেটাকে সিনেমা বলে উড়িয়ে দিই, বরং ক্যামেরাম্যানের দক্ষতার প্রশংসা করি। রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে চলে যাই নাচের দৃশ্যে কিংবা সুস্বাদু খাবারের চ্যানেলে।
ছবি বা শিল্পকলা দেখে মানুষ ভয় পায়? ছবি দেখে, ভয়ের গল্প শুনে, সিনেমা দেখে ভয় পাওয়া যায় না আজকাল। পিকাসোর ‘গ্যেরনিকা’ দেখে আমাদের তো ভয় হয় না। মনে হয় একটি বুদ্ধিমান শিল্পীর মস্তিষ্কপ্রসূত যুদ্ধের ডিজাইন। আমরা আসলে বহুকাল ধরে ভীষণ সুখী এবং সুরক্ষিত। ভয় পেতে হলে একটা ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। ভয় যাপন। চাই একটা বড় ধাক্কা, একটা ভয়ানক ভয়। মহামারী, অতিমারী, মন্বন্তর, দুর্যোগ কিংবা যুদ্ধ। একটা ভয় পাওয়ার সুযোগ সাম্প্রতিককালে এসে চলে গেল আমাদের জীবনে। সত্যিকারের ভয়। ভয় দেখাল ‘করোনা ভাইরাস’। বোঝা গেল মানুষের প্রকৃত রূপ, তার স্বরূপ। কিন্তু তেমন শিল্প বা সাহিত্য হল কই! না কি মানুষ বুঝে গিয়েছিল, এ মানুষেরই তৈরি ভয় পাওয়ানোর খেলা। তবে হ্যাঁ, মগজ থামেনি, থামেনি সৃজনশীলতা, ঝড় বয়ে গেছে আধুনিক প্রযুক্তির। ডিজিটাল আর বেতার তরঙ্গে বিরামহীন যাতায়াত। বলতে গেলে ‘এ.আই’ যুগের সূচনা। মানুষের তৈরি মহামারী, মন্বন্তর বলতে সত্যজিৎ রায়ের ছবির কথা মনে পড়ছে। ‘অশনি সংকেত’। ‘গণশত্রু’। প্রথমটি মন্বন্তরে প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম। দ্বিতীয়টি উনিশ শতকের একটি নাটক। ইবসেন ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’ নাটকটি লিখেছিলেন ১৮৮৭ সালে। বিশ শতকের ছবি ‘গণশত্রু’ আর আজ একুশ শতকেও কত প্রাসঙ্গিক! এখনও কিছু মানুষের লোভ, অন্ধ বিশ্বাস ও স্বার্থপর মানসিকতার কারণে এখনও ভুক্তভোগী হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ। মহৎশিল্পের কাজ কিন্তু মানুষকে জাগানো, সচেতন করা।
কী ছবি আঁকতেন জয়নুল আবেদিন? এঁকেছেন মানুষ। জীবনযাপন, প্রকৃতি, প্রাচুর্য, দারিদ্র। কৃষি কাজ, নৌকা, গরুর গাড়ি, গরু-ছাগল, ঝড়ের ছবি আর আগুন। এঁকেছেন জীবনসংগ্রামের ছবি আর বাঙালির স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা। মন্বন্তরে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কঙ্কালসার মানুষ অথবা ডাস্টবিনে খাবারের সন্ধানে কাকেদের সঙ্গে। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার জন্যই বিশেষ খ্যাতি। গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে আঁকেন বিখ্যাত ৬৫ ফুট দীর্ঘ ছবি ‘নবান্ন’ ১৯৭০ সালে। শুধু তুলির টানে কেবলমাত্র কালো কালিতে আর জলরঙে আঁকা নবান্ন। বিশেষ কোনও ঘটনা বা দুর্যোগে বিভিন্ন সময়ে এঁকেছেন বড় বড় আরও অনেক ছবি। আমাদের পরিচিত শিল্পী রফিকুন নবীর কথায়–উনি যে শিল্পচর্চা করতেন, তার মূল ক্ষেত্র ছিল মানবতা। তাঁকে ‘মানবতার শিল্পী’ বলা হয়। সে কারণে বিশ শতকে আধুনিক চিত্রকলা চর্চার যে জগৎ, সে সবের মধ্যে পুরোপুরি না গিয়ে তিনি আমাদের দেশ, এই অঞ্চল, এখানকার মানুষ, প্রকৃতি– এসব নিয়ে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন দুঃখ-কষ্ট, অভাব অনটন নিয়ে। শুরুটা সেই তেতাল্লিশের মন্বন্তরে।
আমি জয়নুল আবেদিনের ছবি দেখেছি প্রদর্শনীতে। বিখ্যাত সেই মন্বন্তরের চিত্রমালার কিছু কাজ। মনে পড়ছে একটি ছবি। নদীর জলে ভেসে চরে এসে ঠেকেছে মরা গরুটির লাশ। পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। হয়তো-বা কাছে গেলে পচা দুর্গন্ধ নাকে এসে ঠেকবে। ছবিটা বেশ বড়। কেবলমাত্র তুলির টানেই সরু এবং মোটা দাগের কালো রঙে আঁকা একটা ড্রইং। গায়ে কাঁটা দেওয়া, গোল আর চ্যাপটা তুলির প্রয়োগ দেখেছিলাম, যেটা এখনও ভুলিনি। রেখার শক্তিই কি ছবি, নাকি সঠিক সাইজ? এ সরল সত্যিটা লোককে বলে দিতে হবে না। একটাই শর্ত, ছবিকে হতে হবে ঐশ্বর্যময়। মরা পাখিটিও যদি আঁকো, তাকে যেন সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা যায়। সে যেন অলংকৃত করে বিশ্ববিখ্যাত কোনও মিউজিয়ামের দেওয়াল।
এইখানে একটা প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়। যেমন দেখা তেমন আঁকার কি কোন মূল্য নেই? সেটা কোনও শিল্পকর্মই নয়? তবে কীভাবে জয়নুল আবেদিন তাঁর শিল্পের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন? সত্যিকারের যা কিছু আমাদের সামনে, তারও আছে দারুণ দৃশ্যশক্তি, নিজস্ব রূপের ক্ষমতা। কখনও সে কোনও মস্ত ঘটনার সাক্ষ্য কিংবা সময়ের দলিল। ‘ছবি আঁকতে হলে নৌকার কাছে যাও, নদীর কাছে। ভালো করে, মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। তোমার চোখ, মন, হৃদয় সব শিল্পের মধ্যে ঢেলে দাও। ছবি আপনা থেকেই সুন্দর হয়ে উঠবে’– একথা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের। আসলে যা তিনি বলেননি তা হল– শিল্পীর মনের যে সাহস, ইচ্ছা, আক্রোশ, মানসিক শক্তি তা তার হৃদয়ে জারিত হয়ে, হাত বেয়ে তুলির রেখায় মূর্ত হয় পটে। প্রকাশিত সে রেখায় থাকে তাঁর বোধের, তাঁর চেতনার সঞ্চিত শক্তি। যার সংক্রমণ ঘটে দর্শকের হৃদয়ে। ছবি হয়ে ওঠে ঐশ্বর্যময়।
জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস’-এর ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক। দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে যান। দেশে ফিরে ১৯৪৮ সালে শুরু করেন সরকারি আর্ট ইন্সটিটিউট। স্থানান্তরিত হতে হতে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে এটি একটি প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এর নাম হয় পূর্ব-পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’। চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রয়োজন ছিল। তখন পশ্চিম পাকিস্তানে লাহোরে পুরনো ন্যাশনাল আর্ট কলেজ ছিল কিন্তু ঢাকায় কোনও আর্ট কলেজ ছিল না। শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করতে হলে ছাত্রছাত্রীদের দিল্লি, কলকাতা, মাদ্রাজ, বম্বে, যেতে হত। নিজের দেশে ঢাকা এবং চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে শিল্পচর্চার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের চিত্রকলার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জনক জয়নুল আবেদিন। তিনি ১৯৭৫ সালে অর্জন করেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকদের মর্যাদা। মানুষের মানবিকতার, মানসিকতার যে রুচির অভাব সেটাকেও তিনি বারবার মনে করছেন। মৃতপ্রায় সমাজে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন সর্বদা। তাঁর বাণী– ‘এখনো তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনও ছবি হয়না।’ শিল্পকলাকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আদরণীয় করা, মানুষের মধ্যে শিল্পকলার বোধজাগ্রত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনেক। অসংখ্য শিল্পপ্রেমীর কাছে, তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ে তিনি ‘শিল্পাচার্য’। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
……………………………………………………………………………..
সমীর মণ্ডলের আরও লেখা:
কাঠ খোদাইয়ের কবি, আমার শিক্ষক হরেন দাস
ড্রইং শুরু করার আগে পেনসিলকে প্রণাম করতে বলেছিলেন
মারিও মিরান্ডার ছবির দেশে জনসংখ্যা খুব বেশি
জীবন জোড়া কাজের ‘খসড়া খাতা’ শৈশবেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল মাণিদার
……………………………………………………………………………..