ক্লাস সেভেনে পরিচয় হয় অরণ্যদেব, বাঁটুল দি গ্রেট– ইত্যাদির সঙ্গে, যা সে বয়সে স্বাভাবিক। কিন্তু তার পাশাপাশি আমি পড়ে ফেলেছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কির ‘আমার ছেলেবেলা’। একটা ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পেয়েছিলাম সেই বই। শিল্পই কি আমাকে নিয়ে গেল না তবে মানুষের কাছে? চিনিয়ে দিল না, কী বই পড়তে হবে? কোন চেতনার কথা বলতে হবে? জানিয়ে কি দিল না আমার মানচিত্র মোটেই ছোট না?
১৪.
আমার আছে মানবধর্ম। আমি চাই মানুষ বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু। আমি বিশ্বাসী সেই মানুষে, সেই কবীর সুমনের গানে। আমার মধ্যে তাই মানুষের কাছে যাওয়ার বাসনা। যেভাবে পথ যায় নির্ধারিত গন্তব্যে। যেভাবে সূর্যমুখী তাকায় সূর্যের দিকে। সেই আলোই মানুষ। আমি তার কাছেই উজাড় করে দিতে চাই। সেখানে, তো কোনও লিঙ্গবোধ নেই। এই পৃথিবীতে কোনও লিঙ্গের কাছেই কোনও লিঙ্গকে যেন পরাজিত না হতে হয়। কোনও মানুষের কাছেই কোনও মানুষকে। শিল্প সবসময় সেকথাই বলবে। শিল্পের কাজ মিলিয়ে দেওয়া, মিশিয়ে দেওয়া। জনস্রোতে যেভাবে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কিন্তু এই চেতনা আমি কোথা থেকে পেয়েছি? এসব কি বানিয়ে বলছি? আপনাদের ভালো লাগবে বলে? না। তাহলে ছেলেবেলার দু’-একটা ঘটনার কাছে ফিরে যাই।
ক্লাস সেভেন-এইট। রবিঠাকুরের গান সেইভাবে বোঝার আগে, কানে আরও তীব্রতর হয়ে ঢুকে পড়েছিল সলিল চৌধুরীর গান। ঢুকে গিয়েছিল পিট সিগারের গান। উই শ্যাল ওভারকাম-ও। ক্লাস সেভেনে পরিচয় হয় অরণ্যদেব, বাঁটুল দি গ্রেট– ইত্যাদির সঙ্গে, যা সে বয়সে স্বাভাবিক। কিন্তু তার পাশাপাশি আমি পড়ে ফেলেছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কির ‘আমার ছেলেবেলা’। একটা ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পেয়েছিলাম সেই বই। শিল্পই কি আমাকে নিয়ে যায়নি তবে মানুষের কাছে? চিনিয়ে দিল না, কী বই পড়তে হবে? কোন চেতনার কথা বলতে হবে? জানিয়ে কি দিল না আমার মানচিত্র মোটেই ছোট না? এই ভারতেই ফুরিয়ে যায় না একজন শিল্পীর দেশ। শিল্পী দেশহীন। মানচিত্র মুছে ফেলার ইরেজার তার কাছে আছে।
এই বই পুরস্কারের বছরেই আমার মাস্টারমশাইরা একটা পুজোয় থার্মোকলের ঠাকুর করেছিলেন, যেখানে প্রতিমাগুলোর মুখ কেউ কাটতে পারছিল না। আমি কেটেছিলাম। সাম্মানিক স্বরূপ পেয়েছিলাম ১২৫ টাকা। বিরাট টাকা তখন সেটা! কী করব? না, উড়িয়ে দিইনি। আমি, আমার মাস্টারমশাই সমীর ভট্টাচার্য, দাদা প্রশান্ত শীল– তিনজন মিলে গিয়েছিলাম বাগবাজার সর্বজনীনে। মস্কো প্রকাশনার স্টল থেকে কিনেছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কিরই ‘পৃথিবীর পথে’, ‘পৃথিবীর পাঠশালা’। জন রিডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’। নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির ‘ইস্পাত’। এগুলোও কি আমার একার জন্য? না, সবার জন্য। আমার সঙ্গে যাঁরা। সবাই মিলে পড়া হচ্ছে সেই বইপত্র। ভেবে দেখতে গেলে, আজ যে দুর্গাপুজো শিল্প নিয়ে মিলেমিশে রয়েছি, তাঁর বীজ তৈরি হয়েছিল সেই জুড়ে থাকার সময় থেকেই। সেই বেড়ে ওঠার সময়ই আমার চোখে-মুখে এসে পড়েছিল জনমানুষের আলো। সেই আলো আমি তখন থেকে আজও বয়ে বেড়াচ্ছি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে আমি যেতাম। বন্ধুরা সব বড় বড়। পাঁচমাথার মোড়ে আলোচনা হচ্ছে। ছবি-কবিতা-সাহিত্যের আলোচনা হচ্ছে। সেখানেই জানতে পেরেছিলাম মাথামোটার মতো ছবি এঁকে লাভ নেই। ছবি দেখতে হবে, শিখতে হবে, বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ছবি আঁকতে গেলে হতে হবে পলিটিকাল। জানতে হবে সারা পৃথিবীর ইতিহাস। লোকশিল্পের যে ইতিহাস তার কাছে পৌঁছতে হবে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মনে পড়ে, উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিসিজম আর নস্টালজিয়া তখনও বাঙালি জীবনে যথেচ্ছ! সেখানে আমি হাতে পেয়েছিলাম শার্ল বোদলেয়ার। আমি-তুমি তুমি-আমির পারমুটেশন-কম্বিনেশনের মাঝে নরকে পাপের ফুল এসে পড়ল যেন হাতে। অনুবাদ করছেন বুদ্ধদেব বসু। কোনটা সুন্দর আর কোনটা অসুন্দর– সুন্দর ও অসুন্দরের তত্ত্ব মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তথাকথিত প্রেমের বিপরীতে, নরম তুলতুলে জীবনের বিপরীতে আরেক ক্লেদাক্ত সত্যি আমার রক্তের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। বইয়ের হরফ থেকে লাফিয়ে আমার লাল রক্তে ঢুকে পড়েছিল সেই কালো অক্ষরগুলো। বিশ্বসাহিত্য সেই সময়ই ঢুকে পড়েছে মাথায়। ক্লাস নাইনে প্রেম করতে গিয়ে একটু-আধটু রবীন্দ্রনাথ পড়ছি। বিশেষ করে, ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটা। টালা পার্কের কাছে থাকেন, স্বপ্নাদি, আমাকে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়। আমি পড়তে থাকলাম। তার কারণ অবশ্য প্রেমপত্র লেখার একটা ভাষা আয়ত্ত করতে চাইছিলাম। এটা করতে করতে কবে যে, রবীন্দ্রনাথ আমার পরম গুরু হয়ে উঠেছিলেন, কে জানে! আজও তাই।
…………………………………………………………………………………………
আরও জানতে ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………………………………………………
মাস্টারমশাইয়ের ছোটবোন কৃষ্ণাদির ভ্যানিটি ব্যাগ ছিলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম। তিনিই আমাকে সিনেমা দেখাতেন, নাটক দেখাতেন, বইমেলায় যাওয়া– এমনকী, বই চুরি করতে শেখানোও। দু’বার বই চুরি করেছিলাম আমি। একটা শিল্পসংক্রান্ত বই। আরেকটা ভবানীপ্রসাদ দত্তর অনুবাদ ‘পাবলো নেরুদার অনুস্মৃতি’। এই যে বিচরণ করছি, এদিক-সেদিক যাচ্ছি– পৃথিবীটাকে চিনছিলাম।
শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে আমি যেতাম। বন্ধুরা সব বড় বড়। পাঁচমাথার মোড়ে আলোচনা হচ্ছে। ছবি-কবিতা-সাহিত্যের আলোচনা হচ্ছে। সেখানেই জানতে পেরেছিলাম মাথামোটার মতো ছবি এঁকে লাভ নেই। ছবি দেখতে হবে, শিখতে হবে, বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ছবি আঁকতে গেলে হতে হবে পলিটিকাল। জানতে হবে সারা পৃথিবীর ইতিহাস। লোকশিল্পের যে ইতিহাস, তার কাছে পৌঁছতে হবে।
আপনারা বলবেন, দুর্গাপুজো শিল্প কোথায় তবে এসবের মধ্যে?
আছে। সাধারণ মানুষের কাছে দুটো ভাঙা দেশলাইকাঠি দিয়ে আর্টের নিগূঢ় তত্ত্ব বোঝানো যাবে না। দুর্গাপুজো শিল্প, শিল্পের সহজ পাঠ হয়ে উঠতে পারে। সেটার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলে, টান তৈরি হলে শিল্পী যেতে পারেন গভীর তত্ত্বের দিকে।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১৩: তৃতীয় নয়নকে গুরুত্ব দিই, তৃতীয় লিঙ্গকেও
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত